আমাদের দেশে শীতকালীন সবজিগুলোর মধ্যে লাউ অন্যতম। লাউ যেমন সবজি হিসাবে অনেক সুস্বাদু তেমনি লাউয়ের পাতাও শাক হিসাবে অনেক উপাদেয়। আমাদের দেশে বিভিন্ন প্রজাতির লাউ রয়েছে। জাতের প্রকার ভেদের কারণে এর আকার-আকৃতি ও বর্ণ ভিন্ন হয়। তবে বর্তমান সময়ে কিছু উচ্চ ফলনশীল জাতের চাষ হয় বলে প্রায় সারা বছরই এ সবজিটি বাজারে পাওয়া যায়। আপনি চাইলে আপনার ছাদের টবে বা ড্রামে লাউ চাষ করতে পারেন। এতে আপনার পরিবারের জন্য টাটকা সবজি যেমন পাবেন তেমনি ফলন বেশি হলে করতে পারেন বাড়তি রোজগার। লাউ এর আগাম ফসল ঘরে তুলতে চাইলে এখনই ড্রামে বা টবে লাউ এর চারা রোপনের উপযুক্ত সময়।
উত্তম জাত নির্বাচন
ভালো জাত নির্বাচনে আপনি ভালো ফসল পাবেন তাই লাউ এর জাত নির্বাচন করুন একটু ভেবে চিন্তে। বর্তমানে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট উচ্চফলনশীল লাউয়ের একটি জাত উদ্ভাবন করেছে বারি লাউ-১ নামে । এর সুবিধা হলো এটি সারা বছরই চাষ করা যায়। তাছাড়া আপনি চাইলে হাইব্রিড লাউ মার্টিনা, জুপিটার, যমুনা, কাবেরী ও পদ্মা চাষ করতে পারেন।
সার ও মাটি প্রস্তুত করণ
শাক-সবজির বীজতলার জন্য মাটি সব সময় নরম তুলতুলে থাকলে গাছ তাড়াতাড়ি বাড়ে তাই মাটি হতে হবে ঝুরঝুরে, হালকা এবং পানি ধরে রাখার ক্ষমতা সম্পন্ন। মাটি থেকে বিভিন্ন আগাছা চালনি দিয়ে চেলে জীবাণুমুক্ত করে নিতে হবে তাহলে চারাকে রোগবালাই থেকে রক্ষা করা সহজ হবে। জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ দো-আঁশ, এঁটেল দো-আঁশ মাটি লাউ চাষের জন্য উত্তম। দুই ভাগ দো-আঁশ মাটির সঙ্গে দুই ভাগ জৈব সার মিলিয়ে নিয়ে বীজতলার মাটি তৈরি করে নিতে হয়। লাউয়ের জন্য ভালো সার হলো টিএসপি, এমপি, জিপসাম ও বোরক্স সার এবং আপনি গোবর ও সার হিসাবে প্রয়োগ করতে পারেন।
বীজ থেকে চারা তৈরি
ভালো চারা তৈরি করতে চাইলে ছোট পলি ব্যাগে বীজ বপন করাই উত্তম। লাউয়ের বীজ বপনের পূর্বে বীজকে অন্তত ১২ ঘন্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখুন। তারপর সার মিশ্রিত মাটি পলি ব্যাগে ভরে তার মাঝে দুটি করে বীজ তার আকারের দ্বিগুণ মাটির গভীরে বুনতে হবে এবং প্রতিদিন সকাল-বিকাল পানি দিতে হবে।
টবে বা ড্রামে চারা রোপণ
লাউ বীজ থেকে চারা গজানোর পর ১৬-১৭ দিন বয়সের চারা টবে বা ড্রামে লাগানোর জন্য উপযুক্ত হয়। ছাদে টবে বা ড্রামে লাউ চাষের ক্ষেত্রে প্রতিটা চারা কে পলি ব্যাগ থেকে বের করে টবে বা ড্রামে রোপন করতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয় যদি প্রতিটি চারার জন্য আলাদা আলাদা টব বা ড্রামের ব্যবস্থা করা যায়। টব বা ড্রামগুলোকে একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে স্থাপন করুন এবং নিবিড় পরিচর্যায় রাখুন। মাচায় লাউয়ের ফলন বেশী হয় তাই উত্তম ভাবে মাচা তৈরি করে দিলে অধিক ফলন আশা করা যায়।
লাউ গাছের পরিচর্যা
লাউ গাছের প্রচুর পানি প্রয়োজন হয় তাই গাছের পর্যাপ্ত খাবার সরবরাহ নিশ্চির করতে প্রতিদিন সকাল বিকাল পানি সেচ দিতে হবে। আপনার গৃহের প্রতিদিনের মাছ মাংস ধোয়া পানি মাঝে মধ্যে লাউ গাছে দিবেন এতে বিশেষ উপকার পাবেন। খেয়াল রাখবেন টবে বা ড্রামে লাউ গাছের প্রয়োজনীয় পানির অভার হলে ফলন ব্যাহত হবে এবং ফল ছোট অবস্থাতেই ঝরে যাবে উপরন্তু টবে বা ড্রামে লাউ চাষ করতে পানি একটু বেশি প্রয়োজন হয়। তাছাড়া ড্রামের আগাছা পরিস্কার রাখুন, মাসে অন্তত কয়েক বার লাউয়ের পাতা সংগ্রহ করুন এবং লাউ গাছে সর্বদা যথেষ্ট সূর্যের আলো ও বাতাসের ব্যবস্থা করুন এতে ফলন আরো ভালো হবে। গাছের সঠিক পরিচর্যা নিশ্চিত করতে এর গোড়ায় নিয়মিত ইউরিয়া সহ, কচুরিপানা ও নানা ধরণের জৈব সার প্রয়োগ করুন। তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই সার গাছের গোড়া থেকে ৬ ইঞ্চি দূর মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে।
