ইলেকট্রন বা ফোটন কণার দ্বৈত অবস্থার ব্যাখ্যা কিংবা কোয়ান্টাম এনটেঙ্গলমেন্ট-এর ক্ষেত্রে একটা বিষয় বলা হয় যে, কণার দশা কিংবা সুনির্দিষ্ট অবস্থা (স্পিন) যখনই জানার চেষ্টা করা হয় তখনই সেই কণা তার দ্বৈত অবস্থা হারায়। ডাবল স্লিট পরীক্ষার ক্ষেত্রে একটি ফোটন কণা যখনই ‘অবজারভেশন’ ওরফে পর্যবেক্ষণ এর আওতায় পড়ে তখন সেই কণা আর দ্বৈত ধর্ম তথা ‘একই সঙ্গে কণা ও তরঙ্গ’ এই অবস্থায় থাকে না। তখন ওই কণার ওয়েভ ফাংশন ভেঙে যায়। কণাটি তখন নির্দিষ্ট স্থানে একটি কণা হিসেবেই থাকে।
ডাবল স্লিট এক্সপেরিমেন্টে একটি একটি করে ফোটন যখন দুটো ছিদ্রওয়ালা (স্লিট) দেয়াল ভেদ করে সামনে যায় তখন সেটাকে পর্যবেক্ষণ করা হলে ফোটন কণার তরঙ্গধর্ম নষ্ট হয়ে যায়। তখন সেটা শুধু একটি ফাঁক দিয়ে ঢুকে অপরপ্রান্তের একটি নির্দিষ্ট স্থানেই আঘাত করে। মানে, ফোটন তখন টেনিস বলের মতো হয়ে যায়। যেমন ধরুন, আপনার সামনে দুটো ফাটলওয়ালা একটি দেয়াল আছে এবং সেই ফাটল বরাবর আপনি একটি একটি করে টেনিস বল ছুড়ে মারছেন। ফাটল দিয়ে ঢুকে অপরপ্রান্তের একটি স্থানেই ওই বল আঘাত করবে। কিন্তু ফোটন কণাটিকে ‘অবজারভ’ করা না হলে সেটা ওই বলের মতো না থেকে মাঝে মাঝে হয়ে যায় তরঙ্গ। যার কারণে সেটা ঠিক কখন কোথায় আঘাত করবে তা বোঝা যায় না। ঠিক যেন, ওই একটি কণা দুটো ছিদ্র দিয়েই একসঙ্গে ঢোকে ও অপরপ্রান্তে তরঙ্গের মতো ছড়িয়ে তরঙ্গ-সীমারেখার মধ্যে একটি স্থানে আঘাত করে। নিচের ছবিতে সেটাই দেখানো হয়েছে। অর্থাৎ এ ছবিতে দেখা যাচ্ছে ফোটন কণাকে যদি অবজারভ করা না হয় তবে সেটা কীভাবে তরঙ্গের মতো ছড়িয়ে যায় ও অপরপ্রান্তে একটা প্যাটার্ন তৈরি করে।
এই পরীক্ষা বহুবার বহু বিজ্ঞানী করেছেন। প্রতিবারই তারা এমন ফল পেয়েছেন। কণাটিকে ছিদ্র দিয়ে প্রবেশ করার সময় ‘দেখা’ করা হলেই দেখা যায় সেটা আর তরঙ্গের মতো বিন্যাস তৈরি করছে না।
এখন প্রশ্ন হলো কণার কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ক্ষেত্রে এখন এই অবজারভেশন বা পর্যবেক্ষণ ব্যাপারটা কী? এই পর্যবেক্ষণ বলতে কিন্তু চোখ দিয়ে দেখাটাকেই বোঝাচ্ছে না। এই অবজারভেশন হলো ওই ফোটন কণার সঙ্গে অন্য যেকোনো কিছুর ‘ইন্টারেকশন’ বা ‘ক্রিয়া’। মানে চলার পথে একটি ফোটন কণার সঙ্গে যদি আরেকটি ফোটন কণার ধাক্কা লাগে তবে সেটাও পর্যবেক্ষণ বা অবজারভেশন। আবার সেই ফোটনের ওপর যদি কোনো বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় বল প্রযুক্ত হয় তবে সেটাও অবজারভেশন-এর আওতায় পড়বে। এই অবজারভেশন মানেই যে ওই কণাটিকে কোনো মানুষের দেখতে হবে কিংবা কোনো ডিটেক্টরে ধরা পড়তে হবে তা নয়। এই অবজারভেশন মানে হলো কণার সঙ্গে মহাবিশ্বের অন্য যেকোনো শক্তির সংস্পর্শ। মানে কোনো কিছুর স্পর্শ (সেটা একটি নিউট্রিনো কণা বা শক্তিবলয় হতে পারে) ঘটলেই কণাটি ওই স্পর্শক কণা বা শক্তির দশার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয় ও একটি নির্দিষ্ট দশায় নিজেকে উপস্থাপন করে। যেটাকে বিশ্বাস করতে চাননি স্বয়ং আইনস্টাইন। তিনি তাই বলেছিলেন, চাঁদের দিকে না তাকালে চাঁদ কি তার জায়গায় থাকবে না?
