সঠিক পদ্ধতি মেনে রেশম চাষ করে আয় বাড়ান
রেশম পোকা পালন করে গুটি তৈরি করা হয়। রেশম পোকার খাদ্য হচ্ছে তুঁত গাছ। এজন্য তুঁত গাছ চাষ করতে হয়। নিচে বর্ণনা করা হলো :
১. তুঁত গাছ রোপণ ও পরিচর্যা
বন্যামুক্ত উঁচু এলাকা, উর্বর মাটি, সুনিস্কাশিত, দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ মাটিতে তুঁত গাছ ভালো হয়। বাড়ির চারপাশে, রাস্তার পাশে, পুকুর পাড়ে, রেললাইনের পাশে ও পতিত জমিতে তুঁত গাছের চারা রোপণ করা যায়।
জমি চাষ দিয়ে মাটি ঝুর ঝুর করে বিঘা প্রতি গোবর সার ৪০ কেজি, ইউরিয়া ৫০ কেজি, টিএসপি ৩০ কেজি ও এমওপি ১৫ কেজি মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।
শাখা কর্তন ও মাটিতে দাবা কলম দুই পদ্ধতিতে চারা তৈরি করা যায়। শাখা কর্তনের জন্য ৬-৯ মাস বয়সের গাছের দু’টি চোখ বা কুঁড়ি বিশিষ্ট খয়েরী রঙের চিকন শাখা ৬-৯ ইঞ্চি লম্বা করে কেটে মাটিতে খাড়া করে রোপণ করা যাবে একটি কুঁড়ি মাটির উপর সামান্য জেগে থাকে। সারি থেকে সারি দেড় ফুট এবং দুই শাখার মাঝে ৩ ইঞ্চি ফাঁক থাকবে। এটি রোপণের সময় হচ্ছে আশ্বিন-কার্তিন মাস।
মাটিতে দাবা কলম পদ্ধতির জন্য শাখাগুলো মাটির তিন ইঞ্চি গভীরে শুঁইয়ে রোপণ করতে হবে। এর জন্য তিন ইঞ্চি গভীর নালা কাটতে হবে। দূরত্ব শাখা কলমের সমান। এক বছর পর চারাগুলো মূল স্থানে ৬ ফুট দূরে দূরে রোপণ করতে হয়। উঁচু ঝোপ গাছের জন্যেও ৬ ফুট দূরে দূরে বর্ষার ঠিক পর পরই চারা লাগাতে হবে। এক বছর পরেই গাছ বড় হলে আড়াই থেকে তিন ফুট উচ্চতায় গাছ কেটে দিতে হয়। উঁচু গাছের জন্য গাছকে কাটতে হবে ৫-৬ ফুট উচ্চতায়।
তুঁত গাছের পরিচর্যা : জমি তৈরির সময় যে পরিমাণ সার দেয়া হয়েছিল প্রতি বছর সে পরিমাণ সার দিতে হয়। সবগুলো সম্পূর্ণ সার চার ভাগ করে প্রত্যেকবার পাতা তোলার পর এক ভাগ দিতে হয়। ভারী বর্ষায় সার দেয়া যাবে না। খরার সময় সেচ না দিয়ে সার দেয়া যাবে না। আগাছা দমন করতে হবে। গরু ছাগল থেকে গাছ রক্ষা করতে হবে। খরার সময় সেচ দিতে হবে।
২. তুঁত পাতা সংগ্রহ
গাছ ঝোপালো অর্থাৎ বেশি পাতা পাওয়ার জন্য মাঝে মাঝে গাছের গোড়ার কাছে ছাঁটাই করতে হয়। চারা রোপনের ৬ মাসের মধ্যে পাতা পাওয়া যায়। পোকার খাদ্যের জন্য বছরে চার বার পাতা সংগ্রহ করতে হয় : অগ্রহায়ণ, চৈত্র, জ্যৈষ্ঠ ও ভাদ্র। প্রত্যেক বার পাতা সংগ্রহের মাস তিনেক আগে ছাঁটাই করতে হবে। প্রতিটি গাছ থেকে ৮-১০ কেজি পাতা পাওয়া যায়। প্রথমে কচিপাতা ক্রমে বেশি বয়স্ক পাতা দরকার। বিকালে বা ভোরে পাতা তোলা ভালো। বৃষ্টিতে ভেজা পাতা কখনো পোকাকে খেতে দেয়া যাবে না। শুকনা পাতা খেতে দিতে হবে।
