তাওয়াক্কুল আরবি শব্দ। এর অর্থ আল্লাহ তায়ালার ওপর নির্ভরতা, আল্লাহর কাছে নিজেকে সোপর্দ করা এবং তারই ওপর ভরসা করা। ঈমানদার মানুষের বড় গুণ হচ্ছে, সর্বাবস্থায় আল্লাহতায়ালার ওপর ভরসা করা; সব কাজের ক্ষেত্রে আল্লাহর ওপর নির্ভরতা। অর্থাৎ চূড়ান্ত ফয়সালার ক্ষমতা যে আল্লাহর হাতে, তা মনেপ্রাণে স্বীকার করার নাম হচ্ছে- আল্লাহর ওপর ভরসা করা। বিষয়টি এভাবেও বলা যায়, একজন ঈমানদার ব্যক্তি, ভালো ও কল্যাণকর বিষয় অর্জনের জন্য নিজের সাধ্যমতো চেষ্টা করবে এবং ফলাফলের জন্য আল্লাহর ওপর ভরসা করবে; তার প্রতি দৃঢ় আস্থা রাখবে। এর মাঝেই রয়েছে ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণ।
আল্লাহ তায়ালার ওপর ভরসার নানা পর্যায় রয়েছে। অনেকেই কেবল মুখে আল্লাহর ওপর নির্ভর করার কথা বলেন। আবার কেউ কেউ সুনির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে আল্লাহর ওপর ভরসা করেন। আল্লাহর ওপর নির্ভরতার ক্ষেত্রে কারো কারো মনে কিছুটা দ্বিধা-সন্দেহ ও উদ্বেগ কাজ করে। এগুলো সর্বোচ্চ পর্যায়ের ভরসা নয়। আল্লাহর ওপর সর্বোচ্চ পর্যায়ের তাওয়াক্কুলকে বুঝার জন্য মায়ের প্রতি শিশুর নির্ভরশীলতার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। যেমন- একটি শিশু শুধু তার মাকেই একান্ত আপন বলে জানে, মায়ের ওপরই সে ভরসা করে, তার যত আবদার মায়ের কাছেই। সে কখনো মা থেকে আলাদা হয় না। মায়ের অনুপস্থিতিতে কোনো বিপদ ঘটলে শিশুর মনে প্রথমেই যে বিষয়টি আসে এবং যে শব্দটি মুখে উচ্চারিত হয়- তাহলো- মা। কারণ শিশু তার মাকেই একমাত্র আশ্রয়স্থল বলে জানে।
তাওয়াক্কুলের সর্বোচ্চ পর্যায় হচ্ছে, মানুষের জীবনের সব কিছুর শৃঙ্খলা বিধানকারী হিসেবে আল্লাহতায়ালাকে স্বীকার করে নেওয়া। এভাবেই আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুলের মাধ্যমে মানুষের মাঝে কাজের শক্তি ও স্পৃহা সৃষ্টি হয় এবং চিন্তাগত প্রতিবন্ধকতা দূর হয়। পার্থিব ভয়-ভীতির অবসান ঘটে। কারণ ঈমানদার ব্যক্তির শতভাগ বিশ্বাস হলো- আল্লাহ হচ্ছেন শক্তির একমাত্র উৎস। নবী-রাসূলরা ছিলেন আল্লাহর ওপর নির্ভরতার ক্ষেত্রে সর্বোত্তম আদর্শ। হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামকে আগুনে নিক্ষেপের ঘটনা এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। প্রতিমা ভাঙার পর হজরত ইবরাহিম (আ.) কে আগুনে নিক্ষেপ করার সিদ্ধান্ত নেয় অত্যাচারী বাদশা নমরুদ। এ পরিস্থিতিতে হজরত ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর ওপর ভরসা করেন এবং একমাত্র আল্লাহকেই স্মরণ করতে থাকেন। আর আগুন হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর জন্য ফুলের বাগানে পরিণত হয়।
