টবে বাহারী ফুলের চাষ
পৃথিবীতে ফুলের মতো সুন্দর আর পবিত্র কোনো কিছু নেই। কিন্তু সেই সুন্দরকে কাছে রেখে উপভোগ করার সৌভাগ্য কয়জনের হয়? বিশেষ করে আমরা যারা শহরে থাকি তাদের তো ফুলগাছ লাগানোর জমিই নেই। বিল্ডিংয়ের ছাদ, বারান্দা, না হয় সিঁড়িঘরটাই ভরসা। সেখানে তো আর মাটি নেই। মাটি ছাড়া ফুলগাছ কেমন করে হবে? তাই পোড়ামাটির টবে কাঁচা মাটি রেখে তার ভেতর দুই-চারটা ফুলগাছ লাগিয়ে সে আনন্দ পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু মুশকিল হলো, সব ফুলের গাছ আবার টবে ভালো হয় না। বিশেষ করে বৃক্ষজাতীয় দীর্ঘজীবী ফুলগুলো টবে বেশি না লাগানোই ভালো। বিভিন্ন মৌসুমি ফুল টবের জন্য সবচেয়ে ভালো। তবে যে ফুলগাছই লাগানো হোক না কেন সেগুলো যেন রোদ পায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। একটু হিসাব করে পরিকল্পনামতো টবে ফুলগাছ লাগালে সারা বছরই কিছু না কিছু ফুলের দেখা পাবেন।
টবে কী কী ফুলগাছ লাগাবেন গ্রীষ্ক্নকালে টবের জন্য বেছে নিতে পারেন গন্ধরাজ, রজনীগন্ধা, সুর্যমুখী, জিনিয়া, পিটুনিয়া, সিলোসিয়া বা মোরগঝুঁটি, দোপাটি, ক্যালিয়েন্ড্রা বা মণিকুন্তলা, ব্রানফেলসিয়া বা বিচিত্রা ইত্যাদি। বর্ষার ফুল হিসেবে টবের জন্য ভালো হবে হাইড্রেঞ্জিয়া, বেলি, জুঁই, চাঁপা, পত্রলেখা বা মুসেন্ডা, তুষারমোতি বা পোর্টল্যান্ডিয়া, দোপাটি, জিনিয়া, সুর্যমুখী (ছোট), স্থলপদ্ম, মালতীলতা প্রভৃতি। শীতকালে টবে লাগাতে পারেন গাঁদা, গোলাপ, ন্যাস্টারশিয়াম, প্যানজি, পিটুনিয়া, ভারবেনা, ক্যামেলিয়া, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, কারনেশন, স্যালভিয়া, গোলাপ, জারবেরা, এজালিয়া ইত্যাদি। সারা বছর ফোটে এমন ফুলের মধ্যে রয়েছে কাঞ্চন (সাদা), জবা, কামিনী, করবী, অলকানন্দা বা অ্যালামন্ডা, জয়তী বা জ্যাট্রোফা, হাজারপুটিয়া, নয়নতারা, সন্ধ্যামালতী বা সন্ধ্যামণি ইত্যাদি। কয়েক বছর বাঁচা স্থায়ী স্বভাবের গাছগুলো হলো বেলি, জুঁই, বাগানবিলাস বা বোগেনভিলা, গোলাপ, জবা, করবী, গন্ধরাজ, কাঞ্চন, কুন্দ, চাঁপা, মুসেন্ডা, কামিনী, অ্যালামন্ডা, স্থলপদ্ম, পোর্টল্যান্ডিয়া, ব্রানফেলসিয়া, ক্যামেলিয়া, টগর, শিউলি, পয়েনসেটিয়া। ছাদবাগানের জন্য এসব গাছ ভালো। সেখানকার জন্য এই বর্ষাতেই এসব গাছের চারা জোগাড় করে লাগিয়ে ফেলতে পারেন। তবে কোনো পুষ্কপ প্রদর্শনীর উদ্দেশ্যে গাছ করার জন্য প্রদর্শনীর নির্ধারিত দিনের সঙ্গে নির্বাচিত গাছের প্রয়োজনীয় সময়ের হিসাব করে নিতে হবে। এ প্রসঙ্গে আর একটি কথা, বাগানের মাটিতে লাগানো গাছের ফুল ফোটার সময় টবের গাছের চেয়ে ১০-১২ দিন বেশি লাগবে।
