মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের ওপর হারাম করা হয়েছে তোমাদের মাতাদের, মেয়েদের, বোনদের, ফুফুদের, খালাদের, ভাতিজিদের, ভাগ্নিদের, তোমাদের সেসব মাতাকে যাঁরা তোমাদের দুধপান করিয়েছেন, তোমাদের দুধবোনদের, তোমাদের শাশুড়িদের, তোমরা যেসব স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত (দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন) হয়েছ, সেসব স্ত্রীর অন্য স্বামী থেকে যেসব কন্যা তোমাদের কোলে রয়েছে তাদের, আর যদি তোমরা তাদের সঙ্গে মিলিত না হয়ে থাকো, তবে তোমাদের ওপর কোনো পাপ নেই এবং তোমাদের ঔরসজাত পুত্রদের স্ত্রীদের এবং দুই বোনকে একত্র করা (তোমাদের ওপর হারাম করা হয়েছে)। তবে অতীতে যা হয়ে গেছে তা ভিন্ন কথা। নিশ্চয়ই আল্লাহ মাশীল, পরম দয়ালু। আর (হারাম করা হয়েছে) নারীদের মধ্য থেকে অন্যের বিবাহিতদের। তবে তোমাদের ডান হাত যাদের মালিক হয়েছে (দাসী) তারা ছাড়া। এটি তোমাদের ওপর আল্লাহর বিধান এবং এরা ছাড়া সব নারীকে তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে যে তোমরা তোমাদের অর্থের বিনিময়ে তাদের চাইবে বিবাহ করে, অবৈধ যৌনাচারে লিপ্ত হয়ে নয়।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ২৩-২৪)
যেসব নারীকে বিবাহ করা হারাম
১৩ প্রকার নারী বিবাহ করা হারাম :
১. আপন মা, পিতা ও দাদা-নানার স্ত্রীরা এবং তাদের কামভাব নিয়ে স্পর্শকৃত নারী। এরূপ ঊর্ধ্বতন সব দাদা, নানার স্ত্রীরা।
২. মেয়ে এবং ছেলে ও মেয়ের ঘরের সব নাতনি।
৩. সহোদরা, বৈপিত্রেয়, বৈমাত্রেয় ফুফু।
৪. সহোদরা, বৈপিত্রেয়, বৈমাত্রেয় খালা।
৫. সহোদরা, বৈপিত্রেয়, বৈমাত্রেয় বোন ও তাদের সন্তানাদি।
৬. সহোদরা, বৈপিত্রেয়, বৈমাত্রেয় ভ্রাতৃকন্যা ও তাদের সন্তানাদি।
৭. দুধমা, তার মাতা, দাদি, নানি এমনিভাবে ওপরের সব নারী।
৮. স্ত্রীর মেয়ে, যদি স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস হয়ে থাকে।
৯. পুত্রবধূ, আপন ছেলের হোক বা দুধ ছেলের হোক।
১০. আপন শাশুড়ি, দাদি শাশুড়ি, নানি শাশুড়ি এবং ওপরে যারা রয়েছে।
১১. দুই বোন একত্রীকরণ, এমনিভাবে ফুফু ও তার ভাতৃকন্যা, খালা ও তার ভাগ্নিকন্যাকে একসঙ্গে বিবাহের মধ্যে রাখা।
১২. উল্লিখিত রক্ত সম্পর্কের কারণে যারা হারাম হয়েছে, দুধ সম্পর্কের কারণেও তারা সবাই হারাম হয়।
১৩. যে মেয়ে অপরের বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ রয়েছে।
এ ছাড়া অন্য সব নারী বিবাহ করা হালাল। (দেখুন : সুরা নিসা, আয়াত ২৩-২৪)
স্ত্রীর বর্তমানে শালিকে বিয়ে করা অবৈধ
কোনো নারী কারো বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ থাকাকালীন ওই নারীর বোনের সঙ্গে বিবাহ করা সম্পূর্ণ হারাম। প্রথম বোনের সঙ্গে তালাক হয়ে গেলে মহিলার ইদ্দত শেষ হওয়ার পর অথবা বোন মারা গেলে তখন তার বোনের সঙ্গে বিবাহ বৈধ। (হিন্দিয়া ১/২৭৭)
পরস্পর লেগে থাকা যমজ দুই বোনের বিয়ের বিধান
