‘আমাদের সাথে তারা যা করছে তা মোটেও ঠিক নয়, এটা ঠিক নয়’। ক্ষোভ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন ড্যানি। ইউটিউবের অসংখ্য ভিডিও বানিয়েদের মধ্যে একজন তিনি। ইউটিউবের মৃত্যু ঘটতে চলেছে তাই বলতে চাইছেন তিনি। অন্তত যে ইউটিউব নিয়ে তারা বড় হয়েছেন, সে ইউটিউব আর নেই। শুরু থেকে ক্রমেই বোঝা যাচ্ছিলো, পৃথিবীতে এই সর্ববৃহৎ ভিডিও প্লাটফর্মটি চমকপ্রদভাবে অদ্ভুত, উদ্ভাবনী এবং উদ্যমীদের তৈরি করা ভিডিওগুলোকে উৎসাহ দেবে। আবার লেট-নাইট শো ক্লিপ এবং মিউজিক ভিডিও থেকেও দূরে সরবে না।
ইউটিউবের দুই জনপ্রিয় চরিত্র ফিলিপ্পো ভাতৃদ্বয়। তারা জমজ। নিজেরাই অভিনয় করেন, স্টান্ট হন। কিন্তু এই প্লাটফর্মের যে বিশাল দর্শকশ্রেণীর জন্যে তারা ভিডিও বানাতেন, তারা মনে হয় আর এই দুজনকে দেখতে চায় না। দুই ভাই ইউটিউবের সবচেয়ে জনপ্রিয় ভিডিও’র একটির খোঁজ চালালেন, মর্টাল কম্ব্যাটে ভয়ংকরতম ‘ফাটালিটি’। দেখা গেলো এগুলো নকল ভিডিও, বার বার আপলোড করা ভিডিও এবং আরো অন্য ভিডিও চলে আসে। কিন্তু আসল ভিডিওটির দেখা কোথাও মিলল না। আসলটি আসলে ইউটিউবই সরিয়ে ফেলেছে। কারণ, এতে অতিমাত্রায় ভায়োলেন্স থাকায় নীতিমালা অনুযায়ী তা প্রকাশ পেতে পারে না। কিন্তু অন্যগুলো ঠিকই আছে।
ড্যানির অভিযোগ, ইউটিউব বলছে এটা সিস্টেমের ত্রুটি। কিন্তু ত্রুটিটা কোথায়? ইউটিউব বলছে ভিডিওগুলো লুকানো হয়নি। যদি তা নাই হয়, তবে আমাদের ভিডিওগুলো দেখা যাচ্ছে না কেন?
এই দুই ভাইয়ের গল্পটা ভিডিও প্রস্তুতকারীদের ক্ষোভে ফুঁসে ওঠা বিশাল ঢেউয়ের ক্ষুদ্র অংশমাত্র। এটা ভিডিও যারা তৈরি করেন তাদের এবং ইউটিউব বিজ্ঞাপনদাতা ও মিডিয়ার কাছে নিজেদের কোন অবস্থানে দাঁড় করিয়েছে তার মধ্যকার এক যুদ্ধ। ইউটিউব মূলত এই ভিডিও প্রস্তুতকারীদের ওপরই নির্ভরশীল। তাদের মৌলিক ভিডিওগুলো প্রমোট করার কথা বলেই মাঠে নামে ইউটিউব। কিন্তু এখন চিত্রটা ভিন্ন। অসংখ্য ভিডিও সৃষ্টিকারী সার্চ অপশনে গিয়ে তাদের ভিডিওগুলো খুঁজে পাচ্ছেন না।
ইউটিউব যখন ‘অ্যাডপোক্যালিপসে (একে বলা হয় ইন্টারনেট স্ল্যাং বা ইন্টারনেটের অশালীন ভাষা)’ জড়াল, তখন নতুন এক প্রজন্ম এই প্লাটফর্মটিকে রীতিমতো দখলে নিয়ে নিলো। এতে ইউটিউবের জনপ্রিয় ও প্রভাবশালীরা বিপদগ্রস্ত হলেন। ২০১৭ সালে ছয় সেকেন্ডের লুপিং ভিডিও প্লাটফর্ম ‘ভাইন’ এর দিকে চলে গেলেন এমন হাজারো ভিডিও ক্রিয়েটর। ইউটিউবের অনেক তারকা ভাইনে গিয়েও সফলতা খুঁজে পেলেন। কিন্তু দীর্ঘদিন কাজ করা প্লাটফর্মটি তাদের ধরে রাখতে পারলো না।
