শিশু-কিশোরদের বাতজ্বর
বারবার বাতজ্বরে আক্রান্ত হলে ৬০ থেকে ৯০ শতাংশ শিশু-কিশোরের হৃৎপিণ্ডের ভাল্ব নষ্ট হতে পারে বা অন্যান্য হৃদরোগ হতে পারে। তবে সঠিক সময়ে চিকিৎসা নিলে বাতজ্বর ভালো হয়। সতর্কতামূলক কিছু পদক্ষেপ নিলে তা প্রতিরোধও করা যায়। লিখেছেন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের শিশুরোগ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. প্রণব কুমার চৌধুরী
পাঁচ থেকে ১৫ বছর বয়সী শিশুদের স্ট্রেপটো গলা ব্যথা সন্দেহ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা করানো উচিত। এতে বাতজ্বর হওয়া থেকে শিশুরা রক্ষা পাবে
স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের স্ট্রেপটোকক্কাস নামক এক ধরনের বিশেষ শ্রেণির জীবাণু আক্রমণ করতে পারে। এর কারণে গলা ব্যথা, গিরা ব্যথা ও জ্বর হয়—যা বাতজ্বর নামে পরিচিত। সাধারণত এসব উপসর্গের চার বা পাঁচ সপ্তাহ পর বাতজ্বর দেখা দেয়। দুই-তিন সপ্তাহের মধ্যে কোনো চিকিৎসা না দিলেও মনে হয় যেন সেরে গেছে এবং কিছুদিন পর আবার দেখা দেয়।
কারণ
গ্রুপ ‘এ’ ব্যাকটেরিয়া হিমোলাইটিক স্ট্রেপটোকক্কাস কর্তৃক গলা ব্যথার পর ইমিউন প্রক্রিয়ায় হার্ট ও বিভিন্ন জয়েন্টে, কখনো বা কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র, চামড়া বা শরীরের অন্যান্য অংশের ক্ষতিসাধন হয়। তবে গলা ব্যথা হলেই বাতজ্বর হবে এমন ভাবা ঠিক নয়। কেননা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভাইরাসের কারণে গলা ব্যথা হয়ে থাকে। সাধারণ নিয়মে যে গলা ব্যথায় নাক ঝরে না, চোখ ঝরে না বা লাল হয় না, তার কারণ স্ট্রেপটো ব্যাকটেরিয়া। এ ছাড়া স্ট্রেপটো গলা ব্যথায় গলার পাশের গ্ল্যান্ড কিছুটা বড় পাওয়া যেতে পারে, যা ধরলে ব্যথা অনুভূত হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অবশ্য গলা ব্যথা নাও থাকতে পারে।
যাদের হয়
সাধারণত পাঁচ থেকে ১৫ বছর বয়সের ছেলে-মেয়েদের বাতজ্বর হয়ে থাকে। তবে এই বয়সসীমার চেয়ে বড় অথবা ছোটদেরও এ রোগ হতে পারে। ঘিঞ্জি, স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে থাকা শিশুদের মধ্যে এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। তবে বয়স ও পরিবেশের প্রভাবের বাইরে জেনেটিক কারণও আছে। একবার এ রোগ হলে বারবার এটি দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। শিশুদের বাইরে শিক্ষক, শিশুপরিচর্যাকারী ও স্বাস্থ্যকর্মীদেরও এ রোগে ভোগার ঝুঁকি থাকে। বিভিন্ন কারণে বাতজ্বর হতে পারে যেমন—
হৃদ্যন্ত্রের প্রদাহ (কার্ডাইটিস) : শিশুদের বাতজ্বরে সবচেয়ে মারাত্মক অসুবিধা এটি, যা ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ ক্ষেত্রে হতে পারে। এর ফলে যেসব উপসর্গ দেখা দিতে পারে সেগুলো হচ্ছে—শ্বাসকষ্ট হওয়া, বুক ধড়ফড় করা এবং পায়ের পাতা ফুলে যাওয়া, কখনো বা কোনোরূপ উপসর্গ ছাড়া অনেকটা গোপন ধরনের কার্ডাইটিসে শিশু আক্রান্ত হতে পারে।
গিরায় ব্যথা ও ফুলে যাওয়া (আর্থ্রাইটিস) : ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ বাতজ্বরের শিশুর এ লক্ষণ দেখা দিতে পারে। সচরাচর দুদিকের একই প্রকারের বড় বড় অস্থিসন্ধি যেমন—পায়ের গোড়ালি, হাঁটু, কনুই, হাতের কনুুই, হাতের কবজির গিরা ফুলে যায়। এ ছাড়া আরো বহু রোগের কারণে শিশুদের গিরায় ব্যথা বা ফোলা দেখা যায়।
লক্ষণ
♦ বাতজ্বরে জয়েন্টের ব্যথা এতটা বেশি থাকে যে শিশু তা স্পর্শ করতে দিতে চায় না।
♦ এক গিরার ব্যথা কমে এলে অন্য একটি গিরায় ব্যথার পরিমাণ বেড়ে যায়।
♦ কোনো চিকিৎসা না পেলেও দুই-তিন সপ্তাহের মধ্যে গিরা ব্যথা ও ফোলা নিজে নিজেই সেরে যায়।
♦ শিশুকে অ্যাসপিরিন বা এজাতীয় ওষুধ খাওয়ানোর ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গিরা ব্যথা ও ফোলার সম্পূর্ণ অবসান ঘটে। সে কারণে শিশুর গিরা ব্যথা বা গিরা ফোলা দেখা দিলে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞকে দেখানোর আগে অ্যাসপিরিন বা এজাতীয় ওষুধ শিশুকে খাওয়ানো উচিত নয়।
