জমাটি আড্ডা চলছিল। কথা বলতে বলতে আচমকা কথাটা কেমন যেন জড়িয়ে গেল অমিতের। অন্যেরা কে কী বলছেন বুঝতেও সমস্যা হচ্ছিল তাঁর। সঙ্গে মাথার মধ্যে এক অচেনা ব্যথা। ব্যস, তার পর আর কিছুই মনে নেই…। জ্ঞান ফিরল হাসপাতালের বেডে।

অফিস থেকে বাড়ি ফিরছিলেন সুতনুবাবু। দিব্য সুস্থ মানুষ। সহকর্মীদের সঙ্গে হাসতে হাসতে বাসেও উঠলেন। হঠাৎই বিজবিজে ঘাম সারা শরীরে। তার পরেই জিভ শুকিয়ে কথা জড়িয়ে বাসেই পড়ে গেলেন। চিকিৎসকরা জানালেন, মিনিট খানেকের স্ট্রোক অ্যাটাকেই মৃত্যু হয়েছে তাঁর।

এ রকম নানা ছবি কম-বেশি সকলেরই পরিচিত। স্ট্রোকের আচমকা হানায় মৃত্যু বা অঙ্গহানি কোনওটাই অসম্ভব নয়। জানেন কি, বিশ্বের ৮ কোটি মানুষ স্ট্রোকে আক্রান্ত? এঁদের মধ্যে ৫ কোটিরও বেশি মাঝবয়সী ও বয়স্ক। ‘ওয়ার্ল্ড স্ট্রোক অর্গানাইজেশন’ (ডব্লিউএসও)-এর এক সাম্প্রতিক সমীক্ষায় এই তথ্য উঠে এসেছে। আশঙ্কার কথা, প্রতি বছর প্রায় ২ কোটি মানুষ স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। আজ, ২৯ অক্টোবর বিশ্ব স্ট্রোক দিবসে এই মারাত্মক অসুখটি সম্পর্কে সাবধান করলেন নিউরোমেডিসিন বিশেষজ্ঞ অংশু সেন।

এই মুহূর্তে বিশ্বের প্রতি ছ’জন মানুষের এক জন স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। আমাদের দেশে সংখ্যাটা হয়তো কিছুটা বেশি। অথচ একটু সচেতন হলেই এই রোগ এড়ানো যায় অনায়াসে। স্ট্রোক সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করতে ডব্লিউএসও ২০০৬ সালে ২৯ অক্টোবর দিনটিকে ‘বিশ্ব স্ট্রোক দিবস’ হিসাবে পালন করার সিদ্ধান্ত নেয়। তার পর থেকে প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আমাদের দেশেও ওয়ার্ল্ড স্ট্রোক ডে পালন করা হচ্ছে। স্ট্রোক হওয়ার পর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে গেলে নির্দিষ্ট চিকিৎসা দরকার। এ বারের এই বিশেষ দিনটির থিম: ‘সাপোর্ট ফর লাইফ আফটার স্ট্রোক।’ অর্থাৎ স্ট্রোক হওয়ার পরে রোগীকে রিহ্যাবিলিটেশন ও সঠিক চিকিৎসার সাহায্যে স্বাভাবিক জীবনের আলোয় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা।

বিশ্বে প্রতি দশটি মৃত্যুর একটি হয় স্ট্রোকের কারণে। আর পঙ্গুত্বের জন্য ঘরবন্দি হয়ে বাকি জীবন কাটানোর পিছনেও একটিই কারণ, তা হল ব্রেন স্ট্রোক। একটু সতর্ক হলেই এই মারাত্মক রোগটি প্রতিরোধ করা সম্ভব। তাই প্রত্যেকেরই উচিত স্ট্রোকের কারণ ও তা প্রতিকারের উপায় সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা।

স্ট্রোক কেন হয়?

  • মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল বন্ধ হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ উচ্চ রক্তচাপ। বিশেষ করে অনিয়ন্ত্রিত রক্তচাপ থাকলে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে। ওয়ার্ল্ড স্ট্রোক অর্গানাইজেশন-এর সমীক্ষা অনুযায়ী, প্রতি ১০০ জন রোগীর মধ্যে ৪৮ জনেরই হাই ব্লাড প্রেশার থাকে। প্রেশারের ওষুধ নিয়ম করে না খেলে প্রেশার বেড়ে গিয়ে আচমকা স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
  • যাঁদের সারা দিন চেয়ারে বসে কাজ করতে হয়, হাঁটাচলা-সহ কায়িক পরিশ্রম তেমন নেই বললেই চলে, তাঁদের এই রোগের ঝুঁকি অন্যদের থেকে বেশি। সমীক্ষায় জানা গিয়েছে, ১০০ জন স্ট্রোকের রোগীর মধ্যে ৩৬ জনেরই জীবনশৈলীতে তেমন কোনও নিয়ম মানার ‘নিয়ম’ নেই।
  • যাঁদের রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি, তাদেরও স্ট্রোকের সম্ভাবনা বেশি। প্রসঙ্গত এলডিএল ও ভিএলডিএল কোলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রাধিক্য এবং ভাল কোলেস্টেরল এইচডিএল কম থাকলে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে প্রায় ২৭ শতাংশ।
  • সহজপাচ্য সুষম খাবারের পরিবর্তে ভাজাভুজি, জাঙ্ক ফুড বেশি খেলে আচমকা স্ট্রোক আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। দেখা গিয়েছে যে, স্ট্রোকে আক্রান্তদের ২৩ শতাংশ এই ধরনের খাবারে আসক্ত।
  • সেন্ট্রাল ওবেসিটি অর্থাৎ ভুঁড়ি থাকলে আচমকা ব্রেন স্ট্রোক হতে পারে।  ১৯ শতাংশ স্ট্রোকের রোগীর সেন্ট্রাল ওবেসিটি আছে।
  • মানসিক চাপ স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। স্ট্রেস ও ডিপ্রেশন-সহ অন্যান্য মানসিক সমস্যা থাকলেও এই সমস্যার সম্ভাবনা থাকে। স্ট্রোকের রোগীদের ১৭% মানসিক চাপের শিকার।
  • ধূমপানে আসক্তি অন্যান্য অনেক অসুখের সঙ্গে সঙ্গে স্ট্রোকের ঝুঁকিও বাড়ায়।
  • মদ্যপানে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে।
  • হার্টের অসুখ থাকলে ব্রেন স্ট্রোকের ঝুঁকি বেশি।
  • যাঁরা ডায়াবিটিসে ভুগছেন ও ডায়েট বা শরীরচর্চা করেন না, তাঁদেরও স্ট্রোকের সম্ভাবনা অনেক বেশি।
  • লক্ষ করলে দেখবেন, স্ট্রোকের প্রায় প্রতিটা রিস্ক ফ্যাক্টরকেই কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। বিশেষ করে ব্লাড প্রেশার ও সুগার থাকলে নিয়মিত চেক আপ ও শরীরচর্চা করা দরকার। ওজন ঠিক রাখতে হবে। বাইরের খাবার ও ফাস্ট ফুড এড়িয়ে পুষ্টিকর সহজপাচ্য খাবার খাওয়া দরকার।

স্ট্রোক ঠিক কী?

স্বাভাবিক ভাবে বাঁচতে গেলে আমাদের প্রতিটি কোষের চাই অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্ত। মস্তিষ্কের কোষও তার ব্যতিক্রম নয়। হাই প্রেশার, সুগার-সহ নানা রিস্ক ফ্যাক্টর মস্তিষ্কের রক্তবাহী ধমনীর পথ রুদ্ধ করে দেয়। এ দিকে রক্তে ভেসে থাকা চর্বির ডেলা আচমকা ধমনিতে আটকে গিয়ে রক্ত চলাচল বন্ধ করে দিতে পারে। ফলে মস্তিষ্কের কোষ অক্সিজেনের অভাবে নিস্তেজ হতে হতে অকেজো হয়ে যায়। এই ব্যাপারটাই স্ট্রোক। সাধারণত দু’ধরনের স্ট্রোক হয়— ইস্কিমিক আর হেমারেজিক।

ইস্কিমিক স্ট্রোকে রক্ত চলাচল থেমে যায়। আর হেমারেজিক স্ট্রোকে দুর্বল রক্তনালী ছিঁড়ে গিয়ে রক্তপাত হয়। আর আছে ট্র্যানসিয়েন্ট ইসকিমিক অ্যাটাক বা টিআইএ। কোনও ছোট রক্তের ডেলা মস্তিষ্কের রক্তবাহী ধমনিতে সাময়িক ভাবে আটকে গিয়ে কিছু ক্ষণের জন্য রোগীর সামান্য কিছু সমস্যা ও ব্ল্যাক আউট হওয়ার ঝুঁকি থাকে। আপাত দৃষ্টিতে মারাত্মক না হলেও টিআইএ-র পরে বড় অ্যাটাকের ঝুঁকি থাকে। তাই অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনতে হবে।

 

স্ট্রোক আটকাতে পারেন নিজেরাই

বংশে স্ট্রোকের হানা আগেও এলে একটু বেশি সাবধান হোন।  থাকলে নিয়মিত প্রেশার, ব্লাড সুগার, কোলেস্টেরল-সহ প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করাতে হবে। ব্লাড প্রেশার আর সুগার থাকলে তা তো নিয়ন্ত্রণ করতেই হবে। আর ধূমপানের সঙ্গে ডিভোর্স মাস্ট। একই সঙ্গে নিয়ম করে সপ্তাহে অন্তত পাঁচ দিন আধ ঘণ্টা করে দ্রুত পায়ে হাঁটুন। আর ভুঁড়ি বাড়তে দেবেন না। নিয়ম করে ছয় থেকে আট ঘণ্টা ঘুমোতে হবে। ঘুম কম হলে ব্লাড প্রেশার আচমকা বেড়ে গিয়ে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। যদি আচমকা অল্প সময়ের জন্যে ব্ল্যাক আউট হয়, হাত পা বা শরীরের কোনও একদিক হঠাৎ অবশ লাগে, কিংবা চোখে দেখতে বা কথা বলতে অসুবিধে হয় অথবা ঢোক গিলতে কষ্ট হয়, কোনও ঝুঁকি না নিয়ে নিজেরা চিকিৎসা না করে রোগীকে অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে।

এমন কিছু সাধারণ নিয়ম মানলেই এড়িয়ে যেতে পারেনএমন অসুখ। বিশ্ব স্ট্রোক দিবসে তাই নিজের জীবনশৈলীতে ভারসাম্য এনে রুখে দিন এই রোগকে।