ইউটিউবে সম্ভবত সবচেয়ে কুখ্যাত তারকা হলে লোগান পল। তার ‘সুইসাইড ফরেস্ট’ ভিডিওটি ইউটিউবকে যেন পুরোপুরি বদলে দিলো। পল এবং তার বন্ধুরা জাপানের আকিঘারা বনে ঘুরতে যান। সেখানে একজন পুরুষের মৃতদেহ দেখতে পান তারা। মনে হচ্ছিল লোকটি সাম্প্রতিক সময়েই আত্মহত্যা করেছেন। এটা নিয়েই তাদের তৈরিকৃত ভিডিওটি ছাড়া হয় ইউটিউবে। ভিডিওতে ওই মৃতদেহের প্রতি পলের আচরণ মোটেও সম্মানজনক ছিল না। এই ভিডিও নিয়ে ওঠে ঝড়। প্রভাবশালী ইউটিউবাররা ছি ছি করতে থাকলেন।
একই প্রতিক্রিয়া দেখালো ইউটিউব। ভিডিও প্রকাশে ব্যাপক বিধি-নিষেধ আরোপ করা হলো। ফলে এমন সব ভিডিও প্রকাশ বাধাগ্রস্ত হলো যাতে প্রচুর বিজ্ঞাপন আসে, অর্থাৎ ভিডিও প্রস্তুতকারীদের আয় প্রায় বন্ধ হবার দশা।
ইউটিউবের হেড অব বিজনেস রবার্ট কিঞ্চল জানালেন, এই পদ্ধতিতে আমরা সেই সকল ভিডিওকারীদের খুঁজে বের করতে পারবো যাদের অবদান সমাজে ইতিবাচক। সেইসঙ্গে আপত্তিকর ভিডিওর অর্থ উপার্জনও বন্ধ হবে।
কিন্তু এতে প্রভাব পড়লো অসংখ্য ইউটিউবারের ওপর। তাদের আয় বন্ধ হয়ে গেলো। হাজারো ভিডিও আপলোড বন্ধ হয়ে গেলো। এদের কেউ আয় বন্ধ হওয়ার বিষয়টি মেনে নিতে পারলেন না। আবার কারো কাছে বিষয়টি দুঃখজনক। এতদিন ধরে তারা ইউটিউবের সঙ্গে আছেন, অথচ এখন তাদের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলো!
তাহলে এই প্লাটফর্মে ভবিষ্যতটা কী হতে চলেছে? ২০১৪ সালে ইউটিউব নিউ ইয়র্ক, লস অ্যাঞ্জেলসের মতো শহরগুলোতে জাঁকজমকপূর্ণ ক্যাম্পেইন করে। সেখানে স্বাধীন চিত্রশিল্পী, লেখক, অভিনয়শিল্পী, পরিচালকসহ অন্যদের যুক্ত করা হলো। কিন্তু ২০১৮ এর মাঝামাঝি এসে সব চিত্রই যেন পাল্টে গেলো। এতে জড়িত অসংখ্য মানুষ যেন অচেনা হয়ে গেলো ইউটিউবের কাছে। প্লাটফর্মটি এত বছর ধরে যারা আজকের অবস্থায় নিয়ে আসলেন, তাদের কী আর প্রয়োজন নেই?
মোলোয় কলেজের নিউ মিডিয়ার প্রফেসর জেমি কোহেন বলেন, এমনকি ইউটিউবের সঙ্গে যুক্ত নন এমন মানুষগুলোও বুঝতে পারছেন যে, ইউটিউব ধীরে ধীরে টেলিভিশনে পরিণত হচ্ছে। কিন্তু তা ইউটিউবারদের জানানো হয়নি।
এখন যারা ইউটিউবের জন্যে ভিডিও বানাবেন তাদের পক্ষে প্লাটফর্মটির বর্তমান অ্যালগোরিদমের সঙ্গে খাপ খাইয়ে ওঠা কঠিন বিষয়। এখন লেট-নাইট শো’গুলোর মতো গতানুগতিক ও মূলধারার অনুষ্ঠানগুলো ইউটিউব নিয়ন্ত্রণ করবে। সঙ্গে থাকবে মিউজিক ভিডিও।
লোগান পলের পোডকাস্টে ড্যানি বললেন, দেড় বছর আগেও সব ঠিক ছিল। আমরা যা মন চাইতো তাই করতে পারতাম। আমরা ইচ্ছামতো ভিডিও আপলোড করতাম। কিন্তু প্রতিটা ভিডিও থেকে আসা অর্থ বাদ দেয়া হলো। আমরা সবাই এখানে আটকে গেলাম। অথচ এসব ভিডিও তৈরিতে সৃষ্টিশীলতা রয়েছে আমাদের।
ড্যানি বা তার ভাই এবং পলের মতো তারকারা ইউটিউবের আচরণ দেখতে দেখতে ক্লান্ত। তারা আবারো অনন্য সব আইডিয়া নিয়ে ইউটিউবে ফিরে আসতে চান। কিন্তু আগের আর ফিরবে কিনা তা নিয়ে বেশ শংসয় আছে।
সূত্র: দ্য ভার্জ