♦ নিয়ন্ত্রণহীন অঙ্গ সঞ্চালন (কোরিয়া), চামড়ার নিচে ছোট ছোট গুটি হওয়ার লক্ষণ (সাবকিউটেনিয়াস নডিউল), শরীরের বিভিন্ন অংশে লালচে দাগ (ইরিথেমা মার্জিনেটাম) থাকলে নিশ্চিতভাবে ধরে নিতে হবে শিশুটি বাতজ্বরে ভুগছে।
♦ বাতজ্বর হলে সচরাচর বেশি মাত্রায় বা তীব্র জ্বর হয় না।
রোগ নির্ণয়
কোনো একক রোগ লক্ষণ বা পরীক্ষা বাতজ্বর নির্ণয় নিশ্চিত করার জন্য যথেষ্ট নয়। কোনো শিশুকে পরীক্ষা করে যদি দুটি প্রধান লক্ষণ বা একটি প্রধান লক্ষণ পাওয়া যায়, তাহলে এই শিশুর বাতজ্বরে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। শিশুর বাতজ্বর নির্ণয়ের এই নিয়মকে জোনস প্রণীত নির্দেশিকা বলা হয়। বাতজ্বর রোগ নির্ণয়ে এখন পর্যন্ত এই নির্দেশিকা খুবই কার্যকর। থ্রোট সোয়াব কালচার করেও বোঝা যায়।
চিকিৎসা
শিশুর বাতজ্বর হলে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে প্রয়োজনে হাসপাতালে ভর্তি করে দ্রুত চিকিৎসা দেওয়া উচিত।
প্রাথমিক প্রতিরোধব্যবস্থা
সুনির্দিষ্ট প্রতিরোধক ওষুধ বা পেনিসিলিন গ্রহণের মাধ্যমে শিশুর বাতজ্বর ও বাতজ্বরজনিত হৃদরোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। এ জন্য পাঁচ থেকে ১৫ বছর বয়সের ছেলে-মেয়ের স্ট্রেপটো গলা ব্যথা সন্দেহ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা করানো হলে বাতজ্বর হওয়া থেকে শিশুকে রক্ষা করা সম্ভব। এই ব্যবস্থাকে প্রাথমিক প্রতিরোধক ব্যবস্থা বলে। এই ব্যবস্থায় গলা ব্যথা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাংসপেশিতে একটিমাত্র বেনজাথিন পেনিসিলিন ইনজেকশন (শিশুর ওজন ২৭ কেজির নিচে হলে ছয় লাখ ইউনিটের ও ২৭ কেজির বেশি হলে ১২ লাখ ইউনিটের) নিতে হবে। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে দিনে চারবার করে একটানা ১০ দিন পেনিসিলিন ট্যাবলেট সেবন করা যেতে পারে।
সেকেন্ডারি প্রতিরোধব্যবস্থা
যারা এক বা একাধিকবার বাতজ্বরে আক্রান্ত হয়েছে অথবা বাতজ্বরজনিত হৃদরোগে ভুগছে, তাদের জন্য এই ব্যবস্থা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই ব্যবস্থায় প্রতি তিন-চার সপ্তাহ অন্তর অন্তর একটি বেনজাথিন পেনিসিলিন ইনজেকশন নিতে হয়। বছরে দু-চারটা ইনজেকশন দিলে তেমন কাজ হয় না।
♦ যারা বাতজ্বরে আক্রান্ত হয়েছে কিন্তু হৃদযন্ত্রের ক্ষতি হয়নি, তাদের কমপক্ষে পাঁচ বছর এই প্রতিরোধক ব্যবস্থা নিতে হতে পারে। তবে ১৩ বছরের নিচের বয়সীদের ক্ষেত্রে তা ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত অবশ্যই গ্রহণীয়।
♦ বাতজ্বরজনিত হৃদরোগে আক্রান্ত হলে এ ধরনের চিকিৎসা দীর্ঘদিন যাবৎ বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে সারা জীবন গ্রহণ করতে হতে পারে।
খাদ্যপুষ্টি ও ব্যায়াম
যেসব শিশুর বাতজ্বর হয়ে গেছে, তাদের নিম্নলিখিত জীবনযাপন পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত—
♦ প্রতিদিন ৯ থেকে ১০ ঘণ্টা ঘুমানো উচিত।
♦ নিয়মিত খেলাধুলা করা ও মুক্ত পরিবেশে সময় কাটানো প্রয়োজন।
♦ প্রতিদিন দুপুরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়া উচিত।
♦ অন্যদের চেয়েও দাঁত, মুখ, কোনো ইনজেকশন বা ঠাণ্ডা লাগলে অধিক সতর্ক হওয়া উচিত।
♦ প্রচুর পরিমাণে শাকসবজি, ফল, মাছ, শস্যজাতীয় খাবার ইত্যাদি খাওয়া উচিত। চা, কফি এবং কোনো প্রকার টিনজাত খাবার ও বাইরের তৈরি খাবার খাওয়া উচিত নয়।
অভিভাবকদের জন্য পরামর্শ
মা-বাবা বা অভিভাবকরা সচেতন হলে শিশু-কিশোররা বাতজ্বরে আক্রান্ত হওয়া থেকে অনেকাংশেই রক্ষা পেতে পারে। এ জন্য—
♦ শিশুর জ্বর, গলা ব্যথা বা গিঁটে ব্যথা দেখা দেওয়া মাত্রই তাকে নিয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।
♦ শিশুকে একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর কিছু পরীক্ষার জন্য ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত।
♦ সুস্থ হয়ে যাওয়ার পর আবার শিশুর দুর্বলতা, ফ্যাকাসে বর্ণ ধারণ করা বা শিশুর শরীরের বৃদ্ধি ঠিকমতো না ঘটলে অবিলম্বে শিশুচিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত।