Monday, December 23
Shadow

দৃষ্টিহীনের জন্য থার্ড আই

নবম শ্রেণিতে থাকতেই সন্ত্রাসীর ছোড়া এসিডে দগ্ধ হয়ে দৃষ্টিশক্তি হারান মাসুদা আক্তার মণি। তিনি এখন দেখতে পান না দেশ-মাটি, গাছ-পাখি, শরৎ-বসন্ত। তবে একটা জিনিস দেখেন ঠিকই— স্বপ্ন। আর সেই স্বপ্ন পূরণের সারথী হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে ওঠে সংগঠন থার্ড আই। জানাচ্ছেন কালবেলা’র চবি প্রতিনিধি রেদওয়ান আহমদ

নানা বাধা পেরিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগে ভর্তি হতে পেরেছেন মণি। কিন্তু চিন্তা তো যায় না। কীভাবে পার করবেন বিশ্ববিদ্যালয় জীবন? তখনই মণির পাশে দাঁড়াল ‘থার্ড আই’ টিম। শ্রুতিলেখক হিসেবে লিখে দেওয়া এবং পাঠ্য রেকর্ড করে দেওয়াসহ বিভিন্নভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিল সংগঠনটি। এরপর মণিকে আর পিছু হটতে হয়নি একদমই।

আংশিক বা পুরোপুরি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাজ করে সংগঠনটি।

‘শেয়ার দ্য রেসপনসিবিলিটিস’ প্রতিপাদ্যে ২০১৯ সালের ১৬ জানুয়ারি মাসরুর ইশরাকের নেতৃত্বে আট স্বেচ্ছাসেবী শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করে ‘থার্ড আই’। এখন দেশের পাঁচটি জেলায় প্রায় ৬০০ ভলান্টিয়ারের মাধ্যমে সেবা দিচ্ছে তারুণ্যে ভরপুর সংগঠনটি। এখন তাদের ঝুড়িতে আছে ‘জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড’-এর মতো নামি পুরস্কার।

২০১৯ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মাসরুর ইশরাক দেখলেন, বছর শেষে সবাই যখন পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত, তখনো দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা তাদের পাঠ্য রেকর্ড করানো, শ্রুতিলেখক খোঁজায় পার করছেন সময়। এতে পড়ার সময় নষ্ট হয়। মনোযোগও থাকে না। মাসরুর খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন, ওই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা প্রতিবছরই এমন সমস্যায় পড়েন। এটা দেখেই থার্ড আই গড়ার চিন্তা আসে তার।

ওই সময় শুধু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের কথা মাথায় রেখে তৈরি হলেও পরে ঢাকা, রাজশাহী, ফেনী ও যশোর এলাকায় এর বিস্তার ঘটে।

থার্ড আই যা করে

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের বিভাগীয় পড়াগুলো বিভিন্ন পাঠ্য-পুস্তক বা শিট থেকে সংগ্রহ করে তা রেকর্ড করে দেওয়া এ সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবীদের অন্যতম কাজ। শ্রুতিলেখক হিসেবে পরীক্ষায় লিখে দেওয়া এবং দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মশালা, সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করে থাকে।

সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান সমন্বয়ক মাসরুর ইশরাক বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড ও এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ অর্জনে বাংলাদেশকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। ওই সময় দেশের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৬০ শতাংশ লোক কর্মক্ষম হবে। তাদের মধ্যে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরাও আছেন। আমাদের লক্ষ্য ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সময় অর্থাৎ ২০২৭ বা ২৮ সাল নাগাদ বাংলাদেশের শিক্ষিত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের কর্মোপযোগী করে গড়ে তোলা।’

তিনি আরও বলেন, ‘২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে আমরা এমনভাবে দেখতে চাই যেখানে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি আট-দশটা স্বাভাবিক মানুষের মতোই থাকবে। পিছিয়ে থাকবে না।’

এ ছাড়া সংগঠনটি প্রতিবন্ধীসহ ভলান্টিয়ারদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রতিষ্ঠা করেছে ‘থার্ড আই হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট’। এর মাধ্যমে তারা পড়ালেখার পাশাপাশি বিতর্ক, কম্পিউটার, ব্রেইল, স্পোকেন ইংলিশ এবং শুদ্ধ উচ্চারণ ও আবৃত্তির বিনামূল্যে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে।

ইতোমধ্যেই অলাভজনক এ সংগঠন ‘জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড ২০২১’ অর্জন করেছে। সংগঠনটির ইচ্ছে, বাংলাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাজ করা।

ডিজেবল স্টুডেন্ট সোসাইটি অব চিটাগং ইউনিভার্সিটির (ডিসকু) সদস্য চবির রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থী মো. শিহাব উদ্দিন ভূঁইয়া কালবেলাকে বলেন, ‘সংগঠনটি বিনামূল্যে আমাদের লেখাপড়ার সামগ্রিক বিষয় নিয়ে কাজ করে। তারা বিভিন্ন নোট করে দেয়, পাঠ্য রেকর্ড করে দেয়, শ্রুতিলেখক হিসেবে পরীক্ষায় লিখে দেয়। এমনকি তারা আমাদের নিয়ে আড্ডা দেয়, বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করে। এ ছাড়া আমাদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়েও কাজ করে।’

তিনি আরও বলেন, ‘একসময় ক্যাম্পাসে পড়া রেকর্ড করে দেওয়া বা নোট করে দেওয়ার মানুষ পেতাম না। শ্রুতিলেখক পাওয়া ছিল আরও কঠিন। থার্ড আই আসার পর আমাদের কষ্ট লাঘব হতে শুরু করেছে। ওরাই এখন আমাদের তৃতীয় চোখ।’

সংগঠনটি সম্পর্কে এর উপদেষ্টা এবং চবি সমাজতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. হানিফ মিয়া বলেন, “অন্ধজনে আলো সঞ্চারিতে ‘থার্ড আই’র প্রচেষ্টা। একটি মানবিক বোধের জায়গা থেকে সংগঠনটি তার তৃতীয়-নয়ন হয়ে অন্ধকার বিদূরিত করার অভিপ্রায়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যেই আমরা একটি ওয়েবসাইট তৈরি করেছি, যেখান থেকে প্রতিনিয়ত তাদের সেবা প্রদান করা হচ্ছে। একটি আন্তর্জাতিক অ্যাওয়ার্ডের জন্য ইতোমধ্যে আমরা আবেদন করেছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের মধ্যে আরোগ্যসাধ্য ও অনারোগ্যসাধ্য উভয়ই আছে। আমরা এখন এমন কোনো চিকিৎসা সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছি, যারা নিখরচায় এই ছেলেমেয়েদের চিকিৎসা দেবে। এমন সুযোগ পেলে আমাদের ৩০-৫০ শতাংশ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী আলোর মুখ দেখবে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!