সানজিদা জান্নাত পিংকি
দীর্ঘশ্বাসে জমে থাকা প্রতীক্ষার বোঝা নামল। দীর্ঘ ১১ বছর পেরিয়ে, অবশেষে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তনের ঢেউ আছড়ে পড়েছে! ক্যাম্পাসের প্রতিটি ইট-পাথরে যেন বিদ্যুত্স্পৃষ্ট আবেগের শিহরণ। দীর্ঘ অপেক্ষার পর শিক্ষার্থীরা তাঁদের গর্বের ডিগ্রি হাতে নিচ্ছেন, আর সঙ্গে ফিরছে পুরনো দিনের বুনো উচ্ছ্বাস, হাসি আর আনন্দাশ্রু।

কত শত ব্যাচ পেরিয়ে গেছে, কিন্তু সমাবর্তনের ডাক আসেনি। অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, যে মুহূর্তের জন্য প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা বুক বাঁধেন, যে দিনটির স্বপ্নে বিভোর ছিলেন হাজারো গ্র্যাজুয়েট, সেটিই ফিরে এলো গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায়। এই ক্যাম্পাসে হাজারো স্বপ্নের বীজ বোনা হয়েছিল, আজ তার পূর্ণতা পেতে চলেছে। কিন্তু এ কি শুধু একটি ডিগ্রির আনুষ্ঠানিকতা? না, এটি তার চেয়েও বহুগুণ বেশি—এ এক আবেগের বিস্ফোরণ, স্মৃতির জোয়ার, জীবনযুদ্ধের এক নতুন মাইলফলক।
বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডোর, বাদামতলা, আমবাগান, নানীর টং, লেকপাড়, ক্লাসরুম—যেন শত শত পায়ের শব্দে কেঁপে উঠছে। এক দশক পর পুরোনো বন্ধুদের দেখা পাওয়ার উত্তেজনা, শিক্ষকদের কাছে গিয়ে সেই পুরোনো হাস্যরসের মুহূর্ত খুঁজে নেওয়া, সবকিছুই যেন এক বিস্ময়কর বাস্তবতায় রূপ নিচ্ছে। ক্যাম্পাস যেন ফিরে গেছে অতীতে—সেই দিনগুলো, যখন ক্লাস ফাঁকি দিয়ে গল্পগুজব হতো, পরীক্ষার আগের রাতে পড়ার টেবিলে হাহাকার চলত, একসঙ্গে স্বপ্ন দেখার দিনগুলো ফিরে এসেছে নতুন রঙে।
আনন্দে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ছেন গ্র্যাজুয়েটরা।

তারা জানান, দীর্ঘ সময় পর এই সমাবর্তন আয়োজিত হয়েছে। অনেক আলোচনা সমালোচনা থাকলেও অবশেষে সমাবর্তনে অংশগ্রহণ করার সুযোগ হচ্ছে। বহুদিন পর সবাই আবার একত্রিত হচ্ছে এটা এক আনন্দঘন মুহুর্ত।
ক্যাম্পাসের বাতাসে আজ অন্যরকম ঘ্রাণ, যেন আনন্দ আর বেদনার মিশেল! পুরো ক্যাম্পাস সেজেছে উৎসবের সাজে—বর্ণিল আলোকসজ্জা, ব্যানার, ক্যামেরার ক্লিক, প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর এক প্রজন্মের উদযাপন। হাসির রোল, আনন্দের স্রোত, কিন্তু এর মাঝেই কোথাও কোথাও বিষাদের সুর। কারণ, সমাবর্তন মানেই তো বিদায়ের ঘণ্টাধ্বনি!
প্রিয় করিডোর, পরিচিত ক্লাসরুম, লাইব্রেরির নিরবতা—সব ছেড়ে যেতে হবে! এই অনুভূতি বুকে এক অদ্ভুত শূন্যতা তৈরি করে। কিছুদিন পর এই বন্ধুদের সঙ্গে আর প্রতিদিন দেখা হবে না, লেকপাড়ে বসে জীবনের স্বপ্ন বুনতে বুনতে রাত কাটবে না, নির্ঘুম রাতের সে পড়াশোনা আর ক্লান্ত দুপুরের আড্ডা থাকবে শুধুই স্মৃতির খাতায়। একে একে বিদায় নিচ্ছেন সবাই, কেউবা জড়িয়ে ধরছেন একে অপরকে, কেউ আবার শেষবারের মতো ক্যাম্পাসের চত্বর ছুঁয়ে দেখছেন, যেন অনুভূতিটুকু বুকে জমিয়ে রাখতে চান।
তীব্র রোদে বাবা-মা স্টেজের বাইরে বসে সন্তানের স্বপ্নপূরণের দৃশ্য দেখছেন। ক্লান্ত শরীর, কিন্তু চোখে আনন্দের অশ্রু। এক মা সন্তানের গাউন ঠিক করে দিচ্ছেন, এক বাবা ক্যামেরা হাতে ধরে রাখছেন স্মৃতির মুহূর্ত। অনেকে সনদ নিতে এসেছেন তাঁদের স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে। ছোট শিশুরা বাবার বা মায়ের গাউন ধরে টানছে, কেউবা খেলছে ক্যাম্পাসের লনে। পুরো ক্যাম্পাস জুড়ে গাউন আর হ্যাট পরা গ্র্যাজুয়েটরা ঘুরছে, টুপি আকাশে উড়াচ্ছে, ছবি তুলছে, সেলফি নিচ্ছে, হাসছে, কাঁদছে।
তবে বিদায় মানেই তো শেষ নয়! বিদায় মানে তো নতুন শুরুর বার্তা। গণ বিশ্ববিদ্যালয় তাদের যে শিক্ষা, যে সাহস, যে স্বপ্ন দিয়েছে, তা নিয়ে এগিয়ে যাবে প্রতিটি শিক্ষার্থী। এ ক্যাম্পাসের আলোয় আলোকিত হয়ে তাঁরা একেকজন সমাজের আলোকবর্তিকা হবেন।
সমাবর্তনের এই উচ্ছ্বাস, এই আনন্দ, এই নস্টালজিয়া কখনো ফিকে হবে না। এক দশকের অপেক্ষার পর যে উৎসব ফিরে এসেছে, তা ইতিহাস হয়ে থাকবে। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ—সব এক মোহনায় মিলেছে আজ। এই দিনে প্রাণভরে হেসেছে হৃদয়, অশ্রু হয়ে ঝরেছে অনুভূতি, আর গেয়েছে সাফল্যের গান!
লেখা: শিক্ষার্থী ও সংবাদকর্মী, গণ বিশ্ববিদ্যালয়।