সালটা ১৯৭২। যুক্তরাষ্ট্রে তখন নির্বাচনের ডামাডোলে রাজনৈতিক ময়দান উত্তপ্ত উনুন। ভোটের মাঠে সুবিধা পেতে তখনকার রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন বিরোধী ডেমোক্রেটিক পার্টির কার্যালয়ে আড়ি পাতেন তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড জানতে। ঘটনাটি আমরা কমবেশি অনেকেই জানি। ক্ষমতা সুসংহত করতে নিক্সনের নেওয়া এই অবৈধ কর্মই যে তাঁকে গদিছাড়া করবে, তা হয়তো নিক্সন নিজেও ভাবতে পারেননি। তা না হলে কেউ কি নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারেন?
তবে আজকের লেখা যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি কিংবা ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির বিষয়ে নয়, সম্প্রতি ঘটে যাওয়া নৃশংস একটি হত্যাকাণ্ড নিয়ে। সেটা হলো সৌদি আরবের সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ড। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ওয়াশিংটন পোস্টে একটি নিবন্ধে এই হত্যাকাণ্ডকে ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি কিংবা নাইন–ইলেভেনের সন্ত্রাসী হামলার চেয়ে কোনো অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয় বলে মন্তব্য করেছেন। এরদোয়ানের মন্তব্য অনেকে গ্রহণ করতে পারেন, আবার নাও পারেন, সেটা তাঁদের বিষয়। তবে এ কথা সবাইকে এক বাক্যে মেনে নিতেই হবে যে খাসোগিকে হত্যা স্মরণকালের সবচেয়ে জঘন্য হত্যাকাণ্ডের একটি। এটি মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে প্রভাব ফেলতে পারে।
একসময়ে সৌদি আরবের রাজপরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল জামাল খাসোগির পরিবারের। বলতে গেলে দহরম-মহরম। খাসোগির দাদা ছিলেন সৌদি রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল আজিজ আল সৌদের ব্যক্তিগত চিকিৎসক। দাদার সুবাদেই রাজপরিবারে খাসোগির বিচরণ। এ কারণেই সৌদি রাজপরিবারের হাঁড়ির খবর জানতেন খাসোগি। বলা হয়ে থাকে, খাসোগি রাজপরিবারের বাইরে থাকা একমাত্র ব্যক্তি ছিলেন, যিনি আল-কায়েদার টুইন টাওয়ার হামলা নিয়ে সৌদি রাজপরিবারের সংশ্লিষ্টতার ব্যাপারগুলো জানতেন। একসময় রাজপরিবারের প্রতি মোহ কাটতে থাকে তাঁর। সংক্ষেপে এমবিএস নামে পরিচিত মোহাম্মদ বিন সালমান যুবরাজ হওয়ার পর সৌদি রাজপরিবারকে একটা ‘বিষোদ্গার কেন্দ্র’ বলে মনে হতে থাকে খাসোগির কাছে। সৌদিতে সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে যুবরাজ সালমান দেশকে সামনের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন বলে প্রচার রয়েছে। তবে খাসোগির লেখায় এর বিপরীত চিত্রই ফুটে উঠত। যুবরাজ সালমান ক্ষমতা সুসংহত করতে বাক্স্বাধীনতার গলা টিপে ধরা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ, প্রতিপক্ষকে কুটচালে ঘায়েল করাসহ নানা সমালোচনামূলক মন্তব্য উঠে আসত খাসোগির লেখায়। এ কারণেই সৌদি রাজপরিবারের, বিশেষ করে যুবরাজ সালমানের রোষানলে পড়েন এই সাংবাদিক। সৌদির নামকরা অনেক পত্রিকায় গুরুত্বপূর্ণ পদে গিয়েও সেখানে টিকে থাকতে পারেননি হয়তো রাজপরিবারের বিরাগভাজনের কারণেই। খাসোগি পা-চাটা, ধামাধরা সাংবাদিকতা করেননি। তিনি সৌদিতে বাক্স্বাধীনতা, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও প্রকৃত গণতান্ত্রিক অবস্থা চেয়েছিলেন। শেষমেশ ক্ষমতাধরদের সঙ্গে লড়াইয়ে টিকতে না পেরে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। গিয়ে ওঠেন যুক্তরাষ্ট্র।
