শেয়ারবাজারের দরপতন ঠেকাতে গতকাল মঙ্গলবার নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ সংশ্নিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে দফায় দফায় মিটিং-সিটিং হয়েছে। শেয়ার বিক্রির চাপ কমাতে নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ প্রভাবশালী মহল থেকে বড় ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকের কাছে ফোন গেছে। শেয়ার কেনার জন্য রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ সংস্থা আইসিবিকেও বলা হয়েছে। এত কিছুর পরও ফলাফল শূন্য। শেয়ারবাজারে লাগাতার দরপতন অব্যাহত আছে। দরপতনে পুঁজি হারিয়ে বিনিয়োগকারীরা মতিঝিলে বিক্ষোভ ও কিছু সময়ের জন্য সড়ক অবরোধ করেন।
গতকাল প্রধান শেয়ারবাজার ডিএসইতে ৬৭ শতাংশ শেয়ারের দরপতন হয়েছে, বিপরীতে বেড়েছে মাত্র ১৬ শতাংশ শেয়ারের দর। এছাড়া চট্টগ্রামকেন্দ্রিক দ্বিতীয় শেয়ারবাজার সিএসইতে ৬৯ শতাংশ শেয়ারের দরপতন হয়েছে, বেড়েছে ২২ শতাংশের। এতে উভয় বাজারের প্রধান দুই সূচকের পতন হয়েছে ১ শতাংশ।
এমন প্রেক্ষাপটে দরপতন যাতে আরও গভীর না হয়, তার জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি গতকাল বিকেলে বাজারের প্রধান স্টেকহোল্ডার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ, ব্রোকারদের সংগঠন ডিবিএ, মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর সংগঠন বিএমবিএর নেতা এবং বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন ব্রোকারেজ হাউসের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করেন।
ওই বৈঠকে সংশ্নিষ্টদের দাবির মুখে দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্রোকারেজ বুথ স্থাপনের অনুমতি দিতে রাজি হয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। এছাড়া শেয়ারের ক্রয় চাহিদা বাড়াতে ‘স্ট্ক্রিপ নেটিং’ অর্থাৎ একই দিনে একই শেয়ার কিনে বিক্রির সুযোগ প্রদানের বিষয়ে সম্মত হয়েছে বিএসইসি। সংশ্নিষ্টদের দাবি, এতে শেয়ার কেনাবেচা বাড়বে এবং দরপতন বন্ধ করতে কিছুটা সহায়তা করবে।
চলমান দরপতনের জন্য বাজারের তারল্য সংকটকে প্রধান কারণ হিসেবে দায়ী করে এ সংকট সমাধানে বিএসইসির জোরালো ভূমিকা প্রত্যাশা করেছেন স্টেকহোল্ডাররা। বিশেষত ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সহযোগী মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকার ডিলার প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যাতে বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারিত এক্সপোজার (বিনিয়োগ) সীমা বাধা না হয়, তার জন্য প্রয়োজনীয় বিধি-বিধানে সংশোধন আনতে ভূমিকা দাবি করেন। শীর্ষ ব্রোকাররা জানান, তাদের কাছে বিনিয়োগ করার মতো অর্থ নেই। এ অবস্থায় বিএসইসি তাদের বন্ড বিক্রি করে অর্থ সংগ্রহের অনুমতি দিলে তারল্য সংকটের দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হতে পারে। তবে এ বন্ডের বিনিয়োগকে ব্যাংকের শেয়ারবাজার এক্সপোজার হিসাব থেকে বাদ দিতে হবে।
