class="post-template-default single single-post postid-10164 single-format-standard wp-custom-logo group-blog vl-boxed aa-prefix-matin-">
Shadow

কেন সুন্দরী প্রতিযোগিতার পক্ষে, কেনই বা বিপক্ষে : তসলিমা নাসরিন

বাংলাদেশে সুন্দরী প্রতিযোগিতা চলছে। এই সুন্দরী প্রতিযোগিতার ব্যাপারটি আমাকে বরাবরই খুব বিচলিত করে। একবার আমি মেয়েদের পণ্য করার বিরুদ্ধে ভীষণ রাগ করি, আরেকবার মেয়েদের বোরখা আর হিজাবের মধ্যে বন্দি করার বিরুদ্ধে এই প্রতিযোগিতার পক্ষে দাঁড়াই।

সুন্দরী প্রতিযোগিতা নিয়ে আমার পুরোনো মন্তব্যকে যদি খ-ন করি নিজেই, কী ভাবে করবো এ নিয়ে ভাবছি। আবার এও ভাবছি, আজ যে যুক্তি দিচ্ছি, সেই যুক্তির বিরুদ্ধেও যদি দাঁড়াই, কীভাবে দাঁড়াবো।

বেশ অনেক বছর আগে আমি বলেছি : ‘সহস্র প্রসাধন সামগ্রী আজ বাজারে কেন? কাদের ব্যবহারের জন্য? এর উত্তর আমরা সবাই জানি। মেয়েদের। আমার প্রশ্ন, কেন মেয়েদের এসব ব্যবহার করতে হবে? কেন মেয়েদের আসল চেহারাকে আড়াল করতে হবে নানান রঙ দিয়ে? কেন বানাতে হবে নকল একটি মুখ? নকল চোখ, নকল ঠোঁট, নকল গাল? এই প্রসাধন সামগ্রী ব্যবহার করে মেয়েরা, কারণ নিজেদের সত্যিকার চেহারা নিয়ে তারা হীনমন্যতায় ভোগে। কে এই হীনমন্যতাবোধটি জাগালো? কে বলেছে মেয়েদের মুখে কোনও ত্র“টি আছে, তাই অজস্র প্রসাধন মেখে সেই মুখকে ত্র“টিমুক্ত করতে হবে! ত্র“টিমুক্ত করলে তারা সুন্দরী আখ্যা পাবে!’

আজ বলছি : মেয়েদের যদি ইচ্ছে করে মুখে রঙ মাখতে, মাখুক। আমাদের শরীরে ত্রুটি নেই, কে বলেছে? শরীরের হাড় থেকে শুরু করে ত্বক সব জায়গায় অজস্র ত্র“টি। আমাদের ত্বক যে সবসময় ময়শ্চারাইজার ছাড়া ভালো থাকে, তা তো নয়! প্রকৃতি সবসময় মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য মঙ্গলজনক নয়। প্রাকৃতিক সবকিছুকে আমরা বিনা প্রশ্নে মেনে নিই না। প্রকৃতি থেকে আমরা অনেক নিয়েছি, আবার প্রাকৃতিক বিপদ থেকেও সাবধান হয়েছি। প্রকৃতি আমাদের যে শরীর দিয়েছে, তা আমাদের পছন্দ করতেই হবে কেন? কেন আমরা যেমন করে আমাদের নিজেকে দেখতে ভালো লাগে, তেমন করে সাজাবো না? প্রকৃতিকে আমরা প্রতিদিন চ্যালেঞ্জ করছি। রোগ শোক দিচ্ছে, প্রতিরোধ করছি। করছি না? প্রাকৃতিকভাবে কারো ত্বক তৈলাক্ত, কারো ত্বক শুকনো। কারো ত্বক সহজেই নানা রোগ জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয়, কারো ত্বক হয় না। আমরা আবিষ্কার করেছি কোন ত্বকের জন্য কী ব্যবহার করা ত্বকের স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। তা ছাড়া কেউ যদি মনে করে কিছু রঙ মাখলে তাকে ভালো দেখাচ্ছে, তাহলে রঙ মাখাই তার জন্য ভালো। তার মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। যদি মেয়েরা রঙ মাখলে মেয়েদের প্রতি পুরুষের আকর্ষণ বাড়ে, তবে মেয়েরা রঙ তো মাখবেই। পুরুষেরা যে পোশাক পরলে, চুলের যে কায়দা করলে মেয়েদের পছন্দ হয়, পুরুষেরা তাই পরার এবং করার চেষ্টা করে। পরস্পরের কাছে নিজেকে আকর্ষণীয় করার জন্য প্রাণিকুলের মধ্যে যে আকুলতা, সে আকুলতা মানুষের মধ্যেও বেশ ভালো পরিমাণেই আছে। চিরকালই ছিল। যে পুরুষ বা নারী বুদ্ধিমত্তায় আকৃষ্ট, তারা শরীরের আকার আকৃতি, মুখম-লের সৌন্দর্যের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমত্তাই দেখে। এরকম মানুষের সংখ্যা খুবই কম। সব মানুষকে আমরা ধরে বেঁধে বুদ্ধির সাগর বানাতে পারবো না। মানুষ সব এক নয়, তাদের চরিত্র, তাদের রুচিবোধ ভিন্ন। এখন পর্যন্ত শারীরিক সৌন্দর্য নারী পুরুষ উভয়কে বেশি আকর্ষণ করে। আমিও মুখে রঙ মাখি, সে রঙ কড়া নয়। আমার এক বন্ধু মুখে সামান্যও রঙ মাখে না, আরেকজন মাখে কড়া রঙ। আমি কিন্তু কাউকেই অপছন্দ করি না। রঙ একেবারেই না মাখা এবং বেশি মাখা যার যার রুচি। আদিকাল থেকেই নারী পুরুষ উভয়ে মুখে রঙ মাখতো। এখনও মাখে। আমার মনে হয় আরও দীর্ঘকাল এই রঙ মাখামাখি চলবে।

