Monday, December 23
Shadow

ল্যাবএইডের ডাক্তার মাহবুবর রহমানের পরামর্শ : হার্ট অ্যাটাকে করণীয়

হার্ট অ্যাটাক-হার্ট অ্যাটাকের হার্ট অ্যাটাকে

হার্ট অ্যাটাকে বিনা চিকিৎসায় বা ভুল চিকিৎসায় এখন কারো মৃত্যু হওয়া দুর্ভাগ্যজনক। এ বিষয়ে রোগী ও চিকিৎসকরা সচেতন হয়ে দায়িত্ব পালন করলে জটিলতা এড়ানো যায়। লিখেছেন ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতালের সিনিয়র কনসালট্যান্ট ইন্টারভেনশন কার্ডিওলজিস্ট ও সিসিইউ ইনচার্জ ডা. মাহবুবর রহমান

 

এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে মৃত্যুর এক নম্বর কারণ হার্ট অ্যাটাক, যা অবিশ্বাস্য দ্রুততায় কেড়ে নিচ্ছে মানুষের জীবন। মৃত্যুর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কারণ ক্যান্সার হলেও এর উপসর্গগুলো ধীরে ধীরে প্রকাশ পায়। কিন্তু হার্ট অ্যাটাক হলে কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই সব শেষ হয়ে যায়। তাই এর আগাম পূর্বাভাস জেনে তাত্ক্ষণিক পদক্ষেপ গ্রহণে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করা সবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

 

হার্ট অ্যাটাক কী?

হার্ট বা হৃৎপিণ্ড হলো দেহের কেন্দ্রীয় পাম্প মেশিন বা সেচযন্ত্র। সারা দেহে অক্সিজেনসমৃদ্ধ রক্ত ও খাদ্য সরবরাহ করাই হার্টের প্রধান কাজ। বিশেষভাবে তৈরি কোটি কোটি মাংসপেশির জাল দিয়ে হৃৎপিণ্ড গঠিত। যেহেতু আজীবন তাকে সংকোচন-প্রসারণ করে পাম্পের কাজটি করতে হয়, সেহেতু তার নিজস্ব মাংসপেশির জন্যও প্রয়োজন হয় পর্যাপ্ত অক্সিজেন আর খাদ্য। এই অক্সিজেন ও খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করে হার্টের তিনটি প্রধান আর্টারি বা ধমনি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই তিনটি ধমানর যেকোনো একটির দেয়াল ফেটে গিয়ে রক্ত জমাট বেঁধে ধমনিটি বন্ধ বা ব্লক হয়ে যেতে পারে। তখন হৃৎপিণ্ডের একটি বড় এলাকার মাংসপেশি হঠাৎ মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ায়। এর নামই হার্ট অ্যাটাক।

 

কারণ

বিনা কারণে ধমনির দেয়াল ফেটে গিয়ে রক্ত জমাট বাঁধে না। এ জন্য প্রধানত দায়ী ধূমপান, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে অতিমাত্রায় কোলেস্টেরল বা চর্বির উপস্থিতি ইত্যাদি।

আবার কায়িক শ্রম না করে অলস জীবন যাপন করা, অতিরিক্ত ওজন, অতিরিক্ত মানসিক চাপ, মাদকদ্রব্য গ্রহণ, বংশগত কারণও কিছুটা দায়ী হতে পারে। এসব ঝুঁকি এককভাবে অথবা সম্মিলিতভাবে রক্তনালির দেয়াল নষ্ট করে ফেলতে পারে। কেননা একটি খসখসে দেয়ালে সহজে ময়লা জমে। ময়লার ভেতর মন্দ চর্বি ঢুকে প্রদাহ সৃষ্টি করে। এই প্রদাহ সীমা ছাড়িয়ে গেলে ধমনির দেয়াল ফেটে যায়। ফাটা দেয়ালে তখন রক্তের অণুচক্রিকা বা প্লাটিলেট একত্রিত হতে শুরু করে। শরীর তখন মনে করে, তার ছিঁড়ে যাওয়া রক্তনালিটি দ্রুত মেরামত করা দরকার। তখন রক্তের জমাট বাঁধা পদ্ধতি সক্রিয় হয়। সেখান থেকে ফিব্রিন বা তন্তু তৈরি হয়। এই তন্তু ও অণুচক্রিকা মিলে রক্তের দলা তৈরি করে খুব দ্রুত ধমনিটিকে বন্ধ করে দেয় বা ব্লক করে দেয়। ফলে হৃৎপিণ্ডের ওই অংশটুকু অক্সিজেন ও খাদ্যশূন্য হয়ে ধ্বংসের মুখোমুখি হয়।

 