সংশ্নিষ্টদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিএসইসির চেয়ারম্যান ড. এম খায়রুল হোসেন আইনের মধ্যে থেকে যা কিছু করার তা করবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন। বিএসইসির চেয়ারম্যান স্টেকহোল্ডারদের বলেন, অর্থমন্ত্রী বর্তমানে বিদেশ সফরে আছেন। তিনি দেশে ফেরার পরই এ বিষয়ে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবেন। তার আগে সকলকে সামর্থ্য অনুযায়ী বিনিয়োগ বাড়িয়ে দরপতন রোখার আহ্বান জানান। একই সঙ্গে বিনিয়োগকারীরা যাতে ‘দরপতনের ভীতি’ থেকে শেয়ার বিক্রি না করেন, তা বোঝানোর জন্যও বলেন।
তবে বাজারে লাগাতার দরপতনের জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির চেয়ারম্যান ড. এম খায়রুল হোসেনের ব্যর্থতাকে দায়ী করে তার পদত্যাগ দাবি করেছেন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা। তারা রাজধানীর মতিঝিলে ডিএসই কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ করেন। দুপুর পৌনে ৩টায় ডিএসই কার্যালয়ের সামনে মতিঝিলের শাপলা চত্বরমুখী ব্যস্ত রাস্তা কিছু সময়ের জন্য অবরোধও করেন বিক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীরা। তবে পুলিশের হস্তক্ষেপে তারা অবরোধ তুলে নেন।
বিনিয়োগকারীদের বিক্ষোভের আগে গতকাল দুপুর ১২টায় বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন ব্রোকারেজ হাউসের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে চলমান দরপতনে করণীয় নির্ধারণে বৈঠক করে ডিবিএ। ওই বৈঠকে ডিএসইর একাধিক পরিচালকও উপস্থিত ছিলেন। ডিবিএ ও বিএমবিএ নেতারা বলেছেন, স্বল্পমেয়াদি কিছু পদক্ষেপ দিয়ে বাজারের চলমান তারল্য সংকট ও বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকটকে সম্পূর্ণরূপে দূর করা যাবে না। এজন্য দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত সংকটগুলো সমাধানে বিএসইসিকে জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে।
মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর সংগঠন বিএমবিএর সভাপতি ও লংকাবাংলার শেয়ারবাজার উইংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাসিরউদ্দিন চৌধুরী বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা, বিশেষত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউসগুলো চাইলেও এ সময়ে বিনিয়োগ করতে পারছে না। কারণ ব্যাংক কোম্পানি আইনের মাধ্যমে তাদের বিনিয়োগ করার সুযোগ হ্রাস করা হয়েছে। এ বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে সমস্যাগুলো উল্লেখ করে তা সমাধানের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে বাংলাদেশ ব্যাংককে কয়েক দফায় চিঠি দেওয়া হয়েছে। এমনকি সাবেক অর্থমন্ত্রী নিজে চিঠি দিলেও বাংলাদেশ ব্যাংক এখনও তা আমলে নিচ্ছে না বলে তিনি জানান।