আগে বলেছি : পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী হচ্ছে পণ্য। পুরুষের ভোগের সামগ্রী। কেউ মানুক না মানুক, এ কথা সত্য। ঠিক যে রকম রূপ হলে পুরুষের উত্তেজনা জাগে, নারীবস্তুটিকে সেই রকম হতে হয়। এই নারীবস্তুটিকে ঠিক সেই রকম দেখতে শুনতে হতে হয়, যে রকম হলে পুরুষের শরীর এবং মনের আরাম হয়। নারীকে জম্ম  থেকে মৃত্যু অবধি যে সাজগুলো এবং যে কাজগুলো করতে হয়, তার সবই পুরুষ এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজের স্বার্থ রক্ষার জন্য। নারীর সতীত্ব, মাতৃত্ব, মত ও নম্র চরিত্র-রক্ষা সবই পুরুষের স্বার্থে। পুরুষ যেন নারীকে তার অধিকৃত সম্পত্তি এবং ক্রীতদাসী হিসেবে চমৎকার ব্যবহার করতে পারে। নারীকে কুক্ষিগত করার নানা রকম পদ্ধতির চল আছে। সবচেয়ে আধুনিক পদ্ধতির নাম প্রেম। প্রেম, নারীকে, এমনকী সবল নারীকেও এমন দুর্বল করে, এমন গলিয়ে ফেলে যেন পুরুষের চর্ব্য চোষ্য লেহ্য পেয় হওয়া ছাড়া নারীর আর কোনও উপায় না থাকে। সংসার মঞ্চে স্ত্রীর ভূমিকায় যাওয়ার আগে প্রেমিকার মহড়া চলে। এই মহড়ায় প্রেমিক পুরুষটির জন্য ত্যাগে এবং তিতিক্ষায় যথেষ্ট দক্ষতা দেখাতে পারলে নারী উতরে যায়।

আজ বলছি : আগের প্রতিটি কথাই ঠিক। তাহলে কি এর সমাধান নারীর সুন্দরী প্রতিযোগিতায় না দাঁড়ানো? সৌন্দর্যকে এত হেলা করারও তো কোনও যুক্তি নেই। যদিও সৌন্দর্যের সংজ্ঞা একেক দেশে একেক রকম ছিল। এখন বিশ্বায়নের কারণে হোক বা পাশ্চাত্যের প্রভাবেই হোক, সৌন্দর্যের এখন একটিই সংজ্ঞা। পরিবর্তন হচ্ছে, হবে। এখনকার সৌন্দর্যের সংজ্ঞাও একদিন পাল্টাবে। পুরুষদের মধ্যে কে বেশি নিষ্ঠুর, কে বেশি প্রাণী হত্যা করতে পারে, কে বেশি আঘাত করতে পারে, এরকম প্রতিযোগিতার চল ছিল, এখনও আছে। তার চেয়ে কে বেশি দেখতে ভালোর প্রতিযোগিতা ঢের ভালো। প্রাণী মাত্রই বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করে। পুরুষের আধিপত্যের বিরুদ্ধে গেলে নারীর বেঁচে থাকাই কঠিন হয়ে পড়ে। আর সব প্রাণীর মতোই পুরুষের আধিপত্যকে মেনে নিয়ে নিজের নির্যাতক আর ধর্ষকের সঙ্গে নারী আপস করে চলে। নারীর অধিকার সম্পর্কে নারীর জ্ঞান বুদ্ধি নেই, এ হয়তো সম্পূর্ণ ঠিক নয়। কিন্তু জ্ঞান বুদ্ধি থাকলেই নারীর একার পক্ষে সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ পুরুষকেই নিতে হবে, যেহেতু পুরুষের হাতেই সব ক্ষমতা।

