Saturday, December 21
Shadow

পিজির ডাক্তার জেবুন নেসার পরামর্শ : শিশুর দাঁতের যত্ন

শিশুর দাঁতের যত্নশিশুর দাঁতের যত্ন

শিশুর দাঁত ওঠার পর থেকেই দরকার সঠিক যত্নের। কিন্তু অনেকেই এ সম্পর্কে অবগত নন। শিশুর দুধদাঁতের যত্ন বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পেডোডন্টিকস বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. জেবুন নেছা

শিশুর দুধদাঁতগুলোই ১২ থেকে ১৪ বছর পর্যন্ত শিশুর স্বাস্থ্য রক্ষায় নানাভাবে সহায়তা করে।

ছয় মাস বয়স থেকে দুই বা আড়াই বছর বয়স পর্যন্ত শিশুর দাঁত ওঠে। একে দুধদাঁত বলে। যার যত্ন প্রথম থেকেই নেওয়া প্রয়োজন। অনেকে মনে করেন, এই দাঁত তো আর স্থায়ী নয়, কয়দিন পরেই তো  পড়ে যাবে এবং স্থায়ী দাঁত উঠবে, তাই এই দাঁতের বাড়তি যত্নের তেমন প্রয়োজন নেই। কিন্তু এই ধারণা মোটেও ঠিক নয়। কারণ এই দুধদাঁতগুলোই ১২ থেকে ১৪ বছর পর্যন্ত শিশুর স্বাস্থ্য রক্ষায় নানাভাবে সহায়তা করে।

 

ব্রাশ নির্বাচন

শিশুর প্রথম দাঁত ওঠে সাধারণত ছয় মাস বয়স থেকে। দুই থেকে আড়াই বছরের মধ্যে দাঁত ওঠা শেষ হয়। দাঁত ওঠার আগে থেকেই শিশুর মাড়ির যত্ন নিতে হবে মাকে অথবা যে শিশুর দেখাশোনা করবে তাকে। এ জন্য নরম সুতি কাপড় বা গজ পানিতে ভিজিয়ে ভালোমতো চিপে শিশুর প্রতিবেলা খাবারের পর দাঁতের মাড়ি মুছে দিতে হবে। দু-একটা দাঁত ওঠা পর্যন্ত একই নিয়মে করতে হবে। যখন শিশুর দাঁতের সংখ্যা একটু একটু করে বাড়বে, তখনো এই কাপড় দিয়ে একইভাবে পরিষ্কার করা যাবে অথবা বাজারে এক ধরনের খুব নরম আংটির মতো আঁশযুক্ত ব্রাশ পাওয়া যায়, যেটা আঙুলে পরে মা শিশুর দাঁত পরিষ্কার করতে পারবে খুব সহজেই। সে যখন একটু বড় হবে, তখন ছোট সাইজের ব্রাশ পাওয়া যায়, তা দিয়ে মায়েদেরই ব্রাশ করে দিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, ব্রাশের মাথা যেন ছোট হয়। মাঝেমধ্যে শিশুদের হাতে কিছুক্ষণ ব্রাশ ছেড়ে দিয়ে পরে মায়েরা ব্রাশ করে দেবেন।

 

ব্রাশের অভ্যাস

শিশুর দাঁত ব্রাশের অভ্যাস শিশু বয়স থেকেই করানো উচিত। তাই প্রতিবেলা খাবারের পর বিশেষ করে রাতে খাবারের পর ঘুমানোর আগে দাঁত ব্রাশ করে ঘুমানোর অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। শিশু যাতে রাতে ব্রাশ করার নিয়ম রপ্ত করতে পারে এ জন্য মা, বাবা অথবা শিশুর যিনি দেখাশোনা করেন তিনিও নিয়মিত ব্রাশ করবেন, যেন তা দেখে শিশু শিখতে পারে। শিশুর হাতে কিছুক্ষণ ব্রাশ ছেড়ে দিয়ে মা, বাবা তার সামনে ব্রাশ করলে শিশুরা উৎসাহিত হবে। পরবর্তী সময়ে আবার শিশুকে সঠিক নিয়মে ব্রাশ করাতে হবে।