গতকালের পূর্বনির্ধারিত বিভিন্ন ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বীমা কোম্পানির মালিকানাধীন ব্রোকারেজ হাউসগুলোর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে ডিবিএর বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে ডিবিএর সভাপতি শাকিল রিজভী বলেন, চলতি দরপতনের বড় কারণ তারল্য সংকট। বিনিয়োগকারীদের নতুন করে বিনিয়োগ করার সামর্থ্য নেই। এ অবস্থায় স্বল্পমেয়াদে বাজারে নতুন বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে যেসব এলাকায় ব্রোকারেজ হাউস নেই, সেখানে ব্রোকারেজ হাউসগুলোর বুথ বা সার্ভিস সেন্টার করার অনুমতি প্রদানের দাবি জানানো হয়েছে। এছাড়া লেনদেন বা শেয়ারের ক্রয় চাহিদা বাড়াতে ‘স্ট্ক্রিপ নেটিং’ প্রবর্তনের জন্য বিএসইসির কাছে দাবি করা হয়। এছাড়া মেট্রো সিটি বা বড় শহরগুলোতে ব্রোকারেজ শাখা খুলতে দিতেও দাবি জানানো হয়।
বাজার পরিস্থিতি :গতকাল ডিএসইতে ৩৪৭ কোম্পানির শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ড কেনাবেচা হয়েছে। দরপতন ঠেকাতে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ সংস্থা আইসিবির বড় প্রচেষ্টার পরও এর মধ্যে ২৩১টিরই দরপতন হয়েছে, বেড়েছে মাত্র ৫৭টির দর। বাকি ৫৯ শেয়ারের দর ছিল অপরিবর্তিত। বাজারের সিংহভাগ বৃহৎ মূলধনী কোম্পানিসহ সিংহভাগ শেয়ারের দরপতন হওয়ায় ডিএসইএক্স সূচক ৫৩ পয়েন্ট হারিয়ে ৫৩১৮ পয়েন্টে নেমেছে।
দিনের লেনদেন পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, অন্যান্য দিনের মতো দরপতন দিয়ে গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় স্টক এক্সচেঞ্জের লেনদেন শুরু হয়। প্রথম ঘণ্টায় সিংহভাগ শেয়ার দর হারানোয় ডিএসইএক্স সূচক ৪২ পয়েন্ট হারিয়ে ৫৩২৯ পয়েন্টে নামে। এরপরই আইসিবি শেয়ার ক্রয় শুরু করে। পরের পৌনে এক ঘণ্টায় সূচকটি ৬৬ পয়েন্ট বেড়ে ৫৩৯৬ হয়। কিন্তু এরপরই পুনরায় শেয়ার বিক্রির চাপ বেড়ে গেলে হাল ছেড়ে দেয় আইসিবি। তারপর পুনরায় দরপতন শুরু হয়। দুপুর ১২টা ২০ মিনিট থেকে শুরু হওয়া এ দরপতন দুপুর আড়াইটায় লেনদেনের শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত চলে। লেনদেনের শেষ মুহূর্তে সূচকটি আগের দিনের তুলনায় ৬১ পয়েন্ট বা দিনের সর্বোচ্চ অবস্থান থেকে ৮৫ পয়েন্ট হারিয়ে ৫৩১১ পয়েন্টে নেমেছিল।
দিনের লেনদেন শেষে দেখা গেছে, সর্বাধিক প্রায় ১০ শতাংশ দর হারিয়ে বস্ত্র খাতের কোম্পানি আরএন স্পিনিং ছিল দরপতনের শীর্ষে। চলতি দরপতনের ধারার পাশাপাশি সোমবার রাতে এ কোম্পানিটির কারখানা আগুনে পুড়ে যাওয়াও শেয়ারটির দরপতনের বড় কারণ ছিল। এছাড়া ইউনাইটেড ইন্স্যুরেন্স, সাভার রিফ্যাক্টরিজ, ইউনাইটেড পাওয়ার, মোজাফফর হোসেন স্পিনিং, রূপালী লাইফ, ইস্টার্ন ল্যুব্রিকেন্টস, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো এবং প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারদর ৬ থেকে সাড়ে ৯ শতাংশ দর হারিয়ে ছিল দরপতনের শীর্ষে।
ব্যাপক দরপতনে অপেক্ষাকৃত ভালো সব শেয়ার দর হারালেও কিছু বন্ধ বা রুগ্ণ কোম্পানির শেয়ারদর বেড়েছে। এর মধ্যে বহু বছর ধরে বন্ধ ও ডিএসই থেকে তালিকাচ্যুতির শঙ্কায় থাকা মেঘনা কনডেন্সড মিল্ক্কের শেয়ারদর সর্বাধিক সাড়ে ৮ শতাংশ বেড়েছে। এছাড়া কেঅ্যান্ডকিউ, মেঘনা পিইটি, জুট স্পিনার্স, অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ ছিল দরবৃদ্ধির শীর্ষ দশে।
https://www.youtube.com/watch?v=AoO_iZhlnGs&t=11s