আজ বলছি : সুন্দরীর সংজ্ঞা স্থান কাল ভেদে ভিন্ন রকম ছিল। আগে গায়ে গতরে মাংস থাকলে সুন্দরী এবং স্বাস্থ্যবতী বলা হতো। এখন যত হাড়সর্বস্ব হবে, যত রুগ্ন দেখতে হবে, না-খাওয়া-চেহারা হবে, তত সে সুন্দরী বলে বা পণ্য বলে গণ্য হবে। উনিশ শতকের চিত্রকলায়, ভাস্কর্যে নারীদের ভারী তলপেট দেখলে মনে হয় বুঝি সকলেই সন্তানসম্ভবা। পেটের মেদ ঝরানোর কোনও নিয়ম তখন তৈরি হয়নি। এখন নিয়ম তৈরির পর শিল্পও বদলে গেছে। শিল্পও তো বেশ রমরমা শিল্প এখন।

চারদিকে শরীরের স্বাভাবিক মেদ মাংস ঝরানোর প্রতিযোগিতা চলছে। বিশেষ করে তরুণীদের মধ্যে। অনেকে বলে, ঠাকুরমা দিদিমারা অনেক বেশি স্বাধীন ছিল এই জমানার মেয়েদের চেয়ে। তারা অনেক বেশি নিশ্চিন্তে ছিল তাদের যা আছে তাই নিয়ে। নিজেদের শরীরের গড়ন নিয়ে তাদের হীনমন্যতায় ভুগতে হতো না, নাক চোখ মুখ পরিবর্তনের জন্য চাপও অনুভব করতো না। হ্যাঁ, আগে যেমন তেমন দাসী হলেই চলতো। এখন সুন্দরী দাসী চাই। দিন দিন পুরুষের চাহিদা বাড়ছে। আর বাজার পরিকল্পনায় চাহিদা মাফিক নারী-পণ্য তৈরির ব্যবস্থা জোরদার হচ্ছে। শক্তিশালী মিডিয়া এবং মার্কেট সুন্দরী নারীর মডেল বা স্যাম্পল দেখিয়ে দিয়েছে, এখন এই ট্র্যাপে মেয়েরা টুপটুপ করে পড়ছে। সুন্দরী অসুন্দরী দু জাতের মাথায় স্বাভাবিকভাবেই মারাত্মক একটি চাপ। অসুন্দরীকে সুন্দরী হতে হবে, সুন্দরীকে সুন্দরীই থেকে যেতে হবে। এই চাপে, মস্তিষ্ক সেই মেয়েদের যত না ভোঁতা, তার চেয়েও ভোঁতা হচ্ছে আরও। তাবৎ সম্ভাবনার ইতি ঘটিয়ে নিজেদের বেশ্যায় পরিণত করছে মেয়েরা। বেশ্যালয়ে বাস করে অভদ্র বেশ্যা, আর বেশ্যালয়ের বাইরে বাস করে ভদ্র বেশ্যা। দুজনেরই কাজ পুরুষকে মুগ্ধ করা, পুরুষকে আমোদ আহ্লাদ দেওয়া, যারপরনাই আনন্দ দেওয়া। শারীরিক সৌন্দর্যই এই পচা পুরোনো পিছিয়ে থাকা সমাজে একটি মেয়ের প্রধান সম্পদ। সম্পদহীন মেয়ের জীবন রাস্তার কুকুর বেড়ালের মতো, দুর্বিষহ। বিশ্বায়নের ফলে পশ্চিমা দেশের সুন্দরীর সংজ্ঞা এখন ছড়িয়ে গেছে সর্বত্র। সংজ্ঞা অন্তঃস্থ করছে আপামর জনগণ। চীন জাপানের মেয়েরাও এখন চোখ বড় করতে চাইছে, নাক টিকোলো করতে চাইছে। পারলে জিন পাল্টে দেয়। ডিএনএ’র দিক নিশানা ঘুরিয়ে দেয়। পশ্চিমা দেশের পুরুষেরা নারীর ঠ্যাং দেখে পুলকিত হয়। ঠ্যাং নিয়ে আদিখ্যেতা কিন্তু ভারতবর্ষ কখনও করেনি। কিন্তু হালের বিশ্বায়ন পশ্চিমের ঠ্যাং পুবে এনে ছেড়েছে। এখন ঠ্যাং দেখিয়ে মেয়েরা হাঁটা চলা করতে বাধ্য হচ্ছে। প্যান্ট বা স্কার্ট ওপরে উঠতে উঠতে নিতম্ব ছুঁই ছুঁই করছে। ভরা গালের সৌন্দর্যও এখন ভাঙা গালে এসে ঠেকেছে। পণ্যের আধুনিকীকরণ হচ্ছে, একই সঙ্গে নারীপণ্যের গায়েও যুগের হাওয়া। দখিনী হাওয়ার বদলে পশ্চিমী হাওয়া।