বড়রা যেমন তিন বেলা খাবার খায়, শিশুরা কিন্তু একটু পর পর খাবার খেয়ে থাকে। তাই বলে এতবার ব্রাশ করা শিশুর পক্ষে সম্ভব নয়। তাই  খাবার খাওয়ার পরপরই একটু ফ্রেশ পানি খাইয়ে দেওয়া ভালো এবং কুলকুচা করার অভ্যাস করাতে পারলে আরো ভালো হয়। বিশেষ করে যে শিশু ফিডার খায়, তাদের খাওয়ার পর একটু ফ্রেশ পানি খাইয়ে দেওয়া উচিত। এতে মুখের স্বাস্থ্য ভালো থাকবে।

 

পেস্ট নির্বাচন 

বাজারে এখন দুই ধরনের পেস্ট পাওয়া যায়, যেমন ফ্লুরাইডযুক্ত পেস্ট ও ফ্লুরাইড ছাড়া পেস্ট। পেস্টের সঙ্গে ফ্লুরাইড যুক্ত করা হয় দাঁত মজবুত করার জন্য। এই ফ্লুরাইডের আবার নির্দিষ্ট একটা ডোজ আছে। যার পরিমাণ লেভেলের চেয়ে বেড়ে গেলে ফ্লুরাইড তখন দাঁতের জন্য ক্ষতিকারক হয়ে যায়। শুধু দাঁতের জন্যই নয়, হাড় ও শরীরের অন্যান্য অংশেরও ক্ষতি করে। এ জন্য শিশুরা যতক্ষণ ঠিকমতো কুলকুচা করতে না পারে এবং থুথু ফেলতে না শেখে, ততক্ষণ শিশুদের ফ্লুরাইডযুক্ত পেস্ট দেওয়া উচিত নয়। কারণ শিশুদের পেস্টের ফ্লেবার (রং, গন্ধ, স্বাদ) আকর্ষণীয় করার জন্য বিভিন্ন ফল বা চকোলেটের মতো দেওয়া হয়। তাই বেশির ভাগ বাচ্চা ব্রাশ করার সময় পেস্ট গিলে ফেলে। আর চার-পাঁচ বছরের শিশুদের স্নায়ুর গঠন পুরোপুরি হয় না। যার জন্য শিশুদের কো-অর্ডিনেশনটাও ঠিকমতো হয় না। পাঁচ বছরের পর নরমাল শিশুরা ফ্লুরাইডযুক্ত পেস্ট ব্যবহার করতে পারবে। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায়, যেসব শিশু একটু স্লো তাদের দাঁত উঠতে দেরি হয়, কথা বলতে দেরি হয় বা তাদের বোঝার ক্ষমতাটাও অনেক দেরিতে হয়। তাদের বয়স পাঁচ বছরের হলেও যত দিন পর্যন্ত তারা ঠিকমতো থুথু ফেলতে এবং কুলকুচা করতে না শিখবে, তত দিন পর্যন্ত ফ্লুরাইডযুক্ত পেস্ট দেওয়া উচিত নয়। আর অটিস্টিক বা ডাউন সিনড্রোম বেবিদের জন্য ফ্লুরাইডযুক্ত পেস্ট না দেওয়াই উচিত। তাদের  যারা দেখাশোনা করে তাকেই ব্রাশ করে দিতে হবে। বেশি বড় হয়ে গেলে ব্যাটারিচালিত ইলেকট্রিক টুথব্রাশ দিলে তা অটোমেটিক ক্লিন করতে সাহায্য করবে।

 

নিতে হবে সঠিক যত্ন

দুধদাঁতের যত্ন না নিলে দাঁতে ক্ষয়রোগ (ডেন্টাল ক্যারিজ) অথবা মাড়ির ইনফেকশন (জিনজিভাইটিস) হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ফলে শিশুর দাঁত সময়ের আগেই ফেলে দিতে হতে পারে। এ কারণে শিশু ঠিকভাবে কথা বলতে পারবে না, আবার খেতে অসুবিধা হবে। আর কম খাওয়ার কারণেই শিশু অপুষ্টির শিকার হতে পারে। তা ছাড়া অসময়ে দুধদাঁত পড়ে গেলে দেখতে অসুন্দর লাগায় শিশু অনেক সময় মানসিক কষ্টে ভোগে।

