Thursday, April 25
Shadow

ধ্রুব নীলের রম্য রচনা : বিজ্ঞানী মতিনের মহা আবিষ্কার

ধ্রুব নীলের রম্য রচনা

ধ্রুব নীলের রম্য রচনা


বিজ্ঞানী মতিন ক্রয়োনপাধ্যায়ের হাত সচরাচর কাঁপে না। তবে বোতামটা চাপতে গিয়ে দেখলেন আঙুলের ডগায় রিখটার মাপনী বসানো উচিৎ ছিল। আবিষ্কারের উত্তেজনায় হাত কাঁপছে! দীর্ঘ দশ বছরের সাধনা আজ চালু হতে যাচ্ছে! বোতামে চাপ দিতেই চোখ পিট পিট করে তাকাল বয-১। বয মানে ‘বাংলা যন্ত্রমানব’। পুরোপুরি বাংলা বলবে ও বুঝবে এ রোবট।
‘অভিবাদন গ্রহণ করুন মহান ক্রয়োনপাধ্যায়। বলুন আমি আপনার কী সেবায় আসতে পারি।’
রোবটের মুখে গায়কি ঢঙে বলা কথাগুলো শুনে বিজ্ঞানীর চোখে জল আসার উপক্রম। কোনোমতে পানি সামলে বললেন, ‘ওরে বযো, আমাকে এক গ্লাস পানি দে।’
‘আপনার নির্দেশনা বুঝতে পারিনি জনাব। দয়া করে বাংলায় পুনরাবৃত্তি করুন।’
আবেগের কান্নাটা মাঝপথে আটকে হেঁচকি হয়ে গেল। বিজ্ঞানী বুঝতে পারলেন না ঘটনা কী। রোবটটা বুঝলো না কেন? আবার বললেন বিজ্ঞানী, ‘বযো-১ আমাকে এক গ্লাস পানি দাও। ঠাণ্ডা পানি।’
‘আপনার নির্দেশনা বুঝতে পারিনি জনাব। দয়া করে বাংলায় পুনরাবৃত্তি করুন।’
নির্দেশনা না বুঝলে একই রেকর্ড বাজাতেই থাকবে। বিজ্ঞানীর মাথায় হাত। এত দিনের পরিশ্রম বুঝি…। ‘আরে! এ তো বাংলা ছাড়া বুঝবে না!’ ভুল বুঝতে পেরে আবার আবেগতাড়িত হয়ে গেলেন বিজ্ঞানী। সঙ্গে সঙ্গে গলা পরিষ্কার করে বললেন, ‘বযো, আমাকে এক পেয়ালা পানি দাও।’
‘আজ্ঞে জনাব। এখুনি দিচ্ছি।’
গ্লাস যে ইংরেজি শব্দ ভুলেই গিয়েছিলেন বিজ্ঞানী মতিন!


বয-১ কে নিয়ে সারা দেশে হইচই। বিশ্বের প্রথম বাংলা রোবটটা যা বলে তাই করে। বাংলায় বললেই হলো। সবার একটা করে চাই-ই। বিজ্ঞানীর কাছ থেকে যন্ত্রটার মেধাসত্ত্ব কিনে নিল একটা প্রতিষ্ঠান। এক মাসের মধ্যে দেশের সবার বাসায় চলে গেল একটা করে বয-১।


দুই দিনের মধ্য দেশজুড়ে হই হই রই রই। বয-১ নাকি কথা শুনছে না! প্রতিষ্ঠান বিরক্ত হয়ে সবাইকে বলে দিল, যা বলার বিজ্ঞানী মতিনকে বলুন। উনিই সমাধান দেবেন।
বিজ্ঞানী বজলুকে ফোন করলেন এক তরুণী।
‘উফ, স্যার, আপনাড় ড়োবটটা একটুও কথা শুনছে না। হোয়াট দ্য হেল। একটু আগেই বললাম, প্লিজ মার্কেটে গিয়ে একটা আই লাইনার নিয়ে আসো। শুনলোই না!’
বিজ্ঞানী মতিন ভাবলেন। তারপর বললেন, ‘খুকি এক কাজ করো। ওকে বলো, অনুগ্রহ করে বাজারে গিয়ে একটা চোখের রেখা অঙ্কন প্রসাধনী নিয়ে আসো, দেখো ঠিক কাজ করবে। ও তো ইংরেজি বোঝে না..।’
‘উফ শিট ম্যান! এসব কী কথা! তা এখন যদি আমার ফ্রায়েড রাইস আর চিকেন খেতে মন চায়, দেন হোয়াট শ্যুড আই সে?’
আচমকা কেন জানি মেজাজ খারাপ হয়ে গেল বিজ্ঞানী মতিনের। মনের একটা অংশ বলছে, উচিৎ কাজটাই করেছি! কিন্তু মেজাজ কিঞ্চিৎ সামলে নিয়ে বললেন, ‘তা হলে বলতে হবে, বাবা যন্ত্রমানব, তুমি দ্রুতগতির খাবারের দোকান হইতে ভাজা ভাত আর মুরগি নিয়ে আসো।’
‘ওহ ড্যাম। হাউ ক্যান আই.. ওহ.. লেট মি ট্রাই।’
লাইন কেটে দেবেন, এমন সময় আবার ফোন। এবার একটু বয়স্ক কণ্ঠ।
‘ইয়ে কদিন ধরে পায়ে ব্যথা। রোবটটাকে বললাম ভাই একটু মাসাজ করে দাও। শুনলোই না।’
‘বলুন, পা মর্দন করে দিতে। আর না হয় দলাই মলাই করে দিতে। আর না হয় বলুন পা দুটোকে ভর্তা বানিয়ে দাও।’
শেষের কথাটা বিজ্ঞানী রাগ করেই বলেছেন। রাগ না কমতেই আরেক তরুণের ফোন।
‘ইয়ো ডুড, বযকে বললাম ব্রেকফাস্ট বানাতে, দিল না। লাঞ্চটাও হলো না। একটা ফানি জোকস বলতে বললাম, সেটাও করলো না। ইটস নট ফানি ম্যান। আমি আমার টাকা রিটার্ন চাই।’
‘ব্যাটা সকালের নাস্তা আর দুপুরের খাবার বলতে কি তোর দাঁত ভাইঙ্গা যায়!’ মেজাজ নিয়ন্ত্রণ হারালো এবার। ‘আর আমার এই রোবট খাঁটি বাঙালি, তোর ওই ডুড ফুড মার্কা কথা হ্যায় বোঝে না। বাংলা কইতে পারলে সার্ভিস পাবি, আর না হয় পুশকুনিতে ডুব দে।’
‘ওহ হেল! বাই দ্য ওয়ে, হোয়াট ইজ পুশকুনি ম্যান?’
এভাবে দিনভর প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে মহাবিরক্ত বিজ্ঞানী যে-ই না ফোনটাকে আছাড় দিতে যাবেন অমনি ফোন এলো কেন্দ্রীয় ভাষা একাডেমি থেকে। ফোন করেছেন স্বয়ং মহাপরিচালক।
‘হ্যালো মতিন সাহেব! আপনাকে কী বলে যে ধন্যবাদ জানাই! আপনি একটা মহা আবিষ্কার করে ফেলেছেন মশাই! গত দশ বছরে আজই প্রথম অভিধান বিক্রি হলো। আপনার রোবটকে নির্দেশনা দিতে নাকি বাঙলা অভিধানের বিকল্প নেই। উফ একটা কাজ করেছেন মশাই!’
আবেগে আবারো চোখ টলোমলো বিজ্ঞানী মতিনের।


