class="post-template-default single single-post postid-1874 single-format-standard wp-custom-logo group-blog vl-boxed aa-prefix-matin-">
Shadow

ই-জঞ্জালে সোনার খনি!

যে তথ্য-প্রযুক্তির ওপর ভর করে ডিজিটাল অর্থনীতিতে সমৃদ্ধ হচ্ছে বাংলাদেশ, সেই প্রযুক্তিপণ্যের ফেলনা জঞ্জালই আবার হয়ে উঠতে পারে পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণ। যথাযথ উদ্যোগ নিলে ই-জঞ্জাল থেকে সোনা, রুপা, তামাসহ বিভিন্ন মূল্যবান ধাতু আহরণ সম্ভব। এতে উদ্যোক্তা তৈরির পাশাপাশি সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থানেরও বড় সুযোগ। জানাচ্ছেন আল-আমিন দেওয়ান

 

এনভায়রনমেন্ট সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাতিল একটি সাধারণ সিআরটি টিভিতে গড়ে ৪৫০ গ্রাম তামা, ২২৫ গ্রাম অ্যালুমিনিয়াম এবং ৫ দশমিক ৬ গ্রাম সোনা থাকে। এই হিসাবে প্রতি টন ই-বর্জ্য থেকে ৩৫০ গ্রাম পর্যন্ত সোনা পাওয়া সম্ভব। অথচ একটি সোনার খনির প্রতি টন আকর থেকে পাওয়া যায় মাত্র পাঁচ বা ছয় গ্রাম সোনা। অর্থাৎ গতানুগতিক খনি খননের তুলনায় ই-বর্জ্য থেকে ধাতু সংগ্রহ অনেক বেশি লাভজনক।

স্বাস্থ্যঝুঁকি, পরিবেশ বিপর্যয়ের বিপদ এড়িয়ে অর্থনৈতিক ভিত্তির আরেকটি স্তম্ভ হতে পারে প্রযুক্তির বাতিল জিনিসপত্র বা ই-বর্জ্য। বাংলাদেশের ই-বর্জ্যের ব্যাপকতা এই সম্ভাবনাকে আরো উজ্জ্বল দেখাচ্ছে।

 

গবেষণা চলছে জোরেশোরে

বেইজিংয়ের সিংহুয়া আর অস্ট্রেলিয়ার ম্যাক্যারে বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ গবেষণায় চীনের আটটি পুনঃ প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এসব কেন্দ্রে ই-বর্জ্য থেকে ধাতু শোধনে পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ, বর্জ্য সংগ্রহ ও পরিবহন এবং কর্মীদের বেতনই মূল খরচ। সঙ্গে রিসাইকল করার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আর কারখানা তৈরির খরচ রয়েছে। এসব খরচ আর চীনা সরকারের রিসাইকল করার কারখানার জন্য দেওয়া ভর্তুকি ধরে হিসাব করে দেখা গেছে, খনি খননের চেয়ে ই-বর্জ্য শোধনে খরচ ১৩ গুণ কম।

অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব নিউ সাউথ ওয়েলসের অধ্যাপক ভিনা সাহাজওয়ালা এমন একটি পরিত্যক্ত প্রযুক্তিপণ্যের খনিতে কাজ করেন। এখান থেকে তিনি সোনা, রুপা আর তামা তুলবেন বলে আশা করছেন। দুই বছরের মধ্যেই খনিটি ব্যাবসায়িক সাফল্যের মুখ দেখবে বলে আশা ভিনা সাহাজওয়ালার। অর্থনৈতিক মডেল অনুযায়ী, এ রকম ক্ষুদ্র ফ্যাক্টরি তৈরিতে খরচ পড়বে পাঁচ লাখ অস্ট্রেলীয় ডলার। বিনিয়োগ উঠে আসবে দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে। লাভের পাশাপাশি তৈরি হবে অনেক কর্মক্ষেত্র। তিনি বলেন, এ কাজে সামাজিক, অর্থনৈতিক আর পরিবেশ তিনটি উন্নয়নই হবে।

