ঢাকার দুই বস্তিতে ফায়ার অ্যালার্ম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে ‘ লুমকানি ’ ডিভাইসটির কল্যাণে এসব বস্তিতে অগ্নিদুর্ঘটনা অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রণ করা গেছে। কিভাবে?
আগুন থেকে বাঁচাবে লুমকানি
কড়াইল বস্তিতে ২০০৪ সালে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ছাই হয়ে গিয়েছিল সব। ঢাকা শহরের বস্তিগুলোতে এমন ঘটনার সংখ্যা কম নয়। তবে সম্প্রতি ২০১৭ সালের জুনের পর থেকে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটেনি কড়াইল বা কল্যাণপুর বস্তিতে। এটার পেছনে রয়েছে ‘লুমকানি’ নামের ছোট্ট একটি যন্ত্র। সাধারণ ফায়ার অ্যালার্মগুলো ধোঁয়া সনাক্ত করে অগ্নি সতর্কবার্তা দিয়ে থাকে।
এতে অনেক সময়ই বিভ্রান্তিকর ঘটনাও ঘটে থাকে। তবে লুমকানি সংকেত দেয় ঘরের তাপমাত্রা পরিমাপ করে। ঘরের তাপমাত্রা হঠাৎ অত্যাধিক বেড়ে গেলে মেশিনটি সংকেত দেওয়া শুরু। যন্ত্রটি যে ঘরে সংযুক্ত থাকে সেই ঘরের লোকজন এই সংকেতে সাড়া না দিলে ১০-২০ সেকেন্ডের মধ্যে প্রতিবেশি ঘরগুলোতে থেকে অন্য লুমকানিগুলোও একটু অন্যভাবে সংকেত দেওয়া শুরু করে দেয়। এভাবে আগুনের উৎপত্তিস্থলের চারপাশের ৬০ মিটারের মধ্যে অন্য সব ডিভাইসে পৌঁছে যায় সংকেত। একটি সেন্ট্রাল স্মার্ট ডিভাইসের মাধ্যমে পুরো নেটওয়ার্কটি কাজ করে। এটি অনেকটা রাউটারের মতো। সেন্ট্রাল ডিভাইসটি আগুন লাগার স্থান জিপিএসের মাধ্যমে নিকটস্থ কমিউনিটির কাছে পৌঁছে দেয়। তারাই নিশ্চিত হয়ে খবর দেয় ফায়ার সার্ভিসে। এ ছাড়া আগুন লাগলে ব্যবহারকারী ও প্রতিবেশীদের ফোনে ম্যাসেজও চলে যায়। ম্যাসেজ দেখেই বোঝা যায় মূলত কোন এলাকায়, কার ঘরে আগুন লেগেছে। তাই দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া যায়।
প্রতিটি ডিভাইস অ্যাপসের মাধ্যমে একটি ফোন নম্বর দিয়ে নিবন্ধন করা থাকে। অ্যাপে বারকোড স্ক্যান করে ব্যবহারকারী নিজের নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বরসহ কিছু তথ্য দিয়ে রাখতে পারেন।
সাউথ আফ্রিকা থেকে কড়াইল বস্তি
লুমকানির দেশ দক্ষিণ আফ্রিকায়। সে দেশের ফ্রাঙ্কোইস পেটুসিস এবং তাঁর দল আবিষ্কার করেন লুমকানি। দক্ষিণ আফ্রিকার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির কথা মাথায় রেখেই ডিভাইসটি তৈরি করা হয়। এটির দামও তাই সস্তা। ‘লুমকানি’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘সাবধান হও’। ২০১৪ সালে এটির উৎপাদন শুরু করা হয়। একই বছরে এটি মার্কিন সরকারের ‘গ্লোবাল ইনোভেশন থ্রু সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি কম্পিটিশন’-এ ‘সেরা স্টার্ট-আপ’ পুরস্কার জিতে নেয়।
লুমকানি এলো দেশে