জীবিত থাকাকালে যে শাসকদের ক্ষমতার ভিত কাঁপাতে পারেননি, মৃত খাসোগি এখন তাঁদের গদিছাড়া করলে তাতে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। সেই আলামতই একটু একটু করে ভেসে উঠছে সৌদির রাজপরিবারের ছায়াপটে।
গত ২ অক্টোবর তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি আরবের কনস্যুলেটে খাসোগি একদল সৌদি নাগরিকের হাতে খুন হন। সৌদি সরকার এই হত্যাকাণ্ডকে বিপথগামী কিছু কর্মকর্তার ‘অত্যুৎসাহী কর্মকাণ্ড’ বলে বিষয়টিতে নিজেদের দায় এড়ানো চেষ্টা করেছে। তবে সৌদি আরবের এই দায় এড়ানোর চেষ্টাকে আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়ার মতো কাজ বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। খাসোগি হত্যার ঘটনায় যুবরাজ সালমানের ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা সৌদ আল-কাহতানির ওপর দায় চাপিয়ে তাঁকে বরখাস্ত করেছে সৌদি সরকার। তবে এটা বলতেই হয়, প্রভুর সবুজ সংকেত ছাড়া ভৃত্যের জন্য এত বড় মিশন সম্পন্ন করা সম্ভব নয়।
খাসোগি হত্যায় ঘটনায় যুবরাজ সালমান জড়িত থাকুন আর না-ই থাকুন, এই ঘটনা তাঁর ভাবমূর্তিতে যে কালিমা লেপন করেছে, তা এক বাক্যে সবাই মেনে নেবেন। আর এই কালিমা যতটা ছড়িয়ে যাবে, যুবরাজের পদ ততই নড়বড়ে হয়ে পড়বে। এরই মধ্যে কিছু ঘটনায় সেটা প্রতীয়মানও হতে শুরু করেছে। রাজপরিবার, তথা পুরো সৌদিতে যুবরাজ সালমানের একচ্ছত্র প্রভাব যে কমে আসছে, সেটার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে কিছু পরিবর্তনে। বিবিসির ফ্রাংক গার্ডনার লিখেছেন, সৌদি রাজপরিবারে অন্দরমহলে, বন্ধ দরজার ওপাশে এখন এ প্রশ্নগুলো নিয়ে অত্যন্ত গুরুতর আলোচনা চলছে। আর তার আভাসও মিলছে কয়েকটি ঘটনার মাধ্যমে।
৮২ বছর বয়সী বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ আল-সৌদের একমাত্র জীবিত ভাই প্রিন্স আহমেদ বিন আবদেল আজিজ সম্প্রতি হঠাৎ করেই রিয়াদে ফিরেছেন। তিনি লন্ডনে নির্বাসিত জীবনযাপন করে আসছিলেন এত দিন। বাদশাহ সালমান ও তাঁর ছেলে যুবরাজ সালমান বিন মোহাম্মদের ইয়েমেনের যুদ্ধসহ বিভিন্ন নীতির ঘোরবিরোধী প্রিন্স আহমেদ। এ ছাড়া সৌদি রাজপরিবারের ধনকুবের প্রিন্স ওয়ালিদ বিন তালালের ভাই প্রিন্স খালেদ বিন তালাল বন্দী অবস্থা থেকে সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছেন। দুর্নীতির অভিযোগে তালালকেও বন্দী করেছিল যুবরাজ সালমানের প্রশাসন। পরে সমঝোতার ভিত্তিতে তালাল মুক্তি পান। খালেদকে বন্দী করা হয়েছিল সৌদি বাদশাহ ও যুবরাজের নীতির কট্টর সমালোচক হওয়ার কারণে। দুই ভাইয়ের মধ্যে সাক্ষাৎও নিষিদ্ধ ছিল। তাই প্রিন্স খালেদের মুক্তি এবং প্রিন্স আহমেদের দেশে প্রত্যাবর্তনে আভাস মেলে, যুবরাজ সালমানের সাম্রাজ্যের একক আধিপত্যের ইতি ঘটতে চলেছে।
এখন আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, খাসোগি হত্যার ঘটনায় যুবরাজ সালমানের চূড়ান্ত পতন ঘটবে না ঠিকই, কিন্তু তাঁকে এর ক্ষত বয়ে নিয়ে বেড়াতে হবে অনেক দিন। যুবরাজের পতন না হওয়ার আরেকটি কারণ হতে পারে তাঁর প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অতিরিক্ত মোহ। সেই মোহ অবশ্যই নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্যই। বন্ধু ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের জন্য ক্রমবর্ধমান শক্তিশালী হয়ে ওঠা হুমকি ইরানকে শায়েস্তা করতে সৌদি আরবের সমর্থন যে খুবই দরকার ট্রাম্প প্রশাসনের। ইরানের বিরুদ্ধে কঠোর নীতি প্রয়োগ রাখার একনিষ্ঠ সমর্থক যুবরাজ সালমানও। আর সে কারণেই হয়তো যুবরাজ সালমানকে বিপদের ‘পুলসিরাত’ পার করানোর বাহক হতে পারেন ট্রাম্প।
লেখক কামরুজ্জামান: সহসম্পাদক, প্রথম আলো
সূত্র : প্রথম আলো