জাহানারা বেগম ঘরে রান্না করছিলেন। বলছিলেন কন্যা সন্তান জন্ম নেয়ার ঠিক পরের দিনই তার স্বামী তাকে ছেড়ে চলে গেছে।
নিজের বয়স সম্পর্কে ধারনা নেই এই নারীর। বছর খানেক হল কিশোরী মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন।
সেভাবে কখনো ঠিক চিন্তাও করেননি যে তিনিই আসলে এখন তার পরিবারের প্রধান।
তিনি বলছেন, “বাবা থাকলে বা বড়ভাই থাকলে তারাই দেখাশুনা করতো। যেহেতু পরিবারের মাথা নেই তাই আমরাই দেখাশুনা করি। খাওয়ার খরচাপাতি দেই, কাপড়চোপড় দেই, ঘরবাড়ি সারতে হলে সেটা ঠিক করতে হয়।”
দশ কাঠা জমি বেচে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন তিনি। এখন শুধু ভিটে ছাড়া আর কিছুই নেই। তার উপর নির্ভরশীল বয়োবৃদ্ধ মা।
এক ভাই, বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যাওয়া দুই বোন ও তাদের সন্তানদের সহ তার বিশাল এক পরিবার।
রাজধানী ঢাকার মিরপুর এলাকায় তিন বোন মিলে গৃহকর্মীর কাজ করেন এবং একই এলাকায় বসবাস করেন। সহায় সম্বল কিছুই নেই কিন্তু তবুও পরিবারের হাল ধরে আছেন জাহানারা বেগম।
ঢাকার পরিবাগ এলাকায় গিয়ে দেখা হল নিবেদিতা পালের সাথে। দ্রুত ঘরের কাজ গুছিয়ে নিচ্ছিলেন।
তিনিও ঠিক প্রয়োজনেই আজ পরিবারের প্রধান। স্ট্রোকে ব্যবসায়ী স্বামীর মৃত্যু হয়েছে ২০১২ সালে।
বলছিলেন সেসময়কার সাথে এখনকার জীবনের অনেক তফাৎ।
তিনি বলছেন, “আগে বাসা ভাড়া মেয়েদের পড়াশুনার খরচ, ফ্যামিলির সবকিছু তার উপরে ছিল। আমার দায়িত্ব শুধু ছিল মেয়েদের স্কুলে আনা নেয়া করা, তাদের ঠিকমতো পড়াশুনা করানো। এখনকার সাথে তখনকার তফাৎটা হল বাজার, বাড়িভাড়া এসব বিষয় আমার মাথায় তখন ছিল না। এখন মেয়েদের আর আমার নিজের ইনকাম দিয়ে ঘরে বাইরে সবকিছু করতে হচ্ছে। দায়িত্বটা অনেক বেড়ে গেছে।”
কিন্তু বাংলাদেশে প্রথাগতভাবে পরিবারের প্রধান সাধারণত পুরুষরাই হয়ে থাকেন।
পরিবারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেয়া নারীদের সংখ্যা আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি।
এবছর জুন মাসে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রকাশিত এক জরিপ অনুযায়ী, দেশে প্রতি ১০০টি পরিবারের মধ্যে অন্তত ১৪টি পরিবারের প্রধান এখন নারী যা ১৪ শতাংশের কিছু বেশি।
দশ বছর আগে নারী প্রধান পরিবারের হার ছিল ১০ শতাংশের মতো।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রকল্প পরিচালক একেএম আশরাফুল হক বলছিলেন চট্টগ্রাম ও সিলেটে এমন পরিবারের সংখ্যা বেশি পাওয়া গেছে। তারপরে রয়েছে ঢাকা।
তিনি জানিয়েছেন, “সারাদেশে আমাদের দুই হাজার বারোটি নমুনা সংগ্রহ এলাকা আছে। সেখানে একজন করে মহিলা তথ্য সংগ্রহকারী রয়েছেন। তারা সারা বছর জুড়ে সেখানে নতুন জন্ম মৃত্যু, বিয়ে বা বিবাহ বিচ্ছেদ এমন তথ্য সংগ্রহ করে। ২০১৭ সালের জরীপে দেখা যাচ্ছে চট্টগ্রাম ও সিলেটে এমন পরিবার বেশি।”
কিন্তু বাংলাদেশে কেন বাড়ছে নারী প্রধান পরিবার?
পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসেবে যেসব পরিবারের প্রধান নারী, তাদের মধ্যে ৮৪ শতাংশ হয় বিধবা, নয়তো স্বামীর সাথে বিচ্ছেদের কারণে সে পরিবার প্রধান।
অবিবাহিত অল্প বয়সী মেয়েরাও এখন প্রচুর পরিবারের দায়িত্ব নিচ্ছেন।
নারী প্রধান পরিবারের ২১ শতাংশ কর্ত্রীর বয়স ১৫ বছর বা তারও কম।
জনসংখ্যা বিষয়ক আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান পপুলেশন কাউন্সিলের বাংলাদেশ প্রধান ডঃ ওবায়দুর রব নারী প্রধান পরিবার বৃদ্ধির প্রধান কয়েকটি কারণ উল্লেখ করছিলেন।
তিনি বলছিলেন, “বিশাল সংখ্যক মাইগ্রান্ট পপুলেশন যারা বিদেশে কাজ করছেন তাদের পরিবার ম্যানেজ করছেন তাদের স্ত্রী অথবা তাদের মা। সেই হিসেবে ফিমেল হেডেড হাউজহোল্ড বাড়ছে। আরেকটা হল মেয়েদের যে এমপ্লয়মেন্ট হচ্ছে, বিশেষ করে গার্মেন্টস সেক্টরে। সেক্ষেত্রে তারাও এক ধরনের পরিবার তৈরি করছে।”
বর্তমানে এক কোটির বেশি লোক মধ্যপ্রাচ্য সহ পৃথিবীর নানা দেশে কর্মরত রয়েছেন। পুরুষের তুলনা নারীরা বেশি বাঁচেন এই বিষয়টিও ছোট একটি কারণ হিসেবে উল্লেখ করছেন তিনি।
ভবিষ্যতে এমন পরিবার আরো বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বর্তমান ধারা বজায় থাকলে ২০৩০ সালের দিকে নারী প্রধান পরিবার ২৫ শতাংশ হয়ে দাড়াতে পারে।
পরিবারের কাঠামো পরিবর্তনের সাথে সামাজিক পরিবর্তনের কি কোন সম্পর্ক রয়েছে?
নাকি পরিবারের কাঠামো পরিবর্তনের কারণেই সমাজের পরিবর্তন হবে?
তবে পরিবারের প্রধান হিসেবে নারী নিজেকে আসলেই প্রতিষ্ঠা করতে পারছে কিনা সে নিয়ে সন্দেহ পোষণ করছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মির্জা তাসলিমা সুলতানা।
তিনি বলছেন, “এমন নারীদের ঘরে বাইরে দুই যায়গাতেই কাজ করতে হচ্ছে। কিন্তু যখনই বড় বড় ইস্যু থাকে যেমন মেয়ের বিয়ে বা জমি ক্রয় বিক্রয় তখন কিন্তু সে আবার পুরুষদের সহযোগিতা সাধারণত চেয়ে থাকে। তার ভূমিকা প্রধান হলেও কাঠামোর কারণে সে বড় বড় সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে তার নিকটাত্মীয় পুরুষ বা অনুপস্থিত স্বামীর তাদের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয়”
তিনি আরো বলছেন, “আমার অবজারভেশন হল নারীরা নিজেরাই বলতে চায়না যে পুরো ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব আসলে তার। বিশেষ করে গ্রামের দিকে। সে হয়ত বলছে না আমার বড় ছেলে বা হয়ত বড় ভাই। কারণ এখানকার মতাদর্শ যেহেতু পারমিট করে না তাই সে নিজেও মতাদর্শকে চ্যালেঞ্জ না করে তার সাথে নেগোশিয়েট করে ঐ কাঠামোতে থেকে যাওয়াই তার জন্য নিরাপদ মনে করে।”
পরিবারের ধরন পরিবর্তন হলে তার প্রভাব বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কিভাবে পড়ছে?
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র গবেষক অর্থনীতিবিদ ডঃ নাজনীন আহমেদ অবশ্য বলছেন নারীর পরিবারের প্রধান হয়ে ওঠা উল্টো তার জন্য সংকটের ইংগিতও হতে পারে।
তিনি বলছেন, “স্বামী পরিত্যক্তা বা স্বামীকে তালাক দিয়েছেন, স্বামী মারা গেছেন বা ছেলে মেয়ে বড় হয়ে আলাদা হয়ে গেছে এমন অনেক কারণে যে নারীরা পরিবারের প্রধান হয়ে ওঠেন এটি তার ক্ষমতায়নের লক্ষণ নাও হতে পারে। এই বিষয়টা তাকে কিন্তু একটা অর্থনৈতিক হুমকির মুখেও ঠেলে দেয়”
তিনি আরো বলছেন, “হঠাৎ স্বামীর মৃত্যুর কারণে তার হয়ত খাওয়ার খরচ জোটানো কঠিন হয়ে পড়তে পারে। ছেলে মেয়েদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এই যে আমরা বলছি নারী প্রধান খানার সংখ্যা বাড়ছে, এর মধ্যে কত অংশ নারী সত্যিকারের ক্ষমতায়ন হয়েছে সেটি চিন্তা করতে হবে। নারী প্রধান পরিবারের সংখ্যা বাড়াটা সংকট বৃদ্ধির ইঙ্গিতও হতে পারে”
মিরপুরের জাহানারা বেগমের জন্য শুরুটা তেমনই ছিল। পরিসংখ্যান, অর্থনীতি বা সমাজবিজ্ঞান নিয়ে ভাবেন না এই নারী।
নিজের রান্নার কাজে ফিরে যেতে যেতে তিনি বলছিলেন প্রয়োজনের কারণেই আজ তিনি পরিবারের দায়িত্ব নিয়েছেন।