কাজী ফারহান হোসেন পূর্ব
পরমাণু ভাইয়ার কাছে গেলে তিনি আমাদেরকে রসায়নের নানা জটিল বিষয় খুব সহজে বুঝিয়ে দেন। সেই সাথে তিনি পর্যায় সারণির নানান অদ্ভুত এবং বিখ্যাত মৌল গুলো নিয়েও খোশগল্পে মেতে উঠেন। আজকে তিনি পর্যায় সারণির ‘ওয়ান্ডার মেটাল’ এবং ‘দুষ্ট মৌল’ নামে খ্যাত দুটি মৌল নিয়ে কাজী ফারহান হোসেন পূর্বকে কিছু বিস্ময়কর তথ্য দিয়েছেন!

ওয়ান্ডার মেটাল
তোমরা নিশ্চয়ই ওয়ান্ডার ওম্যানের নাম শুনেছ? আমি পরমাণু হয়েও ওয়ান্ডার ওম্যানের বিরাট ভক্ত। কারণ তার শক্তি, সাহস এবং পরাজয়ে হার না মানার স্বভাবই তাকে ওয়ান্ডার ওম্যান করে তুলেছে। আমাদের পরমাণু সমাজেও তার মতোই একটা বিস্ময়কর ধাতু আছে। আমরা ওকে নিয়ে সবাই বেশ গর্ব করি। তোমাদের যেমন জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর আছে তেমনি আমাদের সব পরমাণুরও একটা নম্বর আছে। সে হিসেবে আমাদের ওয়ান্ডার মেটালের নম্বর হল ২২। হ্যাঁ, তোমরা ঠিক ধরতে পেরেছ! ওর নাম টাইটেনিয়াম। লাইভসায়েন্স থেকে জানা যায়, ১৭৯১ সালে উইলিয়াম গ্রেগর এই মৌলটি প্রথম আবিষ্কার করেন। প্রশ্ন করতে পার মৌলটি নিয়ে এতো গর্ব করার কারণ কী? এই ধাতুটি কেন ‘ওয়ান্ডার মেটাল’ নামে পরিচিত হল? এর উত্তর আছে তার কাজে! টাইটেনিয়াম ধাতু হলেও সে শুধু ঝনঝন করেই তার অস্তিত্বের জানান দেয় না। সে মনে করে খালি কলস বাজে বেশি! তাইতো সে তার কাজের মাধ্যমে পরিচিত হতে চায়। আমাদের পরমাণু সমাজের গর্বের এ ধাতুটি স্টিলের মতোই শক্তিশালী। সায়েন্সলার্ন.অর্গ.এনজেড থেকে জানা যায় এটি স্টিলের চেয়েও ৪৫ শতাংশ হাল্কা! অন্যান্য ধাতুর মতো এর ক্ষয়ও তেমন হয় না কারণ এর উপরে অক্সাইডের একটা পাতলা আবরণ থাকে। এই আবরণটা ঠিক যেন ওয়ান্ডার ওম্যানের বর্ম! সমুদ্রের নোনা পানিও এর ক্ষতি করতে পারে না। তাই এটি জাহাজের প্রোপেলার তৈরিতে বেশ আস্থার সাথে ব্যবহৃত হয়। টাইটেনিয়াম হাল্কা, স্থিতিশীল। এ ধাতুটি তাপে ক্ষতিগ্রস্থ হয় না এবং এটি নিয়ে সহজে কাজ করা যায় বলে উড়োজাহাজ এবং মহাকাশযান বানাতেও এটি ব্যবহৃত হয়। বোয়িং কোম্পানি এর ওয়েবসাইট ঘেটে জানলাম একটি বোয়িং ৭৩৭ ড্রিমলাইনার মডেলের বিমানে ১৫ শতাংশ টাইটেনিয়াম ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া নাসার তথ্যমতে ইন্টার্ন্যাশনাল স্পেস স্টেশনে পাইপ এবং অন্যান্য সরঞ্জাম তৈরিতে প্রচুর টাইটেনিয়ামের ব্যবহার রয়েছে। আমাদের পরমাণু সমাজের কেউ যখন সমুদ্রে ভাসে, আকাশে উড়ে এবং নাসায় যায় তখন কার না ভালো লাগে! এছাড়াও টাইটেনিয়াম ব্যবহৃত হয় সাইকেল, গাড়ি এবং র্যাকেটের কাঠামো তৈরিতে। স্থাপত্যেও টাইটেনিয়াম ব্যবহারের জুড়ি মেলা ভার! স্পেনের গুগেনহাইম জাদুঘরের ওয়েবসাইট থেকে জানতে পারলাম তাদের জাদুঘরটি তৈরিতে টাইটেনিয়ামের তেত্রিশ হাজারটা পাতলা শিট ব্যবহৃত হয়েছে। ধাতুটি কিন্তু মানুষের দেহের কোনো ক্ষতি করে না। ফলে এটি হাড়ের প্রতিস্থাপক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সোনা, রূপার অলংকারের মতো এখন টাইটেনিয়ামের অলংকারও বিক্রি হচ্ছে দেদারসে! সব মিলিয়ে টাইটেনিয়াম একটা বিস্ময়কর ধাতু। আমাদের গৌরব!
