আনন্দবাজারের খবরআনন্দবাজারের খবর : ডান চোখের পাতা লাল হয়ে ফুলে রয়েছে। অন্য চোখ খোলার চেষ্টা করলেও ঠিক মতো পারেন না। কেউ ডাকলে ক্ষীণ দৃষ্টিতে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকেন। একটু ভালবেসে কথা বললেই তাঁকে হাতজোড় করে বছর পঁচাশির বৃদ্ধা অনুরোধ করতেন, ‘আমায় বেলঘরিয়া পৌঁছে দেবে?’

গত ৩০ নভেম্বর দুপুর থেকে নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালই ছিল ওই বৃদ্ধার ঠিকানা। কেউ জানতে চাইলে অস্ফূটে নাম বলতেন, রানি বিশ্বাস, বাড়ি বেলঘরিয়ার উমেশ মুখার্জি রোডে। ফুলছাপ নাইটি ও সবুজ সোয়েটার পরা রানিদেবীকে কখনও দেখা যেত জরুরি বিভাগের সামনে প্রতীক্ষালয়ের সিঁড়িতে বসে থাকতে। কখনও আবার অশক্ত শরীর নিয়ে কোমরে ভর করে এগিয়ে যেতেন রোগী সহায়তা কেন্দ্রের সিঁড়ির নীচে। মাঝেমধ্যে হাসপাতালের বড় পুকুরের ধারে শুয়ে থেকে জড়িয়ে ধরতেন রোগীর পরিজনেদের পা। ভিক্ষার জন্য নয়, অনুরোধ করতেন—‘বাড়ি যাব, একটু নিয়ে যাবে?’

 

কিন্তু কে বা কারা তাঁকে হাসপাতালে রেখে গেলেন? রোগীর পরিজন, হাসপাতালের নিরাপত্তারক্ষী বা আউটপোস্টের পুলিশকর্মীরা তাঁকে এ প্রশ্ন করলেই উদাস চোখে তাকিয়ে থাকতেন উসকোখুসকো সাদা চুলের রানিদেবী। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ত, করজোড়ে শুধু বলতেন, ‘মনে নেই।’ কখনও কারও দেওয়া এক ভাঁড় চা-বিস্কুট কিংবা দু’মুঠো ভাত পেলে ছলছল করে উঠত রানিদেবীর চোখ। কাঁপা হাতে মুখে তুলে নিতেন সেই খাবার।

টানা পাঁচ দিন খোলা আকাশের নীচে থাকার পরে বুধবার খবর পেয়ে এনআরএসে পৌঁছলেন তাঁর ছোট মেয়ে খুকুদেবী ও দুই প্রতিবেশী মহিলা। ট্যাক্সিতে চাপিয়ে নিয়ে গেলেন বেলঘরিয়ার বাড়িতে।

স্থানীয়েরা জানাচ্ছেন, এক সময়ে জমি-বাড়ির মালিক ছিলেন ওই বৃদ্ধা। তাঁর পুরো নাম রাজরানি বিশ্বাস। স্বামী কার্তিক বিশ্বাস, এক ছেলে ও পাঁচ মেয়েকে নিয়ে ছিল রাজরানির সংসার। প্রতিপত্তি এতই ছিল যে, তাঁর দোতলা বাড়ির পাশের রাস্তার নামকরণ হয়েছিল তাঁর দিদিশাশুড়ি সরোজিনীদেবীর নামে। প্রতিবেশীরা জানান, বহু বছর আগে পারিবারিক কারণে কার্তিকবাবু ঘর ছাড়া হন। একমাত্র ছেলে স্বপন খুন হয়ে যান। পাঁচ মেয়ের মধ্যে দু’জনের ইতিমধ্যেই মৃত্যু হয়েছে। মালদহবাসী বড় মেয়ে এবং দিঘার বাসিন্দা মেজ মেয়ের সঙ্গেও দীর্ঘদিন যোগাযোগ নেই রাজরানির। বেলঘরিয়ার বাড়িতে বৃদ্ধার সঙ্গে থাকেন পরিচারিকার কাজ করা তাঁর ছোট মেয়ে খুকু।

 

তিনি বলেন, ‘‘৩০ তারিখ কাজ থেকে ফিরে দেখি মা ঘরে নেই। খুঁজে না পেয়ে পাড়ার দিদিদের নিয়ে বেলঘরিয়া থানায় নিখোঁজ ডায়েরিও করেছিলাম।’’ স্থানীয় বাসিন্দা প্রদীপ পালিত জানান, মঙ্গলবার পরিচিত এক ব্যক্তির থেকে তাঁর এবং স্থানীয় ক্লাবের এক সদস্যের কাছে নিখোঁজ রাজরানিদেবীর খবর আসে। প্রবীণ ওই ব্যক্তি বলেন, ‘‘কে ওঁকে এত দূরে নিয়ে গিলেন সেটাই রহস্যের।’’

সম্পত্তির প্রায় সবটুকু বিভিন্ন সময়ে বিক্রি হয়ে যাওয়ার পরে কোনও মতে মাথা তুলে রয়েছে ভদ্রাসনের একাংশ। বট-অশ্বত্থে ভরা বিপজ্জনক দোতলা বাড়িতে সূর্যের আলোও ঠিক মতো ঢোকে না। দু’টি ঘরের ছাদ ভেঙে পড়েছে। বুধবার ওই বৃদ্ধাকে উদ্ধার করতে যাওয়া স্থানীয় বাসিন্দা তৃপ্তি চক্রবর্তী বলেন, ‘‘এলাকার কয়েক জন মিলে প্রায়শই খেতে দিতাম। মাঝে শুনেছিলাম এলাকারই কয়েক জন বাড়িটি হাতানোর চক্রান্ত করছে। কিন্তু এটাই ওঁদের শেষ সম্বল। শেষ বয়সে ওই বৃদ্ধা আর তাঁর মেয়ে যাবেন কোথায়? তাই আমরা রুখে দাঁড়িয়েছি।’’

বুধবার ওই বৃদ্ধার জন্য ফল, খাবার নিয়ে হাজির হন কামারহাটি পুরসভার চেয়ারম্যান পারিষদ (স্বাস্থ্য) বিমল সাহা। তাঁর সঙ্গে আসা পুরসভার চিকিৎসক সন্দীপ সরকার পরীক্ষা করে দেখেন রাজরানিদেবীকে। সন্দীপবাবু জানান, অপুষ্টিজনিত রোগে ভুগছেন বৃদ্ধা। তাঁর চোখে ও ডানহাতে আঘাতের চিহ্নও রয়েছে। বিমলবাবু বলেন, ‘‘স্থানীয়েরা ঘরে আলোর ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। পুরসভা থেকে বাড়িটিও সাফ করা হবে। প্রয়োজনে হাসপাতালে ভর্তি করা হবে।’’

পাঁচ দিন পরে ইটের পাঁজা বেরনো বাড়িতে ঢোকা মাত্রই কেঁদে ফেলেন রাজরানি। ভাঙা সিঁড়িতে বসে বৃদ্ধা ডেকে চলেন, তাঁর খুকুকে।