এক সপ্তাহ না যেতেই কয়েক লাখ বাংলা অভিধান বিক্রি হয়ে গেল। প্রথমে ক্রেতারা যতই বিরক্ত হোক না কেন, বয-১ কে আসলে কেউ হাতছাড়া করতে রাজি নয়। এ জন্য শুদ্ধ বাংলা শিখে নিচ্ছে সবাই।
ধীরে ধীরে গোটা বাংলাদেশে সবার বাংলা ভাষা শেখা হয়ে গেল। আগে যে টুকটাক কথায় ইংরেজি চলে আসতো, সেটাও এখন বন্ধ। ইংরেজি মাধ্যমে পড়ুয়া সুদর্শন তরুণীটি এখন রাস্তায় বিলেতি কুকুরছানা দেখে চিৎকার করে বলে ওঠে, ‘ওহ কুকুরছানাটা কী আদর আর নরম!’ (কথাটা হবে আদুরে আর তুলতুলে)। তরুণরা এখন রাস্তায় রূপবতী কাউকে দেখলে বন্ধুদের কানে কানে বলে, ‘বন্ধু, মেয়েটা খুব শীতল, তাই না রে!’ (কুল এর বাংলা তো শীতলই)। বিজ্ঞাপনের ভাষাও বদলে গেল। টিভি ছাড়তেই শোনা যায়, ‘বন্ধু ছাড়া জীবন অসম্ভব.. দূরালাপনীতে যত বেশি ব্যয় করবেন, ততই অতিরিক্ত পাবেন.. আমরাই প্রথম নিয়ে এলাম দিবারাত্রির বিশেষ বোঁচকা প্রস্তাব…। (বান্ডেল অফার-এর বাংলা তো এটাই হবে?)’


বয-১ চলে গেছে সুদূর আমেরিকার বাজারে। একজনের দেখাদেখি অনেকে কিনছে রোবটটা। অনেক কসরত করে নির্দেশনা দিতে হলেও ওরা খুশি। এত কম খরচে এত কাজের যন্ত্র ওরা আগে দেখেনি। এক রোবট দিয়েই বিশ্ব চিনে গেল বাঙালিকে। এমনকি বাংলাও শিখতে হচ্ছে তাদের। অবশ্য টুকটাক কাজের কথাগুলোই শিখছে তারা। এই যেমন বাজার হইতে এক সের চিচিঙ্গা লইয়া বাড়িতে ফিরিয়া আসো।


কয়েক বছর পর। আমেরিকান ভাষাবিদ ও কলাম লেখক ডেভিড নোলানের কপালে চিন্তার ভাঁজ। পত্রিকার জন্য মন্তব্য প্রতিবেদন লিখতে বসেছেন। বিষয়- আমাদের ভাষায় বাংলার আধিপত্য। ইংরেজিতে তিনি যা লিখছেন তার অনুবাদ করলে দাঁড়ায়-
‘ইদানীংকার তরুণ সমাজের ভাষা নিয়া আমি বড়ই চিন্তিত। কদিন ধরে খেয়াল করছি ওরা কথায় কথায় বাংলা বলে ফেলছে। এভাবে চলতে থাকলে ইংরেজি ভাষার ঐতিহ্য ও দীর্ঘদিনের সংস্কৃতি…।’

 

[লেখাটি ভালো লাগলে আমাদের লেখকদের জন্য নামমাত্র সম্মানি  পাঠাতে পারেন নগদ-এ নম্বর 01407-885500]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!

error: Content is protected !!