জেনে নিন লাভজনক রেশম চাষ এর আধুনিক কলাকৌশল
৩. রেশমের লার্ভা সংগ্রহ ও পালন
পোকার জন্য উঁচু, বড় বারান্দাসহ মাটির ঘর ভালো। ছাউনি খড়ের হলে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা বজায় রাখা যায়। পোকার ঘরের সামনে ছোট কক্ষ রাখা উচিত। যাতে উজি মাছি পোকার কক্ষে প্রবেশ করতে না পারে। তাপমাত্রা মাপার জন্য ঘরে থার্মোমিটার ও আর্দ্রতার মাপার যন্ত্র রাখতে হবে। শীতে ঘর গরম করার জন্য হিটার বা চুলা রাখতে হবে।
যেসব জিনিসপত্র লাগবেÑ ছোট পোকার জন্য কাঠের ছোট ডালা, বড় পোকার জন্য বাঁশের বড় ডালা, ডালা রাখার তাক, ছোট ও বড় পোকার জন্য জাল, তাকের পায়ায় দেয়ার জন্য আলকাতরার বাটি, গুটি করার বাঁশের চন্দ্রকী। আর্দ্রতা বাড়ানোর স্পঞ্জ। প্রতিবার চাষে লাগবে পোকার ডিম/লার্ভা তুঁতের পাতা, শোধন করার জন্য ফরমালিন, চুন, তুষ, পাখির পালক, কাগজ ইত্যাদি।
শোধন : প্রতিবার পোকা পালন শুরুর ২-৩ দিন আগে সবকিছু শোধন করতে হয়। সব জিনিসপত্র কয়েক দিন কড়া রোদে রাখতে হয়। এরপর সব ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করা ঘরের ভিতর সাজিয়ে রাখতে হয়। ৪০% ফরমালিন ১৯ ভাগ পানির সঙ্গে মিশিয়ে এরকম ফরমালিন ১ ভাগ মেশানো হয়। স্প্রে মেশিন দিয়ে ঘরের ভিতর ও জিনিসপত্রের উপর স্প্রে করতে হয়। শোধনের পর ২৪ ঘণ্টা ঘর বন্ধ রাখতে হয়।
ডিম ফোটানো : উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান থেকে পরীক্ষিত ডিম সংগ্রহ করে ছোট ডালাতে ছড়িয়ে দিন। ২৫ সে. তাপ ও ৮০% আর্দ্রতা রাখতে হয়। ৮-৯ দিন বয়সে ডিমে কালো ছিট পড়বে। ফরমালিনে ডিমগুলো ৫ মিনিট ডুবিয়ে শোধন করতে হয়। ৯-১০ দিন বয়সে পুরো ডিম কালো বা ছাই রঙের হবে। এখন ডিমগুলো অন্ধকারে ঢেকে দিতে হবে। ১০-১১ দিন বয়সে ডিম ফুটে লার্ভা বা পলু বের হবে। হঠাৎ করে ডিমগুলো আলোতে আনলে সব ডিম এক সঙ্গে ফুটবে।
লার্ভা বা পলু : ডিম ফুটে লার্ভা বের হবার পর ২০-২৫ দিন এই অবস্থায় থাকে। এ সময় লার্ভাদের পাতা খাইয়ে লালন পালন করতে হয়। এর মধ্যে এরা চার বার খোলস বদলায়। প্রতিবার খোলস ছাড়াবার পর ১৮-৩৬ ঘণ্টা খাওয়া বন্ধ করে নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকে। চারবার খোলস বদলাবার আগে লার্ভার চারটি অবস্থা এবং এর গুটি বাঁধবার আগে তার শেষ বা পঞ্চম অবস্থা।
