class="post-template-default single single-post postid-18350 single-format-standard wp-custom-logo group-blog vl-boxed aa-prefix-matin-">
Shadow

নুসরাত হত্যাকাণ্ড : ছাদে ডেকে নেয় পপি কেরোসিন ঢালে শামীম আগুন দেয় জাবেদ

নুসরাতকে নুসরাতনুসরাত রাফিকে পুড়িয়ে হত্যা
দুই আসামির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি

 

মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি নুর উদ্দিন ও শাহাদাত হোসেন শামীম স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। তারা বলেছে, জেলখানা থেকে অধ্যক্ষের হুকুম পেয়ে রাফিকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। পরে হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নিয়েছিল দুই নারীসহ পাঁচজন। এদের মধ্যে এক ছাত্রী রাফিকে পরীক্ষাকেন্দ্র থেকে ডেকে ছাদে নিয়ে যায়। ছাদে আগে থেকে অপেক্ষমাণ ছিল আরেক নারীসহ চারজন। এরাই রাফির হাত-পা বেঁধে ফেলে এবং পরে শামীম ও জাবেদ তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সাংবাদিকদের এসব তথ্য দিয়েছেন।

গত রবিবার দুপুর ২টা ৫৫ মিনিট থেকে রাত ১টা পর্যন্ত প্রায় ১০ ঘণ্টা দুই আসামির জবানবন্দি রেকর্ড করা হয় ফেনীর বিচার বিভাগীয় জ্যেষ্ঠ হাকিম মো. জাকির হোসাইনের আদালতে।

আদালত সূত্রে জানা যায়, মূলত অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের এবং শামীমের প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় ক্ষুব্ধ হয়ে রাফিকে হত্যা করা হয় বলে আসামিদের জবানিতে বেরিয়ে এসেছে।

গত রবিবার রাত ১টা ৫ মিনিটে পিবিআইয়ের স্পেশাল অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড অপারেশন) তাহেরুল হক চৌহান এ বিষয়ে সাংবাদিকদের অবহিত করেন। তিনি বলেন, ‘গত ১০ এপ্রিল পিবিআই এ মামলার তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছে। দায়িত্ব পাওয়ার চার দিনের মধ্যে আমরা ঘটনার যারা মূল নায়ক, যারা ঘটনাটি ঘটিয়েছে, তাদের আইনের হাতে সোপর্দ করেছি। পিবিআই সদর দপ্তর এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তার তদন্তের ভিত্তিতে শুধু গ্রেপ্তারে সহায়তা করেছে। তদন্তকারী কর্মকর্তা আইনের মধ্যে থেকেই বিজ্ঞ আদালতের কাছে দুজনকে হাজির করেছেন। আদালত দীর্ঘ সময় ধরে তাদের বক্তব্য শুনেছেন এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। এ দুজন আসামি স্বতঃস্ফূর্তভাবেই সিআরপিসির ১৬৪ ধারায় আদালতের কাছে তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করেছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘তারা পুরো বিষয় খোলাসা করেছে। হত্যাকাণ্ডটি কারা ঘটিয়েছে, কিভাবে ঘটিয়েছে, কী প্রক্রিয়ায় ঘটিয়েছে বিস্তারিত বলেছে। কিন্তু মামলার তদন্তের স্বার্থে এখনই সব বলা হচ্ছে না।’

তাহেরুল হক চৌহান বলেন, ‘আসামিরা অপরাধ স্বীকার করেছে, তারা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। তারা জেলখানা থেকে হুকুম পেয়েছে বলেও জবানী প্রদানের সময় জানিয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ১৩ জনের নাম এসেছে। এ ছাড়া বিক্ষিপ্তভাবে কিছু নাম এসেছে। আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অন্যান্য তথ্য-উপাত্ত খতিয়ে দেখে সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারব।’