আল্লাহ তায়ালার ওপর নির্ভর করাটা মানুষের জন্য এতোটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বারবার সাহাবাদের আল্লাহর ওপর ভরসা করার কথা বলেছেন। সবাইকে তিনি এ জন্য উৎসাহিত করেছেন। আলেমরা বলেন, যেখানে তাওয়াক্কুল থাকে, সেখানে সম্মান-মর্যাদা প্রতিষ্ঠা পায়। অন্যভাবে বলা যায়, যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে, সে সম্মান ও প্রাচুর্য্যের অধিকারী হয়। তবে তাওয়াক্কুল বস্তুবাদীদের জন্য একটি অভাবনীয় বিষ। কাজকর্ম সম্পন্ন করার পর ফলাফলপ্রাপ্তির জন্য আল্লাহর ওপর নির্ভর করতে হবে কেন, এটা তাদের কাছে বোধগম্য নয়। চর্মচক্ষু দিয়ে যে আল্লাহকে দেখা যায় না, তাকে সব ক্ষমতার উৎস হিসেবে মেনে নিতে হবে কেন- এমন বক্তব্য বস্তুবাদীদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, অদৃশ্যের ওপর বিশ্বাসই ঈমানদারদের জীবনের চলিকাশক্তি। আর এ কারণেই তাওয়াক্কুলের ফজিলতও সীমাহীন। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ভরসা করে, আল্লাহই তার জন্য যথেষ্ট।’
তাওয়াক্কুলের নীতি অবলম্বনকারী ব্যক্তি কখনও হতাশ হয় না। আশা ভঙ্গ হলে মুষড়ে পড়ে না। বিপদ-মসিবত ও যুদ্ধ-সংকটে ঘাবড়ে যায় না। যেকোনো দুর্বিপাক, দুর্যোগ ও সমস্যায় আল্লাহতায়ালার ওপর দৃঢ় আস্থা রাখে, বিশ্বাস রাখে। জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতন-নিপীড়নের যে ঝড়ই উঠুক না কেনো, ঈমানদার ব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করে না। এ ধরনের মানুষ সব সময়ই ভবিষ্যতের বিষয়ে আশাবাদী। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পুরো জীবনকাল এবং তার পরিবারের সবার জীবন ছিল আল্লাহর প্রতি নির্ভরতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। খোদাদ্রোহীদের অত্যাচার-নির্যাতনে, ক্ষুধা-দারিদ্র্য মোকাবিলায় এবং সাহাবিদের অভিযোগ-অনুযোগে সর্বাবস্থায় তিনি তাওয়াক্কুলকে একমাত্র অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করেছেন। কোরআনে কারিমের সূরা আত-ত্বলাকের ৩ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ভরসা করে, আল্লাহই তার জন্য যথেষ্ট। আল্লাহ তার কাজ সম্পন্ন করে দেবেন, তিনি সবকিছুর একটি পরিমাণ স্থির করে রেখেছেন।’
আসলে তাওয়াক্কুল হলো, আল্লাহতায়ালার দায়িত্বাধীন হওয়ার সর্বোত্তম উপায়। যেমন এক বুজুর্গ বলেন, ‘আমি শক্তিহীন পরগাছা, নিজের কোনো শেকড় নেই; কোনো গাছকে অবলম্বন না করে গজিয়ে ওঠার ও পল্লবিত হওয়ার ক্ষমতা নেই। কিন্তু হে আল্লাহ! যতক্ষণ পর্যন্ত আপনার সঙ্গে নিজেকে জড়াই ও আপনার ওপর তাওয়াক্কুল করি, ততক্ষণ আমার ভেতরে কোনো ভয়-ভীতি থাকে না।’ প্রতিটি মানুষই এমন। তার নিজের কোনো শক্তি ও ক্ষমতা নেই। এই বোধ-বিশ্বাস ও বাস্তবতা উপলব্ধি করে আল্লাহর ওপর পরিপূর্ণভাবে তাওয়াক্কুল করার মাঝেই রয়েছে কল্যাণ।