প্রথম অবস্থায় : খুব কচি পাতা ছোট ছোট টুকরা করে লার্ভার সাথে রাখা। এক ঘণ্টা পরে পাখির পালক দিয়ে পোকাগুলো তুলে অন্য ডালায় সাদা কাগজের উপর ঝেড়ে মাঝখানে জড়ো করতে হয়। এভাবে ২৪ ঘণ্টায় ৪ বার পাতা খাওয়াতে হয়, সকাল ১০ টায়, বিকাল ৪ টায়, রাত ১০ টায় এবং ভোর ৪ টায়। পরদিন ছোট খোপের জাল লার্ভার উপরে রেখে তার উপর একই রকম কাটা পাতা দিলে লার্ভা জালের উপর উঠে আসবে। তখন জাল সরিয়ে অন্য ডালায় নিতে হবে। আগের ডালার মল ও পুরানো পাতা পরিষ্কার করাতে হয়। খোলস ছাড়ার পালা শুরু হলে গুঁড়ো চুন কাপড়ের ছাকনির ভিতর দিয়ে লার্ভার উপর ছিটিয়ে দিতে হবে। দরকারী তাপমাত্রা ২৬-২৭ সে. ও আর্দ্রতা ৮৫-৯০%।
দ্বিতীয় অবস্থায় : পাতা দেয়া, শোধন করা, বেড পরিষ্কার করা আগের মতই। ১০-১২ বার খায়
এবং ২-৩ দিনে খোলস বদলায়। আগে ফরমালিন মিশানো পোড়া তুষ লার্ভার উপর ছিটিয়ে দিতে হয়। আবার খোলস ছাড়া শুরু করলে আগের মতই চুনের গুঁড়া দিতে হয়। দরকারী তাপমাত্রা ২৬ সে. ও আর্দ্রতা ৭৫-৮০%।
তৃতীয় অবস্থায় : পোকা বড় সবুজ হয় ও মাথা মোটা। দরকারী তাপমাত্রা ২৫ সে. ও আর্দ্রতা ৭৫-৮০%। আর্দ্রতা কম থাকলে পলিথিন দিয়ে পোকা ঢেকে রাখতে হবে। পাতা একটু বড় করে কেটে দিতে হবে। খাওয়ার সময় একই। প্রয়োজনে বড় ডালা এবং পরিষ্কার করার জন্য বড় খোপের বড় জাল ব্যবহার করতে হবে। পরিষ্কার করার নিয়ম একই। আগের মতই খোলস ছেড়ে খাওয়া শুরু করার সময় ফরমালিন মাখা পোড়া তুষ এবং খোলস ছাড়তে শুরু করার সময় চুন দিতে হবে। লার্ভা ৮-১০ বার খায়, খোলস পাল্টায় ৩-৪ দিনে।
চতুর্থ অবস্থায় : দরকারী তাপমাত্রা ২৪ সে. ও আর্দ্রতা ৭০-৭৫%। আর্দ্রতা বাড়াতে পলিথিন দিয়ে লার্ভা ঢেকে দিতে হবে। স্পঞ্জ ব্যবহার করা যাবে না। আর্দ্রতা কমাতে হলে ঘরের দরজা-জানালা খোলা রাখতে হবে। এজন্য ঘরে শুকনা চুন বা শুকনা কাঠ কয়লা রাখা যায়। পাতা খাওয়ানো ও যতœ আগের মত। তবে মোটা পাতা দিলে ভালো হয়। ১২-১৬ বার লার্ভা খাদ্য খেয়ে ৫-৬ দিনে খোলস বদলায়।
পঞ্চম অবস্থায় : দরকারী তাপমাত্রা ২৩ সে. ও আর্দ্রতা ৬৫-৭০%। পলিথিন দিয়ে ঢাকা যাবে না। প্রয়োজনে আর্দ্রতা কমাবার ব্যবস্থা নিতে হবে। মোটা পাতা শুরুতে কাটা এবং পরে সম্পূর্ণ বা ডালসহ অবস্থায় দিন। অন্যসব আগের মত। লার্ভা ২০-২৮ বার খাদ্য খেয়ে ৬-৮ দিনে পিউপায় পরিণত হয়।