পিবিআইয়ের আরেক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, রাফির গায়ে আগুন দেওয়ার সময় নুর উদ্দিন হামলাকারীদের নিরাপত্তা এবং হামলার পর নিরাপদে বেরিয়ে যাওয়া নিশ্চিত করতে স্কুল গেটে অবস্থান করছিল। আর শামীম বাজার থেকে বোরকা ও পলিথিনে করে এক লিটার কেরোসিন সংগ্রহ করে মাদরাসায় নিয়ে যায়। ঘটনার সময় ওড়না দিয়ে রাফির দুই হাত পেছন থেকে এবং মুখ চেপে ধরে কাপড় দিয়ে বেঁধে ফেলা হয়। পরে তার গায়ে ঢেলে দেওয়া হয় কেরোসিন। রাফির গায়ে কেরোসিন ঢালে শামীম আর আগুন লাগিয়ে দেয় জাবেদ।

ওই কর্মকর্তা আরো দাবি করেন, রাফিকে পরীক্ষার হল থেকে ছাদে ডেকে নিয়েছিল পপি ওরফে শম্পা। রাফিকে বলা হয়েছিল, তার বান্ধবী নিশাতকে ছাদে মারধর করা হচ্ছে। ছাদে তখন অপেক্ষায় ছিল শামীম, জাবেদসহ চারজন।

পিবিআইয়ের আরেক কর্মকর্তা জানান, ঘটনার আগে কারাগারে গিয়ে অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার সঙ্গে দেখা করার পর রাত সাড়ে ৯টার দিকে মাদরাসার পশ্চিম হোস্টেলে সভা করেন নুর উদ্দিন, মাদরাসার হেফজ বিভাগের প্রধান আবদুল কাদেরসহ পাঁচজন। সেখানে কে বোরকা আনবে, কে কেরোসিন আনবে, কে কোথায় থাকবে, সে বিষয়ে পরিকল্পনা করা হয়। সেখানেই সিদ্ধান্ত হয় অধ্যক্ষের স্ত্রীর বড় বোনের মেয়ে পপিকে দিয়ে রাফিকে ডেকে পাঠানো হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী রাফিকে ডেকে নেয় পপি। কিন্তু রাফির সামনে দুর্বৃত্তরা কৌশল হিসেবে পপিকে ‘শম্পা’ নামে ডাকে। সে কারণেই রাফি জবানবন্দিতে শম্পার কথা বলে গেছে। এ ছাড়া আন্দোলন ও বোরকা কেনার জন্য ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাকসুদ আলম তাদের ১০ হাজার টাকা দেন। এক শিক্ষক দেন পাঁচ হাজার টাকা। পাঁচ হাজার টাকা দেওয়া হয় নুর উদ্দিনকে। আর তিনটি বোরকা কেনার জন্য শাহাদাতের চাচাতো বোনের পালিত মেয়েকে (ওই মাদরাসার ছাত্রী) দেওয়া হয় দুই হাজার টাকা।

কাউন্সিলর মাকসুদ ৫ দিনের রিমান্ডে : নুসরাত হত্যা মামলার ৪ নম্বর আসামি, সোনাগাজী পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও বহিষ্কৃত আওয়ামী লীগ নেতা মাকসুদ আলমকে পাঁচ দিনের রিমান্ড (জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজত) দিয়েছেন আদালত। গতকাল সোমবার দুপুরে বিচার বিভাগীয় জ্যেষ্ঠ হাকিম ও সোনাগাজী আমলি আদালতের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিচারক সরাফ উদ্দিন ওই রিমান্ড মঞ্জুর করেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ফেনী পিবিআইয়ের পরিদর্শক শাহ আলম সাত দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেছিলেন।

শম্পাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে : রাফি হত্যা মামলায় উম্মে সুলতানা পপি ওরফে শম্পাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে বলে জানিয়েছে পিবিআই। কয়েক দিন আগেই তাকে আটক করা হলেও গ্রেপ্তার দেখানোর বিষয়টি গতকাল নিশ্চিত করেন পিবিআই কর্মকর্তারা। তাঁরা বলেছেন, এই পপি ওরফে শম্পাই আগুন লাগানোর বোরকা এনে দিয়েছিল।

ফেনী পিবিআইয়ের অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার মনিরুজ্জামান এ তথ্য নিশ্চিত করে কয়েকজন সাংবাদিককে বলেন, উম্মে সুলতানা পপি ওরফে শম্পাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সে আগেই গ্রেপ্তার হয়েছে। সে রিমান্ডের আদেশপ্রাপ্ত। তাকে এখনো রিমান্ডে নেওয়া হয়নি।

