নাজিম উদ দৌলার স্ট্যাটাস থেকে।
যদি আমার ভুল না হয়ে থাকে তাহলে যে ব্যক্তির কাঁধে ভর দিয়ে নেমে আসছেন বেঁচে থাকার আনন্দে কাঁদতে থাকা একজন নারী, তার নাম খন্দকার আব্দুল জলিল। তিনি বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এর ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর। একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হওয়া সত্ত্বেও যেভাবে তিনি সাধারণ কর্মীদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে উদ্ধার কাজে লেগে যান, সেটা সত্যিই অবিশ্বাস্য। সৌভাগ্যক্রমে তার সাথে গত বছরের ডিসেম্বর মাসে কথা বলার সুযোগ হয়েছিলো আমার।
আপনারা হয়তো জানেন ২০১৪ সালে জিয়াদ নামে একটি শিশুর পরিত্যক্ত পাইপের গর্তের ভেতর পড়ে যাওয়ার ঘটনাটির উপর বেইজ করে একটি মুভি নির্মিত হতে যাচ্ছে, যার স্ক্রিপ্ট আমি লিখেছি। তো এই স্ক্রিপ্ট লেখার জন্যই উদ্ধার কাজের সাথে জড়িত ছিলেন এমন একজনের সাথে কথা বলা প্রয়োজন হয়েছিলো। অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে ফায়ার সার্ভিসের হেডকোয়ার্টারে গিয়েছিলাম খন্দকার আব্দুল জলিল ভাইয়ের সাথে দেখা করতে। তিনি রানা প্লাজা ধ্বসে পড়া, নিমতলী অগ্নিকান্ডের মতো ভয়ংকর বেশ কিছু দুর্ঘটনার সময় দমকল বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। খন্দকার জলিল ভাইয়ের মুখ থেকে এমন কিছু বিষয় সেদিন জেনেছিলাম যা বাংলাদেশের দমকল কর্মীদের সম্পর্কে আমার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছে।
বিভিন্ন কথার মধ্যে আমি সরাসরি তাকে প্রশ্ন করেছিলাম- “ভাই, যেকোনো দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির জন্য মানুষ দমকল বাহিনীর অদক্ষতাকে দায়ী করে। এই বিষয়ে আপনার মতামত কি?” উনি অকপটে সেদিন বলেছিলেন- “দক্ষতার অভাব আছে মানি, কিন্তু আন্তরিকতার কোন অভাব নেই”। দমকল বাহিনীর মূলমন্ত্র হচ্ছে- সেভ ইউরসেলফ ফার্স্ট, দেন সেভ আদারস। কিন্তু প্রায় প্রতিটি দূর্ঘটনায় বাংলাদেশের ফায়ার ফাইটাররা এই নিয়ম ভেঙে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষকে বাঁচানোর প্রচেষ্টায় নামে। এই জন্য তারা কোন বাড়তি বেতন, বোনাস কিংবা সম্মাননা- কিছুই পায় না। তাই বলে চেষ্টার ত্রুটি রাখে না। ধরেন আগুন লাগা একটা ঘরের ভেতর একজন ব্যক্তি আটকা পড়েছে, আগুন উপেক্ষা করে তাকে বাঁচাতে গেলে নিজের মৃত্যুর সম্ভাবনা প্রবল। এই অবস্থায় যদি ফায়ার ফাইটারদের জিজ্ঞেস করা হয়, ‘কে যেতে চাও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে?’ অন্তত ১০০ জওয়ান হাত তুলে এগিয়ে আসবে। তখন মুশকিল হয়ে যায়- কাকে রেখে কাকে পাঠানো হবে ভেতরে? রানা প্লাজায় উদ্ধার কাজ পরিচালনার সময় এই রকম সিচুয়েশন অন্তত ২০ বার হয়েছে। এ পর্যন্ত আগুন লাগার ঘটনায় আটকে পড়া ব্যক্তিকে উদ্ধার করতে গিয়ে দমকল সদস্যদের হতাহত হওয়ার ঘটনাও কম ঘটেনি। শুধু তাই নয়, চোখের সামনে মানুষকে মরতে দেখে শক খেয়ে পাগল হয়ে গেছেন অনেকেই। অনেকে আবার পোষ্ট ট্রামাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার(PTSD)-এ ভুগে চাকরী থেকে অব্যাহতি নিতে বাধ্য হয়েছেন। উনি নিজেও রানা প্লাজায় উদ্ধার অভিযান শেষে বেশ কয়েক মাস ঠিক মতো খেতে পারেন নি, ঘুম তো আসতোই না। ফায়ার সার্ভিসের এমন সব সাহসিকতার গল্প সেদিন শুনেছি তার কাছে যা দিয়ে অজস্র গল্প-উপন্যাস, নাটক, সিনেমা হওয়া সম্ভব!