কিন্তু সাব-অ্যাটমিক পার্টিকেলের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে সেটার দিকে কেউ না তাকালে (মানে কোনো কিছুর সঙ্গে ওটার ক্রিয়া না ঘটলে) সেই কণা নিজেও জানে না যে সে কোন দশায় আছে। এখানেই অনেক বিজ্ঞানী একমত, এখানেই আবার দ্বিমত। এই যে অবজারভেশন তথা কণার সঙ্গে অন্য একটা কিছুর ‘যোগাযোগ’ এটাকেও অনেকে বলছেন এক ধরনের ইলিউশন তথা প্রকৃতির খেয়ালিপনা। আমাদের ব্রেইন ও নিউরনও যে ধোঁয়াশার বাইরে নয়। আমাদের ব্রেইনও সব কিছুকে তার নিজের মতো করে একটি বোধগম্য দশায় দেখতে চায় বলেই ফোটন বা ইলেকট্রনরা একটি দশায় নিজেদের ধরা দেয়। আমাদের ব্রেইন যেভাবে বুঝতে পারবে সেভাবেই সে কণাকে আবিষ্কার করে। তাই আমরা কোনো একটি কণার দ্বৈত ধর্ম বা তরঙ্গায়িত দশাকে বুঝতে পারব না বলে সেভাবে আবিষ্কারও করি না।
তো, এই হলো অবজারভেশন। সংক্ষেপে বলতে গেলে একটি সাব-অ্যাটমিক কণার সঙ্গে মহবিশ্বের যেকোনো কিছু ক্রিয়া ঘটলেই সেটা ওই ক্রিয়াশীল কণার সাপেক্ষে নিজেকে একটি ও একক দশায় উপস্থাপন করে। আর আমরাও দেখি যে, কণাটি তখন তার তরঙ্গ ধর্ম ভেস্তে দেয় (যাকে বলে ওয়েভ ফাংশন কলাপস করা)।
আইনস্টাইন যে তত্ত্বটি মানতে চাননি, কোয়ান্টাম এনটেঙ্গলমেন্ট- সেটাও এখন প্রমাণিত সত্য। এ তত্ত্ব প্রমাণে কাজ করেই পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিন বিজ্ঞানী। তো সেই এনটেঙ্গল কণার ক্ষেত্রেও দেখা যায় অবজারভ করার পরই একটি কণা তার একটি দশা বা স্পিন প্রকাশ করছে এবং তার সঙ্গে জোড় বাঁধা কণাটি দূর দূরানেত্ থেকেও তার বিপরীত দশা (স্পিন) দেখাচ্ছে। অর্থাৎ অবজারভেশন বা পর্যবেক্ষণ যে আমাদের বোধগম্যতার পরিমণ্ডলে একটা বড় ব্যাপার, সেটা বেশ ভালোভাবেই প্রমাণিত।
পুনশ্চ: এই পর্যবেক্ষণ বা অবজারভেশন যেন কণার ওপর প্রভাব না ফেলতে পারে সেটা নিয়েও কিন্তু গবেষণা হচ্ছে। বিশেষ করে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের ক্ষেত্রে। কারণ কোয়ান্টাম কম্পিউটারের প্রাণ ভোমরা হলো ওই বিশেষ সুপারপজিশন (একইসঙ্গে দুই দশায় থাকা কণা)-এ থাকা কণা। ওই কণাটিকে কোনও ডিটেক্টর দিয়ে ‘দেখা’ হলে সেটা তার সুপারপজিশন হারিয়ে ফেলবে। তাই ডিটেক্টর দিয়ে বা কোনোভাবে ওই কোয়ান্টাম দশায় থাকা কণার অবস্থা পর্যবেক্ষণের পরও যাতে সেটা তার ‘অনিশ্চিত’ দশা না হারায় সেজন্য কোয়ান্টাম বিজ্ঞানের যে শাখায় কাজ চলছে সেটাকে বলা হচ্ছে কোয়ান্টাম জেনো ইফেক্ট।