রাফি মৃত্যুর আগে দেওয়া জবানবন্দিতে (ডাইং ডিক্লারেশন) শম্পার নাম বলেছিল।

ঘটনার পরপরই এজাহারভুক্ত সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ছাড়া সন্দেহভাজন যে ছয়জনকে আটক করা হয় তার মধ্যে উম্মে সুলতানা পপি ছিল। তবে পপিই যে শম্পা তা নিয়ে ধোঁয়াশা ছিল।

এর আগে রবিবার গভীর রাতে পিবিআইয়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তাহেরুল হক চৌহান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত যে চারজন তাদের সবাইকে আমরা গ্রেপ্তার করতে পারিনি। দুজন গ্রেপ্তার আছে, বাকি দুজনকে গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। যেকোনো সময় আপনাদের একটি ভালো খবর দিতে পারব।’

এর আগে বৃহস্পতিবার রাতে ময়মনসিংহের ভালুকা থেকে নুর উদ্দিনকে এবং পরদিন শুক্রবার সকালে মুক্তাগাছা থেকে শাহাদাত হোসেন শামীমকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই। রাফি হত্যা মামলায় নুর উদ্দিন ২ নম্বর এবং শাহাদাত হোসেন শামীম ৩ নম্বর আসামি।

আরেক শামীম গ্রেপ্তার : রাফিকে পুড়িয়ে হত্যায় জড়িত সন্দেহে সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার আলিম পরীক্ষার্থী মো. শামীমকে (১৯) গ্রেপ্তার করেছে পিবিআই। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও পিবিআইয়ের পরিদর্শক শাহ আলম জানান, গতকাল বিকেলে সোনাগাজী পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ড তুলাতলি থেকে তাকে আটক করা হয়। তার পিতার নাম মো. সফি উল্লাহ।

এ মামলায় এ পর্যন্ত ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা রিমান্ডে আছেন।

ঘাতকদের ফাঁসির দাবিতে সোনাগাজী উত্তাল

সোনাগাজী প্রতিনিধি জানান, নুসরাত জাহান রাফিকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবিতে গতকাল উত্তাল ছিল সোনাগাজী। দলমত নির্বিশেষে নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর সবাই সকাল ৯টা থেকে রাজপথে নেমে আসে। খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে মানববন্ধনে মিলিত হয় তারা।

মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশে অংশ নেয় আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, ইসলামী আন্দোলনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা। সকাল ১০টায় সোনাগাজী বাজারের জিরো পয়েন্টে তারা মানববন্ধন করে।

মানববন্ধনে বক্তব্য দেন সোনাগাজী পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রফিকুল ইসলাম খোকন, ইউপি চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন মিলন, সোনাগাজী আল হেলাল একাডেমির প্রধান শিক্ষক মো. আবদুল হক, চরচান্দিয়া ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান সামছুউদ্দিন খোকন, যুবদল নেতা খুরশিদ আলম, পৌর কাউন্সিলর ইমাম উদ্দিন ভূঞা, সাবেক পৌর কাউন্সিলর আবদুল মান্নান প্রমুখ।

মানববন্ধন শেষে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে সোনাগাজী বাজারের প্রধান সড়কগুলো প্রদক্ষিণ শেষে আলহেলাল একাডেমি মাঠে প্রতিবাদ সমাবেশ করা হয়। সেখানে দাহ করা হয় অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার কুশপুতুল।

বিকেল ৩টায় ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের উদ্যোগে সোনাগাজী বাজারের জিরো পয়েন্টে মানববন্ধন করা হয়। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে সোনাগাজী উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির উদ্যোগে এবং বিকেল ৫টায় সোনাগাজী উপজেলা ছাত্র অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে সোনাগাজী বাজারের জিরো পয়েন্টে মানববন্ধন করা হয়। ওই সময় বক্তারা নুসরাত হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের দ্রুততম সময়ে শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!