“অনেক সময় আগুন লাগার ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস পৌঁছাতে বেশ সময় নেয় বলে অভিযোগ শোনা যায়। এর কারন কি?”- আমি ভেবেছিলাম এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি ঢাকার ট্রাফিক জ্যামকে দায়ী করবেন। কিন্তু তিনি তা করলেন না! তিনি বললেন, “ট্রাফিক জ্যাম তো এখানে নতুন কিছু না, আমরা এটা মাথায় রেখেই কাজ করি”। যেকোনো দূর্ঘটনা ঘটলে তারা সর্বোচ্চ এক মিনিটের মধ্যেই বেরিয়ে পড়ে। আর দমকলের গাড়ি রাস্তায় বের হলে সব গাড়ি সাইড হয়ে তাদের যাওয়া ব্যবস্থা করে দেয়। রাস্তায় জ্যাম তো থাকবেই, কিন্তু তাতে ১০-১৫ মিনিটের বেশি লেট হয় না। কিন্তু দেরি হয় প্রথমত- উৎসুক জনতার কারণে। কোথাও আগুন লাগলে চারিদিকে দেখা যায় সাধারণ মানুষের উপচে পড়া ভিড়। সবাই হা করে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে, মোবাইলে ভিডিও করছে। এসব কারণে ঘটনাস্থলের কাছাকাছি পৌঁছেও দমকলের গাড়ি ভেতরে ঢুকতে অনেকটা সময় নষ্ট হয়। আর দ্বিতীয়ত হচ্ছে- ফায়ার সার্ভিস পৌঁছেই কার্যক্রম শুরু করতে পারে না। তাদের প্রথমে জায়াগাটি পর্যবেক্ষণ করতে হয়, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে হয়, কোথায় কোথায় ল্যাডার বসাবে সেটা ঠিক করতে হয়, হোস পাইপ বিছাতে হয়। তারপর ফায়ার ফাইটিং শুরু হয়। আর উদ্ধার প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য বিল্ডিং এর নকশা জোগাড় করার চেষ্টা করে তারা, ভেতরে ঢোকার সিস্টেম খোঁজে এবং আদৌ ঢোকা সম্ভব কিনা সেটা চেক করে। এসব কাজে খানিকটা তো সময় লাগবেই। র্যান্ডম উদ্ধার কাজ শুরু করলে খামাখা রিসোর্স নষ্ট হবে, তাই প্ল্যান ছাড়া তারা কাজে নামতে পারেন না।
আর একটা প্রশ্ন করেছিলাম- “প্রযুক্তির দিক থেকে আমরা পিছিয়ে থাকার কারণেই কি দূর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি বেশি হচ্ছে বলে মনে করেন? জবাবে উনি জানালেন- খানিকটা তো অবশ্যই দায়ী, কিন্তু এটা অবাক হওয়ার মতো কিছু না। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সেবাখাতের মতো গুরুত্বপূর্ন জায়গাগুলোতে যেখানে আমরা প্রযুক্তিতে উন্নত দেশগুলোর তুলনায় যোজন যোজন পিছিয়ে আছি- সেখানে ফায়ার ফাইটিং প্রযুক্তিতেও পিছয়ে থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই সব ক্ষেত্রে প্রযুক্তি থাকলেই যে সমাধান হয়ে যাবে তা নয়। তিনি উদাহারন স্বরূপ দুই বছর আগে লন্ডনের নর্থ কেনসিংটন এর একটা ২৪-২৫ তালা বিল্ডিং-এ আগুন লাগার ঘটনার কথা উল্লেখ করলেন। সেই ঘটনায় অন্তত ৭০ জন আগুনে পুড়ে মারা যায়। পৃথিবীর সর্বাধুনিক প্রযুক্তি থাকার পরেও লন্ডন ফায়ার সার্ভিসের দুই দিনের বেশি লেগেছিলো আগুন সম্পূর্ণ নিভাতে। আর বাংলাদেশে একটা দূর্ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা ম্যাজিক্যালি সবাইকে সেইভ করতে পারবে- এটা ভাবা ভুল হবে।
“বাংলাদেশের ফায়ার সার্ভিসের মূল সমস্যা কি মনে করেন?”- এই প্রশ্নের জবাবে তিনি স্পষ্ট বলে দিলেন, এই সেক্টরে আরও অনেক মেধাবী লোকের প্রয়োজন। সাহসের অভাব আমাদের নেই, কিন্তু মাথা ঠান্ডা রেখে যেকোনো পরিস্থিতিতে ইন্সট্যান্ট সিদ্ধান্ত নিতে পারে- এমন লোকের খুব দরকার। এখানে সিদ্ধান্ত নিতে এক মিনিট দেরি হলেই কিছু প্রাণ যেমন ঝরে যেতে পারে, আবার ত্বরিত সিদ্ধান্ত বাঁচাতে পারে অনেককেই। কিন্তু মেধাবীদের মধ্যে যারা প্রসাশনে আসতে চায়, তাদের সবার লক্ষ থাকে পুলিশ কিংবা সেনাবাহিনী। যদি বলা হয় একই বেতন ও সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে, তারপরও মানুষ দমকল এভয়েড করতে চাইবে। সরকারের যতো পদাতিক বাহিনী আছে, সবাইকে অস্ত্র চালনার ট্রেনিং দেওয়া হয় অর্থাৎ মানুষ খুন করার জন্য দক্ষ করা হয়। একমাত্র ফায়ার সার্ভিসকে ট্রেনিং দেওয়া হয় মানুষকে বাঁচানোর জন্য। অথচ মানুষের জীবন বাঁচানোর মতো একটা মহান দায়িত্ব কাঁধে নেওয়ার ব্যাপারে কারো আগ্রহ নেই। তরুণদের এই মেন্টালিটির পরিবর্তন না আসলে দমকলের কাছ থেকে এক্সট্রা অর্ডিনারি কিছু আশা করা ঠিক হবে না।
সব কথার শেষ কথা হলো- ঘটনাস্থলে না গিয়ে ঘরে বসে ফেসবুকে লাইভ আর টিভিতে নিউজ দেখে জ্ঞানের বাহার দেখানো সহজ, কিন্তু বাস্তবতা খুব কঠিন। ফায়ার ফাইটারদের গালাগালি করার মাধ্যমে আপনি নিজেকে বিশেষজ্ঞ নয়, আহাম্মক প্রমান করছেন। ভার্চুয়ালি গালাগালি করেন, তাও ভালো। কিন্তু গতকাল ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি আসার পর সাধারণ মানুষ তাদের উপর হামলা করেছে! মানুষ কতোটা নির্লজ্জ হলে এমন একটা কাজ করে? ভাই, আপনি চোখের সামনে যা দেখতে পান তার বাইরেও অনেক কিছু থাকে। মাথা গরম না করে, মাথাটা একটু খাটানোর চেষ্টা করেন, তাহলেই সমাধানের রাস্তা পাওয়া যাবে!