তবে যাঁরা মাত্র কয়েকটা গাছ লাগিয়ে এবারই টবে গাছ লাগানোর হাতেখড়ি দিতে চান তাঁদের বলব, সহজে মরে না এবং একটু কম যত্ন নিলেও ফুল ফোটে, এমন সব গাছ লাগাতে। এ রকম ফুলের গাছগুলো বেশ পরিচিত, সহজে পাওয়া যায়। এর মধ্যে নয়নতারা, সন্ধ্যামণি, দোলনচাঁপা, কলাবতী, অ্যালামন্ডা, গাঁদা, বেলি, নাইটকুইন, হাসনাহেনা, রঙ্গন, মুসেন্ডা, কুঞ্জলতা, পর্টুলেকা বা টাইমফুল প্রভৃতি লাগানোর জন্য পছন্দ করতে পারেন। লাগাতে পারেন ফুল দেওয়া বিভিন্ন ক্যাকটাস (যেমন−ইউফরবিয়া), এগুলো সহজে মরে না।
টবে ফুলগাছ লাগাবেন কী করে প্রথমে গাছের সঙ্গে মানানসই সাইজের টব সংগ্রহ করতে হবে। তবে ছোট গাছের জন্য বড় টব হলে ক্ষতি নেই, কিন্তু বড় গাছের জন্য ছোট টব চলবে না।
প্রতি টবের জন্য দোআঁশ মাটির সঙ্গে তিন ভাগের এক ভাগ পরিমাণ জৈব সার বা পচা গোবর মিশিয়ে মাটি তৈরি করতে হবে। এর সঙ্গে একমুঠো হাড়ের গুঁড়ো, দুই চা-চামচ চুন, দু মুঠো ছাই মেশাতে পারলে ভালো হয়। এতে টবের মাটি দীর্ঘদিন উর্বর থাকবে।
মৌসুমি ফুলের ক্ষেত্রে মাসখানেক বয়সের ফুলের চারা টবে রোপণ করা উচিত। অন্য চারার বেলায় অল্পবয়সী ভালো ও তরতাজা, গাট্টাগোট্টা দেখে চারা বা কলম লাগানো ভালো। চারা লাগানোর পর আস্তে আস্তে চাপ দিয়ে গোড়ার মাটি শক্ত করে দিতে হবে। লাগানোর পর গোড়ায় পানি দিতে হবে।
গাছকে খাড়া রাখার জন্য অবলম্বনের প্রয়োজন হয়। গাছের চারা অবস্থা থেকেই এ ব্যবস্থা করতে হয়। এ কাজে বাঁশের কঞ্চি বা স্টিক ব্যবহার করা যেতে পারে।
সদ্য লাগানো ফুলের চারা কয়েক দিন ছায়ায় রেখে সহনশীল করে নিতে হয়। এ অবস্থায় সকালে ও বিকেলে রোদ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
টবে গাছের গোড়ার মাটি একেবারে গুঁড়ো না করে চাকা চাকা করে খুঁচে দেওয়া ভালো। এ ক্ষেত্রে মাটি খোঁচানোর গভীরতা হবে ৩-১০ সেন্টিমিটার বা ১ থেকে ৪ ইঞ্চি। এ কাজটি প্রতি ১০ দিনে একবার করে করতে হবে।
কুঁড়ি আসার লক্ষণ প্রকাশ পেলে ৫০ গ্রাম টিএসপি (কালো সার), ১০০ গ্রাম ইউরিয়া (সাদা সার) ও ২৫ গ্রাম এমওপি (লাল সার) একসঙ্গে মিশিয়ে প্রতি গাছে এক চা-চামচ করে ১০ দিন অন্তর দিতে হবে। তবে এক মৌসুমে এই রাসায়নিক সার তিনবারের বেশি দেওয়ার দরকার নেই। তবে রাসায়নিক সার ব্যবহারের সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন সার কোনোক্রমেই শিকড়ের ওপর না পড়ে। ট্যাবলেট সার দিলে এসব সার দেওয়ার আর দরকার নেই।
বেশি দিন ধরে ফুল ফোটাতে চাইলে গাছে কখনো ফুল শুকাতে দিতে নেই। ফুল শুকানো শুরু হলেই ফুল কেটে দিতে হয়। এতে ভালো ফুল পাওয়া যায়। গাঁদা, অ্যাস্টার, চন্দ্রমল্লিকা প্রভৃতি গাছ থেকে বেশি ফুল বেশি দিন ধরে পেতে চাইলে প্রথম দিকে আসা কিছু কুঁড়ি চিমটি দিয়ে ছেঁটে দিতে হবে।
লেখক: মৃত্যুঞ্জয় রায়
এগ্রোবাংলা ডটকম