তাই শিশুর সৌন্দর্য রক্ষায়ও দুধদাঁতের যত্ন নেওয়া দরকার।

দুধদাঁত সময়ের আগে পড়ে গেলে স্থায়ী দাঁতগুলো আঁকাবাঁকাভাবে উঠতে পারে, আবার অনেক সময় দাঁত পড়তে দেরি হলেও তার স্থায়ী দাঁতগুলো অন্য জায়গা দিয়ে উঠতে শুরু করে, যা দেখতে অত্যন্ত অসুন্দর লাগে। আঁকবাঁকা দাঁতে ময়লাও বেশি জমে, তাই দাঁত ও মাড়িতে ইনফেকশন হতে পারে।

শিশুরা প্রতিদিন যদি নিয়মিত ব্রাশ  না করে, তাহলে তারা যে খাবারগুলো খায়, সবই দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকে, বিশেষ করে যেগুলো মিষ্টিজাতীয় খাবার এবং আঠালো খাবার।  যেমন—চিপস, জুস, কেক, পেস্ট্রি, চকোলেট, আইসক্রিম, দুধ, ভাত, সুজি—এগুলো সাধারণত পরিষ্কার করা হয় না। ২৪ ঘণ্টার বেশি দাঁতের ফাঁকে খাবার জমা থাকলে ওখানে রোগ-জীবাণুর আধিক্য বেশি হয় এবং ফাঁকে ফাঁকে জমা খাবারগুলো পচে এসিড তৈরি হয়। শরীর থেকে এক ধরনের বিষাক্ত পদার্থ বের হয়, যা দাঁত ও মাড়ির জন্য ক্ষতিকারক। যত দিন যাবে, এই জমাকৃত খাবার আস্তে আস্তে শক্ত হয়ে পাথরের রূপ নেবে, যা মাড়িকে আক্রান্ত করবে। এ অবস্থাকে বলে জিনজিভাইটিস।

রোগ-জীবাণুর আধিক্যের কারণে মুখের মধ্যে একটি এসিডিক পরিবেশ তৈরি হয়, যা দাঁতকে ক্ষয় করে,  যাকে ডেন্টাল ক্যারেজ বলা হয়। দাঁতের মূল দুটি অসুখই হলো জিনজিভাইটিস এবং ডেন্টাল ক্যারিজ। ঠিকমতো পরিচর্যা না করলে পরবর্তী সময় এই রোগগুলো থেকে অনেক জটিলতার সৃষ্টি হয়। ছয় বছর থেকে দুধের দাঁত আস্তে আস্তে পড়তে শুরু করে এবং সেখানে স্থায়ী দাঁত ওঠা শুরু করে।

 

সঠিক ব্রাশ করার নিয়ম

দাঁত ব্রাশ করার অনেক নিয়ম আছে। তবে দাঁতের প্রতিটি অংশ পরিষ্কারের সহজ পদ্ধতি হলো—

♦ ওপরের দাঁতের ক্ষেত্রে ওপর থেকে নিচের দিকে ব্রাশ করতে হবে।

♦ নিচের দাঁতের ক্ষেত্রে নিচ থেকে ওপরের দিকে ব্রাশ করতে হবে।

♦ দাঁতের বাইরে ও ভেতরে ঠিক একই ধরনের মুভমেন্ট করতে হবে।

♦ চোয়ালের দাঁতগুলোর ওপরের অংশও ব্রাশ করে পরিষ্কার করা উচিত।

 

সতর্কতা

শিশুর নতুন দাঁত উঠতে শুরু করলে অনেকের ক্ষেত্রেই অতিরিক্ত লালা ঝরতে পারে। এতে ভয়ের কিছু নেই। শিশুর মাড়ি কিড়মিড়, অস্বস্তি ভাব বা ব্যথা হতে পারে। এ ক্ষেত্রে হাত ধুয়ে আস্তে আস্তে মাড়ি মালিশ করে দিতে হবে। হাড় বা শক্ত জিনিস শিশুর নাগালের বাইরে রাখুন। তীব্র দাঁত ব্যথা হলে ডেন্টিস্টের পরামর্শ নিন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!