হার্ট অ্যাটাকে অসুবিধা

অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, একটি ধমনি বন্ধ হয়ে গেলে তাতে এমন কী সমস্যা হতে পারে? আসলে হার্টের পাম্পিং ক্ষমতার ওপরই পুরো শরীরের ভালো-মন্দ থাকা নির্ভর করে। স্বাভাবিক পাম্পিং ক্ষমতা ব্যাহত হলে শরীর অক্সিজেন ও খাদ্য থেকে বঞ্চিত হয়। তখন শরীর দুর্বল হয়ে চলাফেরা ও স্বাভাবিক জীবনের কার্যক্রম হারিয়ে ফেলে। তবে আশু এবং প্রকট সমস্যা যেটা হতে পারে তা হলো, হার্টের বৈদ্যুতিক গোলযোগ এবং পাম্প ফেইলিওর হওয়া। এতে হঠাৎ হার্ট বন্ধ হয়ে যেতে পারে। মেডিক্যালের ভাষায় যাকে বলা হয়, কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট বা সাডেন কার্ডিয়াক ডেথ। হার্ট অ্যাটাকে যত মৃত্যু হয়, তার বেশির ভাগই হয় প্রথম ২৪ ঘণ্টায় এবং হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই ঘটে থাকে ২৫ ভাগ মৃত্যু।

 

মূল্যবান সময়

চিকিৎসার মূল কাজটি হলো, হার্টের বন্ধ ধমনিটি দ্রুত খুলে দেওয়া। কেননা এটি বন্ধ হওয়ার ১২ ঘণ্টার মধ্যে ব্লক খুলে দিতে না পারলে হৃৎপিণ্ডের ওই এলাকার মাংসপেশির অনিবার্য মৃত্যু ঘটে। তাই যত দ্রুত খুলে দেওয়া যাবে ততই মঙ্গল। এটা মাথায় রাখতে হবে, বন্ধ ধমনির এলাকায় প্রতি মিনিটে লাখ লাখ মাংসপেশি ধ্বংস হয়। দুই মিনিট বেশি বন্ধ থাকলে তার দ্বিগুণ মাংসপেশির মৃত্যু হয় বা ধ্বংস হয়।

এ জন্য আমরা বলি Minute means muscle! সময় এখানে সব কিছুর নিয়ামক ও ফলাফল নির্ধারক। এই বিষয়টি চিকিৎসক ও রোগী বা রোগীর লোকজনকে বুঝতে হবে, মানতে হবে। কেননা মূল্যবান সময় পার হয়ে গেলে যতই আধুনিক উন্নত চিকিৎসা দেওয়া হোক না কেন, তাতে তেমন লাভ হবে না। কারণ যে পেশিগুলোর মৃত্যু হলো, তার পুনর্জীবন কেউ দান করতে পারবে না। এটাই জীববিদ্যা, জীবনের নিয়ম।

রোগীর করণীয়

৩০ বছরের বেশি বয়সী কোনো ব্যক্তির যদি হঠাৎ তীব্র বুক ব্যথা অনুভূত হয়, ঘাম দেয়, বমি বা বমির ভাব হয়, তাহলে দেরি না করে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব একটি ইসিজি করাতে হবে এবং চিকিৎসক দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে রিপোর্ট করাতে হবে। সকালের ইসিজি বিকেলে রিপোর্ট করালে চলবে না। হাসপাতালের জরুরি বিভাগ বেশ উপযুক্ত জায়গা। কিছু চিকিৎসা বাড়িতেই শুরু করা যেতে পারে। এ ছাড়া হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছতে আরো কিছু করণীয় রয়েছে। যেমন—

►  রোগীকে প্রথমেই শান্ত হয়ে বসিয়ে দিন বা শুইয়ে রাখুন।

►   ভ্যান, রিকশা, গাড়ি বা অ্যাম্বুল্যান্স—যা-ই হোক না কেন, দ্রুত কল করুন।

►  মোটেই সময়ক্ষেপণ করা উচিত হবে না। রাতে ব্যথা হলে ‘সকাল পর্যন্ত দেখি’-নীতি বর্জন করতে হবে। যখনই ব্যথা, তখনই হাসপাতাল—এ নীতি গ্রহণ করতে হবে।

►   হাসপাতালে পৌঁছার আগেই সম্ভব হলে একটি ডিসপ্রিন ট্যাবলেট ৩০০ মিলিগ্রাম চুষে বা পানিতে গুলে খাইয়ে দিন।

►   চারটি ৭৫ মিলিগ্রাম খড়ঢ়রত্বষ ট্যাবলেট খাইয়ে দিন।

►   একটি অঃড়াধ ৪০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট খাইয়ে দিন।

►   গ্যাসের সমস্যা মোকাবেলায় চধহঃড়হরী ৪০ মিলিগ্রাম একটি ট্যাবলেট খাইয়ে দিন।

চিকিৎসকের করণীয়

যে চিকিৎসাই দেওয়া হোক না কেন, তা হার্ট অ্যাটাকের ১২ ঘণ্টার মধ্যেই দিতে হবে। এরপর তেমন কোনো লাভ নেই বললেই চলে।