জš§গতভাবে পরস্পর জড়ানো যমজ দুই বোনের জš§ হলে দুই বোনকে এক ব্যক্তি একত্রে বিবাহ করতে যেমন পারবে না, তদ্রƒপ দুই বোনকে দুই ব্যক্তির কাছে বিবাহ দেওয়াও সম্ভব নয়। শুধু এক বোনকে একজন লোকের কাছে বিয়ে দিলেও পর্দার বিধান রা করে তাকে নিয়ে সংসার করাও সম্ভব হবে না। তাই এ সমস্যার একমাত্র সমাধান হবে, অপারেশনের মাধ্যমে দুই বোনকে আলাদা করার চেষ্টা করা, যা বর্তমান যুগে ব্যয়বহুল হলেও সম্ভব। অতঃপর দুই বোনকে পৃথক দুই ব্যক্তির কাছে বিয়ে দেওয়া। আর পৃথক করা কোনোভাবে সম্ভব না হলে তাদের চিরকুমারী থাকা ছাড়া কোনো উপায় নেই। (বাদায়েউস সানায়ে : ২/২৬২, ইমদাদুল ফাতাওয়া : ২/২৩৯)
চাচাতো ভাই-বোনের মেয়েকে বিবাহ বৈধ
আপন ভাই বা বোনের মেয়েকে বিবাহ করা হারাম। তবে চাচাতো, মামাতো, খালাতো, ফুফাতো ভাই ও বোনের মেয়ে মুহাররমাতের অন্তর্ভুক্ত নয়, তাই তাদের বিবাহ করা জায়েজ হবে। (বিনায়া : ৪/৫০৮)
দুধবোন ও তার মেয়েকে বিবাহ করা হারাম
ইসলামী শরিয়তের আলোকে দুধবোনকে বিবাহ করা সম্পূর্ণ হারাম ও নিষেধ। বংশীয় সম্পর্কে সহোদর বোনের মেয়ে বিয়ে করা যেমন হারাম, দুধবোনের মেয়ে বিয়ে করাও সেরূপ হারাম। (বুখারি, হাদিস : ২৬৪৫, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২)
প্রাপ্তবয়স্ক স্বামী স্ত্রীর দুধ পান করলে স্ত্রী হারাম হবে না
সাবালক স্বামী স্বীয় স্ত্রীর দুধ পান করা শরিয়তে নিষিদ্ধ ও গর্হিত কাজ। তবে এর দ্বারা বৈবাহিক সম্পর্ক বিচ্ছেদ হবে না। সহবাসের সময় উত্তেজনা বৃদ্ধির ল্েয স্ত্রীর স্তন মুখে নিতে পারবে, তবে দুধ যেন ভিতরে না যায় তা খেয়াল রাখতে হবে। (আদ্দুররুল মুখতার : ৩/২২৫)
একাধিক নারী থেকে সংগৃহীত দুধ ফ্রিজে রেখে পান করানো
কোনো সন্তান দুই বছর বয়সের ভেতর কোনো একজন নারীর বা একাধিক নারীর দুধ পান করলে ওই সন্তান ওই নারী বা নারীদের দুধসন্তান হিসেবে গণ্য হয়ে যায়। চাই সন্তান সরাসরি মহিলার স্তন থেকে দুধ পান করুক বা মহিলার স্তন হতে বের করা দুধ সন্তানকে পান করানো হোক। কিন্তু এর জন্য দুধ অপরিবর্তিত থাকা শর্ত। (বাদায়েউস সানায়ে : ৪/৯)
দুধব্যাংকের শরয়ী বিধান
পশ্চিমা দেশগুলোতে মহিলাদের দুধ সংরণ করে প্রয়োজনে ব্যবহার করা হয়। শরিয়তের দৃষ্টিতে বংশের হেফাজত অতীব জরুরি। আর এ ধরনের দুধব্যাংকের কারণে আÍীয়তার সম্পর্কে সংমিশ্রণ ও সন্দেহ সৃষ্টি হয়। তাই এ পদ্ধতি গ্রহণ করে দুধ খাওয়ানো বৈধ নয়। কেননা এর কোনো প্রয়োজনীয়তাও নেই। কারো মা না থাকলে দুধের প্রয়োজনে আÍীয়-স্বজন পাড়া-প্রতিবেশী কারো থেকে গ্রহণ করতে পারে। তবে দুধব্যাংক থেকে দুধ পান করলে যার দুধ জানা সম্ভব হলে তার সঙ্গে হুরমত সাব্যস্ত হয়ে যাবে। (কারারাতু মাজমাইল ফিকহিল ইসলামী পৃষ্ঠা : ২,৩)
পালক মেয়েকে বিবাহ করা বৈধ
যদি কারো পালক কন্যা ওই ব্যক্তির স্ত্রীর অথবা কোনো মাহরামের দুধ দুই বছর বয়সের ভিতরে পান না করে থাকে, তাহলে উক্ত ব্যক্তির সঙ্গে বিবাহ জায়েজ। এ েেত্র পর্দা করাও ফরজ। (সুরা আহজাব, আয়াত ৩৩, ফাতাওয়ায়ে দারুল উলুম দেওবন্দ ৭/২৪৪)
কামভাব নিয়ে পুত্রবধূকে স্পর্শ করা ও তাকানো