২০১৬ সালে ‘গুগল.অর্গ ইমপ্যাক্ট চ্যালেঞ্জ’ প্রতিযোগিতায় বেসরকারি সংস্থা ওয়ার্ল্ড ভিশন, অস্ট্রেলিয়া শাখার একটি প্রকল্প প্রস্তাব পুরস্কার পায়। আর সেই প্রকল্পটি ছিল বাংলাদেশের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় আগুনের ভয়াবহতা কমাতে লুমকানির ব্যবহার। পরে ২০১৭ সালের জুন মাস থেকে গুগল ফাউন্ডেশন ও বাংলাদেশ ওয়ার্ল্ড ভিশন যৌথভাবে একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প হাতে নেয়। ঢাকার কড়াইলের খ-ব্লক ও কল্যাণপুরের পুরো বস্তিতে স্থাপন করা হয় লুমকানি। বাংলাদেশ দমকল বাহিনীও এতে যুক্ত হয়ে সহযোগিতা করে। একদল স্বেচ্ছাসেবীকে দেওয়া হয় প্রশিক্ষণ।
লুমকানি নিয়ে বাংলাদেশ ওয়ার্ল্ড ভিশনের প্রজেক্ট ম্যানেজার ফাতেমা মেহেরুন্নেছা বলেন, ‘আমাদের পরীক্ষামূলক প্রকল্প এখন পর্যন্ত সফল। পরীক্ষামূলক প্রজেক্টটি ২০১৯ সালে জুলাইয়ে শেষ হবে। আমরা চাই সরকার নিজে কিছু পাইলট প্রকল্প করুক। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার পাশাপাশি শপিং মল ও হাসপাতালেও এই কার্যক্রম পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা যেতে পারে। ফায়ার সার্ভিস ও উত্তর সিটি করপোরেশনের সমন্বয়ে এখন পর্যন্ত কাজ করে যাচ্ছি। কড়াইল বস্তিতে ৯৪০টি ও কল্যাণপুরে ২১০০টি ঘরে এই ডিভাইস লাগানো হয়েছে। ভবিষ্যতে লুমকানির সাহায্যে সরাসরি ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি।’
পুরো কড়াইল বস্তির বেসরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বয়ক সংগঠন ‘কমিউনিটি বেজড অর্গানাইজেশন’-এর প্রধান সেলিনা আক্তার অগ্নিনির্বাপক কমিটিরও প্রধান। তিনি বলেন, ‘কড়াইলের কান্না আগুন। এখানে বৃষ্টি বা বন্যায় আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও নিঃস্ব হই না। কিন্তু আগুন আমাদের সবকিছু ছাই করে দিয়ে যায়। ২০০৪ সালের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর থেকে আগুনেই আমাদের বেশি ভয়। তাই আমরা এখানে কাজ করা বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাগুলোকে এই সমস্যা নিয়ে বারবার তাগাদা দিই। বর্তমানে কড়াইলে কর্মরত প্রায় ২২টি বেসরকারি সংস্থার মধ্যে একমাত্র ওয়ার্ল্ড ভিশনই অগ্নি সতর্কতায় কাজ করছে। লুমকানি লাগানোর পর কড়াইলে এখন পর্যন্ত ১৫টি অগ্নিকাণ্ড ঘটে। তার মধ্যে মাত্র দুটি ঘটনা গণমাধ্যমে আসে তবে সেসব ভয়াবহ কিছু ছিল না।’
শিল্পী একজন গৃহিণী, তাঁর ঘরেও লাগানো আছে লুমকানি। তিনি জানালেন, ‘লুমকানি লাগানোর পর আগুনের দুশ্চিন্তা অনেকটাই কমে গেছে। অনেক দিন পর পর ব্যাটারি পরিবর্তন ছাড়া আর কিছু করতে হয় না। আগুনের খবর সহজেই মোবাইলে চলে আসে। কোথাও আগুন লেগেছে সেটাও দ্রুত বুঝে ফেলে স্বেচ্ছাসেবীরা। কেউ ভুলবশত অ্যালার্ম বাজালেও সেটি সহজে ধরা পড়ে দ্রুত। কারণ পুরো জিনিসটা কেন্দ্রীয় অফিস সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করে। কিছুদিন আগেই পাশের একটি ঘরের লুমকানি বাজতে থাকে। খবর পেয়ে সেখানে গিয়ে দেখি পাশেই বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য রান্না চলছিল। সেই তাপ দ্রুত মেশিনে আসায় অ্যালার্ম বাজছে। পরে রান্নার চুলা কিছুটা সরিয়ে নিতেই সমস্যার সমাধান হয়।’
সফলতা