দুষ্ট মৌল
তোমার ছোট ভাই-বোন তোমার কথা ঠিক মতো না শুনলে তাকে দুষ্ট কিংবা পাজী বলে থাক, তাই না? মজার বিষয় হল আমাদের পরমাণু জগতেও এমন একটি মৌল আছে যাকে খোদ পর্যায় সারণির জনক দিমিত্রি মেন্ডেলিফ দুষ্ট বলে আখ্যায়িত করে গেছেন। এমন কী দোষ করল সেই মৌল বেচারাটি? দোষ বলার আগে মৌলটির নামটা একটু বলে দেই তোমাদেরকে। সে হল আমাদের অতি পরিচিত হাইড্রোজেন মৌল। তোমরা জান যে, মৌল গুলোকে বিজ্ঞানি মেন্ডেলিফ ক্রমবর্ধমান পারমাণবিক সংখ্যা অনুযায়ী তার পর্যায় সারণিতে স্থান দেন। অর্থাৎ এক নম্বর মৌলের পর দুই নম্বর মৌল, এরপর তিন নম্বর, এভাবে আর কী! এই রীতিতে স্থান দিতে গিয়ে দেখা যায়, পর্যায় সারণির একেকটি কলাম যাকে তোমরা গ্রুপ বলে চেন সেখানে মৌলগুলোর মধ্যে বেশ কিছু মিল পাওয়া যায়। ফলে একই গ্রুপের মধ্যে সে মৌল গুলোই থাকে যাদের মধ্যে মিল রয়েছে। কিন্তু মৌল গুলো সাজাতে গিয়ে মেন্ডেলিফ লক্ষ করেন যে গ্রুপ-১ এর ক্ষার ধাতু গুলোর সাথে হাইড্রোজেনের ধর্মের যেমন মিল আছে ঠিক তেমনিভাবে গ্রুপ-১৭ এর হ্যালোজেন মৌলগুলোর ধর্মের সাথেও এর বেশ কিছু মিল আছে। এ তো বেজায় মুশকিল। হাইড্রোজেনকে তো আর দুই জায়গাতেই স্থান দেয়া যায় না! তার উপর হাইড্রোজেন আবার পর্যায় সারণির এক নম্বর মৌল। এই প্রথম মৌলটিকে সঠিক স্থান দিতে গিয়ে যদি গোড়ায় গলদ হয়ে যায় তবে কেমন হবে বলতো? তাই হাইড্রোজেনকে নিয়ে বেচারা মেন্ডেলিফের বেশ বেগ পেতে হয়। শেষ পর্যন্ত তিনি অবশ্য একে এক নম্বর গ্রুপেই রাখেন। কিন্তু হাইড্রোজেনের এই জ্বালাতনের জন্য তিনি তাকে দুষ্ট মৌল (ইংরেজিতে Rogue element) বলে অভিহিত করেই তবে তার মনের ক্ষোভ মেটান! সে থেকেই বেচারা হাইড্রোজেন আমাদের কাছে দুষ্ট মৌল নামে পরিচিত।
