কোকুন বা পিউপা বা পুত্তলি : গুটির মধ্যে পিউপা প্রায় নিশ্চল অবস্থায় থাকে। এ অবস্থায় দেহ স্বচ্ছ হয়। মাথা ছোট ও সরু হয়। খাওয়া বন্ধ করে মাথা নাড়ে। মল নরম ও সবুজ হয়।
এবার একে চন্দ্রকীতে দিতে হবে গুটি করার জন্য। ৬ ফুট লম্বা ও ৪ ফুট প্রস্থের একটি চন্দ্রকীতে হাজার খানেক পোকা দেয়া যায়। চন্দ্রকী কীট পালার ঘরে রাখা যাবে না। হেলান দিয়ে কাত করে বারান্দায় রাখা যায়। ৯-১৪ দিন পর কোকুনের একপ্রান্ত কেটে পূর্ণাঙ্গ মথ বা প্রজাপতি বেরিয়ে আসে।
৪. গুটি সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ
পোকা চন্দ্রকীতে দেয়ার ৩-৫ দিন পর পুত্তলি হয়েছে কিনা দেখে গুটি ছাড়াতে হয়। এ সময় খট খট শব্দও শোনা যায়। তাপ দিয়ে ভিতরের পোকা মেরে ফেলে রেশম সুতা নেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। শুকনো তাপে তা করাই ভালো। কাঁচা অবস্থায় গুটি রেশম কারখানায় দেয়া যেতে পারে।
৫. সুতা তৈরি
গুটিতে রেশম সুতার সাথে কিছু আঠাল পদার্থ থাকে যা গুটিতে সুতাকে আটকে রাখে। ৭-৮ দিনের মধ্যে সুতা বের করার ব্যবস্থা করতে হয়। গুটিকে প্রায় ফুটন্ত পানিতে (৯০-৯৫ সে.) ৩-৪ মিনিট ডুবিয়ে রাখলে পিউপা মরে যায়। এ সময় কাঠি দিয়ে নাড়া দিলে রেশম সুতার মুখ বেরিয়ে আসে। গরম পানিতে ভিজিয়ে রেখে গুটির আঠালো পদার্থ গলিয়ে নিলে সুতা রীলে জড়ানোর উপযোগী হয়। গুটির মুখের সুতার প্রান্ত সুতা কাটা চরকী বা রীলের সাথে আটকে দিয়ে ঘুর্ণন অব্যাহত রাখলে গুটি থেকে সুতা মুক্ত হয়ে চরকীতে বা রীলে পেচাতে থাকে। একে কাঁচা রেশম সুতা বলে। একটি গুটিতে ৪০০-১০০০ মিটার সুতা থাকে।
৬. রেশম সংরক্ষণ
পূর্ণাঙ্গ স্ত্রী ও পুরুষ মথ কোকুন থেকে বের হওয়ার পর পরই এরা প্রজনন করে। একটি পুরুষ মথ একদিনে ২-৩টি স্ত্রী মথের সাথে প্রজনন করে। প্রজননের পর স্ত্রী মথকে ছেড়ে দেয়ার অল্প সময় পরেই স্ত্রী মথ ডিম পাড়ে। একটি পূর্ণাঙ্গ স্ত্রী মথ ২৪ ঘণ্টায় প্রায় ৬৫০টি ডিম পাড়ে। এই ডিম ফুটিয়ে আবার রেশম চাষ করা যায়।
রেশমের রোগ ও পোকা : রেশমে কটারোগ, কালোশিরা, রসা, চুনা কাঠি ও স্বল্পরোগ হয়। উজি মাছি খুব ক্ষতিকর। এই পোকা ঘরে প্রবেশের সাথে সাথে মেরে ফেলতে হবে। রোগ ও পোকা দমনের জন্য সঠিক তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা বজায় রাখা এবং সবকিছু শোধন করে কাজ করা।