Monday, December 23
Shadow

বংশগত রোগ থ্যালাসেমিয়া : ডা. মাসুদা বেগম

থ্যালাসেমিয়া

বংশগত রোগ থ্যালাসেমিয়া

বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ৯ লাখ শিশু থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্মায়। দেশের অনেক নারী-পুরুষ নিজের অজান্তেই থ্যালাসেমিয়ার বাহক। আমাদের দেশে দিন দিন এ রোগে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা বাড়ছে। থ্যালাসেমিয়ার মতো রোগ প্রতিরোধে জনসচেতনতার বিকল্প নেই। একটু সচেতন হলেই এই রোগ প্রতিরোধ করা যায়। পরামর্শ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের হেমাটোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মাসুদা বেগম

থ্যালাসেমিয়া একটি বংশগত রোগ, যাতে রক্তে অক্সিজেন পরিবহনকারী রক্তকণিকা উৎপাদনে ত্রুটি থাকে। সাধারণত অস্থিমজ্জায় নিয়মিত লোহিত কণিকা তৈরি হয়। রক্তের লোহিত কণিকার আয়ুষ্কাল থাকে তিন মাস। এরপর প্লীহা এই লোহিত কণিকা রক্ত থেকে সরিয়ে নেয়। কিন্তু থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত রোগীর লোহিত কণিকার আয়ুষ্কাল অনেক কম থাকে বিধায় শরীরে হিমোগ্লোবিন ঠিকমতো তৈরি না হওয়ায় লোহিত কণিকাগুলো সহজেই ভেঙে পড়ে। অথচ অস্থিমজ্জার পক্ষে সেই একই পরিমাণ লোহিত কণিকা তৈরি করা সম্ভব হয় না। এতে একদিকে রক্তশূন্যতা তৈরি হয়, অন্যদিকে আয়তনে প্লীহা বড় হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় পরবর্তী সময় শরীরে অতিরিক্ত আয়রন জমা হতে থাকে, যা হৃৎপিণ্ড, প্যানক্রিয়াস, যকৃৎ, অণ্ডকোষ ইত্যাদি অঙ্গের কার্যক্ষমতা নষ্ট করে দেয়।

 

ধরন

প্রধানত দুই ধরনের থ্যালাসেমিয়া হয়। যথা—আলফা থ্যালাসেমিয়াও বিটা থ্যালাসেমিয়া।

আলফা থ্যালাসেমিয়া : চারটি জিন দিয়ে আলফা থ্যালাসেমিয়া ধারা গঠিত হয়। আমরা মা-বাবা প্রত্যেকের কাছ থেকে দুটি করে এই জিন পাই। এই জিনগুলোর মধ্যে এক বা তার বেশি ত্রুটিপূর্ণ হলে আলফা থ্যালাসেমিয়া হয়। যত বেশি জিন ত্রুটিপূর্ণ হবে, তত বেশি সমস্যা দেখা দেবে। যেমন—একটি জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে থ্যালাসেমিয়ার কোনো লক্ষণ ও উপসর্গ দেখা যাবে না। তবে আক্রান্ত ব্যক্তির মাধ্যমে তার সন্তানের মধ্যে এই রোগ ছড়াবে। দুটি জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে হালকা উপসর্গ দেখা যাবে, যাকে বলে ‘আলফা থ্যালাসেমিয়া মাইনর’ অথবা ‘আলফা থ্যালাসেমিয়া ট্রেইট’। আবার তিনটি জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে এর উপসর্গগুলো মাঝারি থেকে মারাত্মক আকার ধারণ করে। এই অবস্থাকে বলে ‘হিমোগ্লোবিন এইচ ডিজিজ’। চারটি জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে একে বলে ‘আলফা থ্যালাসেমিয়া মেজর’ অথবা ‘হাইড্রপস ফিটেইলস’।

বিটা থ্যালাসেমিয়া : বিটা থ্যালাসেমিয়া ধারা গঠিত হয় দুটি জিন দিয়ে। মা-বাবা প্রত্যেকের কাছ থেকে একটি করে মোট দুটি জিন আমরা পেয়ে থাকি। একটি অথবা উভয় জিনই ত্রুটিপূর্ণ হলে বিটা থ্যালাসেমিয়া দেখা দেয়। এ ক্ষেত্রে একটি জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে হালকা উপসর্গ দেখা যায়। এ অবস্থাকে বলে ‘বিটা থ্যালাসেমিয়া মেজর’ অথবা ‘বিটা থ্যালাসেমিয়া ট্রেইট’। দুটি জিনই ত্রুটিপূর্ণ হলে মাঝারি থেকে মারাত্মক উপসর্গ দেখা যায়। এ অবস্থাকে বলে ‘বিটা থ্যালাসেমিয়া মেজর’ অথবা ‘কুলিস অ্যানিমিয়া’। নবজাতক যেসব শিশুর এই সমস্যা থাকে, তারা জন্মের সময় বেশ স্বাস্থ্যবান থাকে। তবে জন্মের প্রথম দুই বছরের মধ্যেই এর উপসর্গ দেখা যায়।

 

উপসর্গ

থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত রোগীরা অ্যানিমিয়া বা রক্তস্বল্পতায় ভোগে বলে শারীরিকভাবে তারা বেশ দুর্বল থাকে। আলফা থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে রোগের উপসর্গ মৃদু বা মাঝারি হয়। কিন্তু বিটা থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে রোগের বেশ প্রকোপ থাকে। দু-এক বছরের শিশুর ক্ষেত্রে সঠিক চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুও ঘটতে পারে। এ ছাড়া কিছু লক্ষণও দেখা দেয়। যেমন—