লুমকানি আগুন থামাতে পারে না, শুধু সতর্ক সংকেত দেয় কোথায় আগুন লেগেছে। তাই প্রতিটি এলাকায় একটি স্বেচ্ছাসেবী দল গঠন করে ওয়ার্ল্ড ভিশন। তাদের ফায়ার সার্ভিসের মাধ্যমে দেওয়া হয় প্রশিক্ষণ। এই কমিউনিটির অগ্নিনির্বাপক দলের সদস্যরা সাধারণত স্থানীয়। এখন পর্যন্ত এই দলের সদস্যসংখ্যা ১১৫ থেকে ১২০ জন। এদের মধ্যে ৯০ জন ফায়ার সার্ভিস থেকে দুই দিনের ট্রেনিংপ্রাপ্ত। আগুন লাগলে তাঁরা দ্রুত পদক্ষেপ নিতে সক্ষম। সবার কাছে সবার মোবাইল নম্বর আছে। তাদের দেওয়া হয়েছে অগ্নিনির্বাপক বিভিন্ন সরঞ্জাম। একটি নির্দিষ্ট স্থানে রিসোর্স সেন্টার বানিয়ে তাঁরা কাজ করে থাকেন।
এখন পর্যন্ত কড়াইলে পাঁচটি ও কল্যাণপুরে চারটি আগুনের দূর্ঘটনা সফলভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছেন তাঁরা। বেশির ভাগ সময় ফায়ার সার্ভিস আসার আগেই তাঁরা আগুন নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছেন।
গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর কড়াইলের জামাইবাজার এলাকায় আগুন লাগে। যেটি খ-ব্লকের বাইরে। অর্থাৎ এখানে লুমকানি ডিভাইস নেই। তার পরও সেখানে আগুন নেভাতে এই স্বেচ্ছাসেবীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁদের কাছে ৫০টি অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র আছে। তাঁরা দ্রুত সেসব কাজে লাগিয়ে চারপাশ থেকে আগুন নিয়ন্ত্রণ করেন। আগে থেকেই মসজিদের পানির লাইন রেডি করে রাখেন, যাতে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি এলে পানি পেতে অসুবিধা না হয়। গাড়ি আসার জন্য জায়গা করে দেয়। এ সবই সম্ভব হয়েছে লুমকানির মাধ্যমে আগুনের উৎপত্তিস্থল শনাক্ত করতে পারায়।
কল্যাণপুরের আরেক স্বেচ্ছাসেবী টিম লিডার সাহসী ভূমিকা নিয়ে একটি ঘটনায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। ফায়ার ডিফেন্সের প্রশিক্ষণ থাকায় তিনি বুঝতে পারেন বৈদ্যুতিক লাইন থেকে আগুন লাগায় পানি দিয়ে লাভ নেই। তাই তিনি প্রথমে বিদ্যুতের মেইন সুইচ বন্ধ করেন। এরপর নিজ ঘর থেকে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র এনে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন।
ছড়িয়ে পড়বে সারা বিশ্বে
দক্ষিণ আফ্রিকা ও নামিবিয়ার প্রায় ২৮টি ঘনবসতিপূর্ণ স্থানে প্রায় আট হাজার লুমকানি ডিভাইস নিরাপত্তা দিচ্ছে। ওয়ার্ল্ড ভিশন কাজ করছে অংশীদার হিসেবে। সেখানে অন্তত ১৫টি দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হয়েছে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের স্থানীয় বাজারে যাতে এটি পাওয়া যায়, সে চেষ্টাও করা হচ্ছে। পাশাপাশি ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ও পাপুয়া নিউগিনিতে এই প্রযুক্তি পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনাও করা হচ্ছে।
https://www.youtube.com/watch?v=AoO_iZhlnGs&fbclid=IwAR16qDs832d57pNtySpHxJEi_4vSOV0y9ItGB3L-Zu6dqNDfxrIdoChIZDo