ম্যাক্যারে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন ম্যাথেউস বলছেন, ই-বর্জ্য খনি থেকে তামা বা সোনার নির্ভেজাল ধাতু তৈরি হতে পারে বড় ধরনের লাভজনক ব্যবসা। প্রাথমিকভাবে এ কাজে ধাতু বিশেষজ্ঞরাই এগিয়ে আসবেন। যেভাবে ই-বর্জ্যের পরিমাণ বাড়ছে, তাতে রিসাইকল করার ব্যবসা দিন দিনই বড় হতে থাকবে। ই-বর্জ্য সম্পর্কে জানাশোনা আছে এমন ছোট ছোট উদ্যোক্তাও এ ধরনের ব্যবসায় যুক্ত হতে পারেন।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে প্রসাম বা প্রসপেক্টিং সেকেন্ডারির ম্যাটেরিয়ালস ইন দি আরবান মাইন অ্যান্ড মাইনিং ওয়েস্টেজ নামে একটি প্রকল্প রয়েছে। বাতিল গাড়ি, নষ্ট ব্যাটারি আর ই-বর্জ্য থেকে কাঁচামাল পাওয়ার উপায় নিয়ে পরামর্শ দেওয়া হয় এ প্রকল্প থেকে।

জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালের ডক্টর কিস বাল্ডে বলেন, ই-বর্জ্য নিয়ে ব্যাপক হারে গবেষণা শুরু হয়েছে। নিত্যনতুন অনেক উদ্যোক্তা এই আরবান মাইনিং ব্যবসা শুরু করতে চাচ্ছেন। এ ব্যবসার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা কী হতে পারে সে সম্পর্কে জানছেন তাঁরা।

 

সম্ভাবনা বাংলাদেশেও

বাংলাদেশে ই-বর্জ্যের পরিমাণ নিয়ে সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও কয়েকটি সংস্থার গবেষণা ও তথ্য-প্রযুক্তি খাতের ব্যবসায়ীদের আনুমানিক হিসাবে এখন প্রতিদিন প্রায় এক হাজার টনের মতো ই-বর্জ্য তৈরি হয়। ২০১৪ সালেও ই-বর্জ্যের এই পরিমাণ ছিল দৈনিক ৫০০ টনের মতো। এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (ইএসডিও) ‘ই-বর্জ্য : বাংলাদেশের বর্তমান চিত্র ২০১৪’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ২০১১-১২ অর্থবছরে ই-বর্জ্যের পরিমাণ ছিল ৫১ লাখ মেট্রিক টন।

২০১৩-১৪ অর্থবছরে এটি প্রায় দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়ায় এক কোটি ১০ লাখ টনে। মোবাইল ফোন থেকেই হয় ৫১ হাজার ৫০০ টন। টেলিভিশন থেকে আট লাখ ৬০ হাজার এবং কম্পিউটার থেকে ৩৮ হাজার ৪০০ টন।

এ ছাড়া আমদানি করা পুরনো জাহাজের বিভিন্ন ইলেকট্রনিক থেকে প্রায় ৯০ লাখ মেট্রিক টনের মতো ই-বর্জ্য হয়। অন্যান্য প্রযুক্তিপণ্য ও ব্যাবহারিক যন্ত্রপাতির বর্জ্য দুই লাখ ১০ হাজার ৩৩৬ মেট্রিক টন।

ইএসডিওর গবেষক পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ড. শাহরিয়ার হোসেন জানান, প্রকারভেদে এই ই-বর্জ্য বৃদ্ধির হার ৪০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত। কোথাও কোথাও দ্বিগুণেরও বেশি। বাংলাদেশের নিজের ই-বর্জ্য হয় বছরে দুই মিলিয়ন মেট্রিক টন। বাকিটা আসে বাইরে থেকে। পুরনো জাহাজ এবং ভারত, মিয়ানমার থেকে ই-বর্জ্য ব্যাপক হারে বাংলাদেশে ঢুকছে।

 

ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ পরিস্থিতি

ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের কার্যকর উদ্যোগ নেই বললেই চলে। দেশে ই-বর্জ্যের নির্দিষ্ট ভাগাড়ও নেই। সাধারণ বর্জ্যের সঙ্গে এগুলোর বেশির ভাগ ফেলে দেওয়া হয়। সেখান থেকে হকাররা বেছে বেছে সংগ্রহ করে সেগুলো থেকে বিভিন্ন যন্ত্রাংশ, প্লাস্টিক, লোহা ও তামার মতো ধাতুগুলো খুলে আলাদা করে কেজি হিসেবে বিক্রি করে দেয়।

স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি না হলেও স্যামসাং, গ্রামীণফোন, রবি, বাংলালিংক, নকিয়া, ডেল, এইচপি, সিসকো, বাংলাদেশ পুলিশ, বাংলাদেশ বিমানসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান নিজেদের ই-বর্জ্য রিসাইকল করে। দেশের মোট বর্জ্যের তুলনায় এসব হিসাবেই আসে না।

সব মিলিয়ে ই-বর্জ্য ধ্বংস, রক্ষণাবেক্ষণ বা ব্যবস্থাপনার জন্য দেশে বলার মতো কোনো পরিকাঠামো না থাকায় বছর বছর কোটি কোটি টন এই ই-বর্জ্য নিয়ে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যেই যাচ্ছে বাংলাদেশ।

ড. শাহরিয়ার হোসেন বলেন, দেশে এখনো কেউ সঠিক প্রক্রিয়ায় ই-বর্জ্য নিয়ে কাজ করছে না। বিচ্ছিন্নভাবে যেগুলো হচ্ছে সেগুলোও স্বয়ংক্রিয় নয়। ফলে ঝুঁকির প্রায় পুরোটাই থেকে যায়।

ই-বর্জ্য নিয়ে দেশে কোনো আইন বা নীতিমালা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। একটি খসড়া নীতিমালা চূড়ান্ত করা হলেও তা এখন আইন মন্ত্রণালয়ে পড়ে আছে বলে জানান এই গবেষক।

ই-বর্জ্যে বাংলাদেশের পরিস্থিতি ভয়াবহ উল্লেখ করে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, ই-বর্জ্যের কারণে এক সীমাহীন বিপর্যয়ের মুখে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

এখনই এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়া হলে এটি আর নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।

দীর্ঘদিন থেকে ই-বর্জ্য নিয়ে কার্যকর ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনার দাবি জানিয়ে আসছেন মোস্তাফা জব্বার। এ বিষয়ে এখনো কার্যকর কিছু করা যায়নি বলে তিনি নিজেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

 

সম্ভাবনা যেখানে

ড. শাহরিয়ার হোসেন বলেন, ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কৌশল ভিন্ন রকম হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। উন্নত অনেক দেশে চাষাবাদ এবং লোকালয় ছাড়া বিরানভূমি রয়েছে, যেখানে এই ই-বর্জ্য ধ্বংস করা হয়।

বাংলাদেশের মতো ঘনবসতি ও সীমিত ভূমির দেশে ই-বর্জ্য মাটিতে মিশিয়ে ধ্বংসের প্রক্রিয়াটি বিপজ্জনকই হবে। তাই ই-বর্জ্য নিয়ে অত্যাধুনিক রিসাইক্লিং ব্যবস্থাই এখানে নিতে হবে। সেখানে এই ই-বর্জ্য মাইনিং রিসাইক্লিংও নতুন অর্থনৈতিক খাত তৈরি করতে পারে। অথচ বাংলাদেশে এমন প্লান্ট এখন পর্যন্ত কেউ করেনি। জাপান ও শ্রীলঙ্কার একাধিক প্রতিষ্ঠান আগ্রহ দেখালেও বেশিদূর এগোয়নি। দেশে এ বিষয়ে কোনো নীতিমালা না থাকায় তারা হালে পানি পাচ্ছে না।

ইএসডিওর এই গবেষক বলেন, ই-বর্জ্য রিসাইক্লিংয়ে নতুন খাত ও উদ্যোক্তা তৈরির পাশাপাশি কর্মসংস্থানেরও বড় সুযোগ তৈরি হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!