♦ শারীরিক অবসাদ

♦ দুর্বলতা

♦ শ্বাসকষ্ট

♦ মুখমণ্ডল ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া

♦ অস্বস্তি

♦ ত্বক হলদে হয়ে যাওয়া তথা জন্ডিস

♦ মুখের হাড়ের বিকৃতি

♦ নাকের হাড় দেবে যাওয়া (মঙ্গলয়েড ফেস)

♦ শারীরিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হওয়া

♦ পেট ফুলে যাওয়া

♦ গাঢ় রঙের প্রস্রাব

হৃৎপিণ্ডে সমস্যা

♦ পেট বাইরের দিকে প্রসারিত বা বৃদ্ধি হওয়া ইত্যাদি।

 

চিকিৎসা

থ্যালাসেমিয়া গুরুতর না হলে চিকিৎসার তেমন প্রয়োজন নেই। তবে মারাত্মক আকার ধারণ করলে রোগীর শরীরে নিয়মিত রক্ত দিতে হয়। বলা যায়, এর প্রধান চিকিৎসা শরীরে রক্তসঞ্চালন নিশ্চিত করা। আর শরীরে অতিরিক্ত আয়রন জমা হলে আয়রন চিলেশন থেরাপি, সাধারণত ডেসফেরক্সামিন দেওয়া হয়। অন্যদিকে প্লীহা বড় হলে অপারেশন করে তা ছোট করতে হয়। এতে রক্ত গ্রহণের হার কিছুটা কম হয়। তবে বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট বা অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন হচ্ছে এই রোগের স্থায়ী চিকিৎসা। এতে অন্তত ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকার মতো খরচ হয়। এত দিন বিদেশে গিয়ে মানুষ এই রোগের চিকিৎসা করাত। আশার কথা যে সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের হেমাটোলজি বিভাগে এই চিকিৎসা শুরু হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ), বেসরকারি এ্যাপোলো হসপিটালস ঢাকায় এই বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট হচ্ছে।

 

রোগীর জন্য পরামর্শ

♦ নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা করে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ ১০ গ্রাম বা ডেসিলিটার রাখার চেষ্টা করা।

♦ হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের টিকা নেওয়া।

♦ শিশুরোগীর ক্ষেত্রে প্রতি তিন মাস অন্তর লিভার ফাংশন, ওজন ও উচ্চতা পরীক্ষা করা।

♦ ৮-১০ ব্যাগ রক্ত দেওয়ার পর রক্তে লৌহের পরিমাণ নির্ণয় করতে হয়। রক্তে লৌহের পরিমাণ এক হাজার ন্যানোগ্রাম বা মিলিলিটারের ওপর হলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয়।

♦ রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন পড়লে বিশুদ্ধ রক্ত পরিসঞ্চালন নিশ্চিত করা।

 

প্রতিরোধে করণীয়

থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজন ব্যাপক জনসচেতনতা। মনে রাখতে হবে, এটি একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ। যদি স্বামী-স্ত্রী দুজনই থ্যালাসেমিয়া বাহক বা একজন থ্যালাসেমিয়া বাহক ও একজন হিমোগ্লোবিন ‘ই’র বাহক হন, তবে প্রতি গর্ভাবস্থায় : এ রোগে আক্রান্ত শিশু জন্ম নেওয়ার সম্ভাবনা থাকে ২৫ শতাংশ, বাহক শিশু জন্ম নেওয়ার সম্ভাবনা থাকে ৫০ শতাংশ, আর সুস্থ শিশু জন্ম নেওয়ার সম্ভাবনা থাকে ২৫ শতাংশ। তাই কিছু করণীয় হলো—

জনসচেতনতা : থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে জনসচেতনতা বাড়াতে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে। পাশাপাশি নিতে হবে সমন্বিত স্বাস্থ্য কর্মসূচি ও সামাজিক উদ্যোগ। ঢাকাসহ সারা দেশের জেলা ও বিভাগীয় শহরগুলোতে এই রোগ শনাক্তকরণের লক্ষ্যে পরামর্শকেন্দ্র বাড়াতে হবে।

জেনেটিং কাউন্সেলিং : রোগটি পুরোপুরি নির্মূল করতে জেনেটিং কাউন্সেলিংয়ের কোনো বিকল্প নেই।

বৈবাহিক সম্পর্ক বন্ধ : ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিনের বাহক যাঁরা, তাঁদের মধ্যে বিয়ে বন্ধ করতে হবে।

গর্ভাবস্থায়ই রোগ নির্ণয় : গর্ভাবস্থায়ই ভ্রূণ বা শিশুর রোগ নির্ণয় নিশ্চিত করতে হবে। যেসব পরিবারে স্বামী ও স্ত্রী দুজনই এ রোগের বাহক অথবা যাঁদের এক বা একাধিক থ্যালাসেমিক শিশু আছে, তাঁরা গর্ভস্থ ভ্রূণ পরীক্ষার মাধ্যমে সম্ভাব্য থ্যালাসেমিক শিশু নির্ণয় ও তা পরিহার (গর্ভপাত) করাতে পারেন। গর্ভাবস্থার ১৬ থেকে ১৮ সপ্তাহের মধ্যে এই পরীক্ষাটি করালে ভালো হয়। গর্ভস্থ সন্তান থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত কি না তা জানার জন্য কোরিওনিক ভিলিয়াস স্যাম্পলিং, অ্যামনিওসেনটিসিস ও ফিটাল ব্লাড স্যাম্পলিং পরীক্ষাগুলো করা যেতে পারে।

 

https://www.youtube.com/watch?v=Geg0SPadJxM&feature=youtu.be&fbclid=IwAR2HglGA9JSXIEbcvEWF0-NSYX9OzQEZymVGMbPrRjOZLDTmhxxrotcebkA

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!