আজ বলছি : যে কোনও পরিবর্তন মেনে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। মানুষের ইতিহাস খুব পুরোনো নয়। অন্য প্রজাতিকে পেছনে ফেলে জঙ্গল থেকে উঠে এসে মানুষ নামের প্রজাতি আজ পৃথিবী শাসন করছে, শরীরের শক্তি দিয়ে নয়, বুদ্ধি দিয়ে। মানুষ সভ্য হচ্ছে, আরও সে সভ্য হবে। তবে মানুষের বুদ্ধি যদি আজও লিংগ বৈষম্য ঘোচাতে না পারে, এ মানুষেরই অক্ষমতা। মানুষের আরও অনেক অক্ষমতার মধ্যে এটি সবচেয়ে ভয়ানক।

আগে বলেছি : আমার বড় ভয় হয়। আরও ঘোর পিতৃতন্ত্রের কাদায় আমাদের সমাজসংসার ডুবে যাচ্ছে দেখে ভয়। ভয়ে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে সমাজে প্রতিষ্ঠিত উচ্চ শিক্ষিত বিজ্ঞানমনস্ক স্বনির্ভর মেয়েদের যখন ভয়াবহ সাজসজ্জার চেহারা দেখি। কেন তাদের আত্মবিশ্বাসের অভাব! যদি তাদেরই অভাববোধ থাকে, তবে সাধারণ পরনির্ভর মেয়েদের উপায় কী হবে? সহস্র বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিঁড়ে বেরোনোর সংগ্রাম নারীরা কী করে করবে যদি নিজের শরীর নিয়ে তাদের নিজেরই লজ্জা পেতে হয়! মুখে চুনকালি না মাখলে যদি সে নিজেকে যোগ্য মনে না করে চোখ তুলে তাকাবার, তবে শৃঙ্খল ছেঁড়া তো হবেই না, বরং আরও কঠিন শৃঙ্খলে সে নিজেকেই জড়াবে আরও।

পশ্চিমের নারীবাদী আন্দোলন তুঙ্গে উঠেছিল ষাটের দশকে। কুৎসিত পুরুষতন্ত্রের গালে কষে থাপ্পড় লাগিয়ে নারী তার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছিল। রক্ষণশীল পুরুষেরা তখন নীরবে নারীর উত্থান হজম করলেও এখন উগরে দিচ্ছে। হজম শেষ পর্যন্ত হয় না ওদের। এখন নারীকে পুতুল বানানোর চেষ্টাই তখনকার সেই সফল নারী আন্দোলনের প্রতিক্রিয়া। এখন নারীকে একশ বছর পেছনে টেনে নেওয়ার ষড়যন্ত্র চলছে। নারী আবার শেকল পরো, সাজো, সুন্দরী হও, ঘরে বাইরে সুন্দরী প্রতিযোগিতার দৌড়ে কোমর বেঁধে নেমে পড়ো, এখন নারী-মাংস বিক্রির হাট বসাও চারদিকে। দুঃখ এই, পশ্চিমের নারীবাদী আন্দোলন এই ভারতবর্ষে এলো না, এলো তার ব্যাকল্যাশ, এলো নারীকে পণ্য করার সবরকম হৈ হুল্লোড়।

আজ বলছি : নারীবাদী আন্দোলন পৃথিবীর সর্বত্রই চলছে। নারীবিদ্বেষী পুরুষের যে সব দেশে জয় জয়কার, সে সব দেশে নারীবাদী আন্দোলনের তেজ কম। খুব স্বাভাবিক।

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!