শ্বশুরের জন্য পুত্রবধূর দিকে কুদৃষ্টিতে তাকানো মারাÍক গুনাহ ও হারাম। যদি শ্বশুর কামভাব নিয়ে পুত্রবধূর খালি শরীরে বা পাতলা কাপড়ের ওপর দিয়ে স্পর্শ করে, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে ছেলের জন্য ওই পুত্রবধূ হারাম হয়ে যাবে। তবে শর্ত হলো, স্পর্শের বিষয়টি স্বীকারোক্তি বা সাীর মাধ্যমে প্রমাণিত হতে হবে অথবা ছেলে ওই কথার দাবিকারীকে প্রবল ধারণামতে সত্য মনে করতে হবে। এমতাবস্থায় উভয়ে পৃথক হয়ে যেতে হবে। (বাদায়েউস সানায়ে ২/২৬০, রদ্দুল মুহতার ৩/৩৩)
জামাতা-শাশুড়ি পরস্পরে কামভাব নিয়ে দেখা বা স্পর্শ করা
বাহ্যিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গের দিকে কামভাব নিয়ে তাকালে গুনাহ হলেও ‘হুরমাতে মুসাহারাত’ সাব্যস্ত হয় না। বরং খোলামেলা কোনো অঙ্গ কামভাবে স্পর্শ করার দ্বারা হারাম সাব্যস্ত হয় তথা স্ত্রী চিরতরে হারাম হয়ে যায়। (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, হাদিস : ১০৮৩২)
অবৈধ শয্যাসঙ্গিনীর মেয়েকেও বিয়ে করা হারাম
যার সঙ্গে অবৈধ শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে তার মেয়েকে বিয়ে করাও অবৈধ। কেননা ওই মেয়ের সঙ্গে এখন তার কন্যার সম্পর্ক হয়ে গেছে। (বাদায়েউস সানায়ে ২/২৬০)
তালাক গ্রহণ ছাড়া অন্য জনের সঙ্গে বিয়ে
আগের স্বামীর তালাক প্রদান ছাড়া অন্য কোনো বিবাহ শরিয়তের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয়। ওই বিবাহ বাতিল বলে গণ্য হবে। তদ্রƒপ আগের স্বামীর ইদ্দত চলাকালেও বিবাহ বাতিল হবে। (তাফসিরুল জালালাইন পৃষ্ঠা ১০৪, রদ্দুল মুহতার : ৩/৫১৯)
ইহুদি-খ্রিস্টান মেয়ে বিয়ে করা
বর্তমান যুগের ইহুদি-খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী বলে যারা পরিচিত, নির্ভরযোগ্য মতানুসারে তারা ইহুদি-খ্রিস্টানদের মূল নীতির অবিশ্বাসী। বর্তমানে বাস্তব আহলে কিতাব নেই বললেই চলে। এ ছাড়াও বর্তমানে তাদের নারীদের বিবাহ করা অনেক ফিতনার কারণ হয়ে থাকে বিধায় তাদের বিবাহ করা বৈধ নয়।
তবে এ ধরনের নারীদের সঙ্গে বিবাহ হয়ে গেলে তার ব্যাপারে খোঁজ নিতে হবে যে সে প্রকৃত অর্থে মুসা (আ.) ও ঈসা (আ.)-এর আনীত ধর্মে বিশ্বাসী কি না? তাওরাত বা ইঞ্জিলে বিশ্বাসী কি না? এবং আল্লাহকে বিশ্বাস করে কি না? যদি সত্যিই তা হয় তবে তাকে দাওয়াতের মাধ্যমে মুসলমান বানানোর চেষ্টা করার শর্তে উক্ত বিয়েকে বাতিল বলা যাবে না। আর যদি প্রমাণিত হয় যে সে নাস্তিকতায় বিশ্বাসী, তাহলে এই বিয়ে বাতিল বলে গণ্য হবে। (রদ্দুল মুহতার ৩/৪৫, ফাতাওয়া দারুল উলুম ৭/২৬১)
হিন্দু-মুসলিম বিবাহের বিধান
শরিয়তের দৃষ্টিতে মুসলিম পুরুষ কোনো হিন্দু মহিলাকে তদ্রƒপ মুসলিম নারী হিন্দু পুরুষকে বিবাহ করতে পারে না, যতণ তারা ইসলাম গ্রহণ না করে। ইসলাম গ্রহণ ছাড়া বিবাহ অবৈধ। এ ধরনের বিবাহ শরিয়তে বিবাহ বলে গণ্য হবে না। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা মুশরিককে বিয়ে কোরো না, যতণ না তারা ঈমান না আনে।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২২১)
লেখক : ফতোয়া গবেষক