গোলাপবাগ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যাওয়ার জন্য গত মঙ্গলবার রাইড শেয়ারিং অ্যাপ পাঠাওয়ের মাধ্যমে মোটরসাইকেল ডাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাহফুজ আলম। মুঠোফোনে কথা বলে চালককে নির্ধারিত জায়গায় আসতে বলেন। কিন্তু কিছু সময় পর অ্যাপের দিকে তাকিয়ে হতবাক হয়ে যান তিনি। অ্যাপে দেখাচ্ছিল, মাহফুজের ডাকা মোটরসাইকেলটি তাঁকে নিয়ে গন্তব্যের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছে! এরই মধ্যে মাহফুজকে ওঠানোর নির্ধারিত স্থান অতিক্রম করে মোটরসাইকেলটি চলে গেছে তিন কিলোমিটার দূরে।
সম্প্রতি রাইড শেয়ারিংয়ের ক্ষেত্রে অভিযোগ উঠেছে, যাত্রীকে না নিয়েই রাইড শুরু করেন অনেক চালক। এই সময় চুক্তিতে অন্য যাত্রীকে পরিবহন করেন তাঁরা। এতে করে রাইড চালু করায় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও চুক্তিতে যাওয়া যাত্রী উভয়ের কাছ থেকেই টাকা পান চালকেরা। কিন্তু যে যাত্রী অ্যাপের মাধ্যমে গাড়ি কিংবা মোটরসাইকেল ডাকেন, তাঁকে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়।
রাইড চালু করার পর মোটরসাইকেল কোন দিকে যাচ্ছে তা দেখা যায় অ্যাপে থাকা গুগল ম্যাপে। মাহফুজ বলেন, ‘ম্যাপে দেখি, আমার গন্তব্যের স্থান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবর্তে বাইকটি যাচ্ছে খিলগাঁওয়ের দিকে। এরপর মুঠোফোনে চালকের সঙ্গে যোগাযোগ করি। চালক বলেন, “মুঠোফোনের পর্দায় ভুলে চাপ লেগে রাইড চালু হয়ে গেছে।” রাইড বাতিল করতে বললে তিনি বলেন, “এক্ষুনি দিচ্ছি।” এরপর মুঠোফোন বন্ধ করে দেন চালক।’
রাইড শেয়ারিং অ্যাপে রাইড চালু করা হলে চালক ছাড়া ব্যবহারকারী সেটি বাতিল করতে পারেন না। মাহফুজ বলেন, এ সময় সহায়তার জন্য রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানের হেল্প নম্বরে যোগাযোগ করলে সেখান থেকে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানের ফেসবুকের মেসেজ অপশনে কিংবা অ্যাপের সাপোর্ট অপশনে গিয়ে লিখিত আকারে অভিযোগ জানানো যাবে।
রাইড শেয়ারিং নিয়ে মাহফুজের মতো এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি মাঝেমধ্যে হতে হচ্ছে অনেক যাত্রীকে। এ বিষয়ে কয়েকজন চালকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাইড শেয়ারিংয়ের চালকদের একটি চক্র তৈরি হয়েছে, যারা অ্যাপের বাইরে চুক্তিতে যাত্রী পরিবহন করে। সে ক্ষেত্রে চালক বেশি ভাড়া পান। একই সময় তিনি যদি অ্যাপে অন্য কোনো ব্যবহারকারীর রাইড গ্রহণ করে সেটি চালু করে রাখেন, তাহলেও রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকেও টাকা পান। তবে রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে যেহেতু চালকের গতিবিধি নজরদারি করা হয় সে জন্য চালককে রাইড ডাকা যাত্রীর পিকআপ পয়েন্টে (যাত্রী ওঠানোর স্থান) যেতে হয়।
সানি আহমেদ নামের এক পাঠাও চালক বলেন, সম্প্রতি রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে প্রতিদিনই ছাড় (কুপন) দেওয়া হচ্ছে। কোনো ব্যবহারকারী যদি শাহবাগ মোড় থেকে ফার্মগেট বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত যান, তাহলে প্রায় দুই কিলোমিটারে তাঁর ভাড়া আসবে ৮০ টাকা। কিন্তু যাত্রীর যদি ৫০ শতাংশ ছাড় থাকে তাহলে তাঁকে প্রায় অর্ধেক ভাড়া দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে চালক মোট ভাড়ার বাকি অংশটি পাবেন রাইড শেয়ারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কাছে থেকে।