প্রথম কার্যকর পদ্ধতি : হার্ট অ্যাটাকের আধুনিক এবং সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য চিকিৎসা হলো, সঙ্গে সঙ্গে এনজিওগ্রাম করে বিশেষভাবে তৈরি বেলুন ও রিং বা স্ট্যান্টের সাহায্যে বন্ধ ধমনির ব্লক অপসারণ করা। একে বলে জরুরি এনজিওপ্লাস্টি বা প্রাইমারি পিসিআই। কিন্তু এটি একটি ব্যয়বহল পদ্ধতি এবং এখন পর্যন্ত তা মূলত রাজধানীকেন্দ্রিক।

দ্বিতীয় কার্যকর বিকল্প : দ্বিতীয় কার্যকর বিকল্প হলো, জমাট বাঁধা রক্তের দলা গলিয়ে ফেলার ওষুধ দ্রুত প্রয়োগ করা। যদি ইসিজিতে STEMI দেখা যায়, তখন দ্রুত স্ট্রেপটোকাইনেজ পুশ করে বেশ দায়িত্ব নিয়েই thrombolyse করুন। কোনো মনিটর না হলেও চলবে। আশা করা যায়, এতে ৬০-৭০ ভাগ ক্ষেত্রে বন্ধ ধমনি খুলে যাবে এবং রোগীর জীবন রক্ষা পাবে। হার্টের পাম্পিংক্ষমতাও বজায় থাকবে।

 

তবে নিম্নোক্ত কয়েকটি কারণে স্ট্রেপটোকাইনেজ দেওয়া যাবে না। যেমন—

►   চলমান কোনো রক্তক্ষরণ থাকলে (ঋতুস্রাবে সমস্যা নেই)।

►   এক মাসের ভেতর বড় ধরনের অপারেশন হয়ে থাকলে।

►  রক্তক্ষরণ থেকে ব্রেনস্ট্রোক হয়ে থাকলে।

►   উপসর্গ থেকে Aortic Dissecting Aneurysm সন্দেহ হলে।

 

উপজেলা, জেলা বা অন্য কোনো মফস্বল এলাকায় কর্মরত চিকিৎসকদের এ ব্যাপারে বিশেষ সচেতন হতে হবে। অনেক সময় অহেতুক আতঙ্কে তাঁরা মাত্র তিন হাজার টাকা দামের এই জীবনরক্ষাকারী ওষুধটি প্রয়োগ না করে রোগীকে অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে ফেলে দেন। এই ওষুধটি সরকারি হাসপাতালে মজুদ থাকে। জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালে বিনা মূল্যে দেওয়া হয়। বলা যায়, এটিই হলো হার্ট অ্যাটাকের মহৌষধ।

প্রাথমিক পর্যায় পার হলে এবং Anterior MI হলে ACE inhibitor বা ARB, Carvedilol বা Bisoprolol এবং পাঁচ থেকে আট দিন LMWH (Clexane) দিনে দুইবার দিতে হবে। এসব ওষুধে হার্ট ফেইলিওর এবং রক্তনালি আবার বন্ধ হওয়ার ঝুঁকি কমে আসে।

 

রিলিজের পর করণীয়

স্ট্রেপটোকাইনেজ পাওয়া রোগীদের সাধারণত পাঁচ থেকে আট দিনের মাথায় ছুটি দেওয়া যায়। হাসপাতালে থাকা অবস্থায়ই দ্বিতীয় দিন থেকে রোগীকে মবিলাইজ করার চেষ্টা করতে হবে। এ জন্য কিছু করণীয় হলো—

►   নরম খাদ্য থেকে স্বাভাবিক খাদ্য দিতে হবে।

►   প্রতিদিন কুসুমসহ একটি ডিম দেওয়া যেতে পারে।

►   ধূমপান চিরতরে ত্যাগ করতে হবে।

►   এক মাস ভারী কাজ করা নিষেধ।

►   খাদ্যাভ্যাস, চিকিৎসা ও সুশৃঙ্খল জীবনের মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।

►   এক মাস পার হলে চিকিৎসক দেখিয়ে ওষুধের ডোজ বা মাত্রা ঠিক করে নিতে হবে।

হার্ট অ্যাটাকে

সারা জীবনের ওষুধ

►   Tab Lopirel Plus দিনে একবার খাবার পর এক বছর খেতে হবে। এরপর শুধু Tab Ecosprin 75 mg রাতে খাবার পর চলতে থাকবে।

►   Tab Atova 40 mg রাতে খাবার আগে এক বছর খেতে হবে। এরপর 20 mg দৈনিক চলতে থাকবে।

►   এ ছাড়া beta blocker, ACEI/ARB, হার্ট অ্যাটাকের ধরন ও পাম্পিং ক্ষমতা (LVEF) অনুযায়ী চিকিৎসক ঠিক করে দেবেন। হার্ট অ্যাটাকে হার্ট অ্যাটাকে হার্ট অ্যাটাকে হার্ট অ্যাটাকে

https://www.youtube.com/watch?v=AoO_iZhlnGs&t=67s

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!