ক্ষতিকর পোকা দমন ও ফলন বাড়ানোর কৌশল
সাধারনত সব ধরনের ফসল ও সবজি গাছে ক্ষতিকর পোকা দ্ধারা আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে এক্ষেত্রে কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহন করলে তা থেকে সহজেই রক্ষা পাওয়া যায়। আর লাউ চাষের ক্ষেত্রে কিছু বাড়তি কৌশল অবলম্বন করলে আপনি পেতে পারেন আপনার কাংখিত ফলন। নিম্নে টবে বা ড্রামে লাউ চাষ লাউ গাছের ক্ষতিকর পোকা দমন ও ফলন বাড়ানোর কিছু কৌশল দেয়া হলো।
> আপনার ছাদে বা লাউয়ের মাচায় পাখি বসার ব্যবস্থা রাখুন এতে অনেকটা প্রাকৃতিক ভাবেই পোকা দমনের কাজ হয়ে যাবে।
> ফ্রুট ফ্লাই পোকা কচি লাউয়ে ক্ষত সৃষ্টি করে এবং খুব ছোট কালেই লাউয়ের কচি কড়া পচে ঝরে পরে। এজন্য লাউ গাছে ছাই ছিটিয়ে দিন অথবা ডায়াজিনন প্রয়োগ করতে পারেন।
> পিঁপড়া লাউ গাছের তেমন ক্ষতি না করলেউ ফুলে আক্রমণ করে ক্ষতি করতে পারে। লাউ গাছ কে পিঁপড়ার হাত থেকে রক্ষা করতে ছাই অথবা সেভিন দিতে পারেন।
> পোকা দমনে সেক্স ফেরোমোন ফাঁদ খুব কার্যকরী একটা কৌশল। এটা পুরুষ পোকাকে আকৃষ্ট করে সহজেই ধ্বংস করে এবং তৈরি করাও অনেক সহজ।
> বিষটোপ ফাঁদ ব্যবহার করেও পোকা দমন করা যায়। বিষ টোপ তৈরি করতে ১০০ গ্রাম থেতলানো কুমড়ার সাথে ০.২৫ গ্রাম ডিপটেরেক্স পাউডার ও ১০০ এমএল পানি মিশিয়ে নিন। এবার মিশ্রনটি মাটির পাত্রে ঢেলে টব বা ড্রামের কাছে রেখে দিন। সাধারনত তিন চার দিন পর পর বিষটোপ পরিবর্তন করলে ভালো কার্যকরীতা পাওয়া যায়।
> শুষ্ক মৌসুমে লাউ গাছে ৪/৫ দিন পর পর সেচ দিবেন এবং প্রত্যেক সেচের পর গাছের গোড়ার মাটি চটা লেগে যায় তা আলতো করে ভেঙে দিবেন তাতে শিকড় ভালো ভাবে মাটির গভীরে ছড়ায় ও পর্যাপ্ত অক্সিজেন পায়।
> লাউ গাছের গোড়ার দিকের শোষক শাখা বা ছোট ছোট ডালপালা কেটে অপসারণ করতে হবে। এগুলো লাউ গাছের শারীরিক বৃদ্ধিতে ব্যাঘাত ঘটায় এবং খাদ্যোপাদান ও রস শোষণ করে নেয় যার কারনে ফলন কমে যায়।
> লাউয়ের ফুলে প্রাকৃতিক পরাগায়ন ঠিক মত না হলে ফলন কমে যায়। সেক্ষেত্রে হাত দিয়ে কৃত্রিম পরাগায়ন ঘটিয়ে ফলন শতকরা ৩০-৩৫ ভাগ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা সম্ভব। কৃত্রিম পরাগায়নের জন্য পুরুষ ফুল ছিঁড়ে পুংরেণুসমৃদ্ধ পুংকেশর রেখে পাপড়ি অপসারণ করে পুংরেণু স্ত্রী ফুলের গর্ভমুন্ডে আস্তে করে ঘষে দিতে হয়। পুরুষ ফুলের পাপড়ির গোড়ায় গর্ভাশয় থাকে না এবং তা বোঁটার অগ্রভাগে ফোটে পক্ষান্তরে ক্ষুদ্রাকৃতি লাউয়ের মত গর্ভাশয়ধারী ফুলগুলো স্ত্রী ফুল। একটি পুরুষ ফুল দিয়ে ৬/৭ টি স্ত্রী ফুলে পরাগায়ন করা যায় এবং অবশ্যই কৃত্রিম পরাগায়ন ফুল ফোটার দিন সন্ধ্যার ভিতরেই সম্পন্ন করবেন।
> লাউ গাছ অনেক বড় হয় কিন্তু তা অপেক্ষায় ফুল কম ধরে। এমতাবস্থায় জৈব সারের মাত্রা কমিয়ে টিএসপি ও এমপি সার পরিমিত মাত্রায় অথবা গ্রোথ হরমোন স্প্রে করতে পারেন।