সানি বলেন, অসৎ চালকেরা এই সুযোগটিই নিচ্ছেন। রাইড চালু করে প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকেও নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা পাচ্ছেন আবার চুক্তিতে গিয়ে যাত্রীর কাছ থেকেও ভাড়ার সম্পূর্ণ টাকা পাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে যে যাত্রীর রাইডটি তিনি চালু করেছেন, তাঁকে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। যাত্রীর অভিযোগ না জানানো পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানও জানতে পারছে না চালক রাইড চালু করে কোন যাত্রীকে বাইকে উঠিয়েছেন।
এ বিষয়ে রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানগুলো অবশ্য বলছে, এমন অভিযোগ তারা সম্প্রতি পাচ্ছে। পাঠাও লিমিটেডের প্রধান বিপণন কর্মকর্তা নাবিলা মাহবুব বলেন, কারও সঙ্গে এমন ঘটলে হটলাইনে ফোন করে অভিযোগ জানানো উচিত। চুক্তিতে রাইড শেয়ারিংয়ের অভিযোগ এসেছে। যেসব চালক সম্পর্কে এমন অভিযোগ আছে, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে।
গতকাল বুধবার বিকেলে শাহবাগ মোড়ে গিয়ে দেখা যায়, বাস থামার জায়গায় মোটরসাইকেলসহ ভিড় করে আছেন রাইডাররা। কাছে যেতেই ডাকছেন, ‘কই যাবেন ভাই। মোটরসাইকেলে দ্রুত পৌঁছিয়ে দেব।’ সেখানে দাঁড়িয়ে রায়হান মাসুদ নামের এক যাত্রী বলেন, ‘রাইড শেয়ারিংকে প্রথম দিকে স্মার্ট ও ইতিবাচকই ভেবেছিলাম। কিন্তু ইদানীং এটি অনেকটা সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও রিকশার মতো হয়ে গেছে।’
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে এক উবার ব্যবহারকারী লিখেছেন, ‘উত্তর বাড্ডা যাওয়ার জন্য “উবার মোটো”তে রিকোয়েস্ট পাঠাই। কিন্তু চালক রিকোয়েস্ট গ্রহণ করে আমার কাছে না এসেই রাইড শুরু করেন। চালক আমাকে ফোনও করেননি এবং অনেক চেষ্টা করেও তাঁর নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়।’
চুক্তিতে রাইড শেয়ারিং ছাড়াও অভিযোগ আছে, অ্যাপে নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের। রাইড শেয়ারিং অ্যাপ ব্যবহারকারীদের বেশ কয়েকটি গ্রুপ আছে ফেসবুকে। বেশি ভাড়া দাবি করা এক চালকের আইডির ছবি দিয়ে উবার ইউজারস অব বাংলাদেশ নামের গ্রুপে এক অ্যাপ ব্যবহারকারী লিখেছেন, ‘রাত ১টার দিকে টেকনিক্যাল মোড় থেকে মোহাম্মদপুরের শাহজাহান রোডে যাওয়ার জন্য রাইড কল করলে চালক বলেন, ‘ভাইয়া, নাইট ট্রিপ, তাই ভাড়া বাড়ায়ে দিতে হইব। এটা বেআইনি জানালে চালক বলেন, তাইলে আমি যাইতে পারুম না, অন্য গাড়িতে যান।’
অথচ রাইড শেয়ারিং সার্ভিস নীতিমালা, ২০১৭ অনুযায়ী, রাইড শেয়ারিং অ্যাপের আওতায় চলাচল করা মোটর কারের ভাড়া ট্যাক্সিক্যাব সার্ভিস গাইডলাইন, ২০১০ নির্ধারিত ভাড়ার বেশি হবে না। এ ছাড়া নীতিমালার কোনো শর্ত না মেনে মালিক বা চালক কোনো কার্যক্রম পরিচালনা করলে সার্টিফিকেট বাতিলসহ দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান আছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের পরিচালক (প্রকৌশল) নূরুল ইসলাম বলছেন, অভিযোগের এই বিষয়গুলো খতিয়ে দেখেই রাইড শেয়ারিংয়ের অনুমতি চেয়ে আবেদন করা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সার্টিফিকেট দেওয়া হচ্ছে না। আর যাত্রীদের ভোগান্তি এড়াতে, ভ্রাম্যমাণ আদালতকে অবহিত করতে বলেন তিনি। গাড়ির নম্বরসহ অভিযোগ জানানো যাবে সংশ্লিষ্ট থানাতেও।