তেল, চিনি, ছোলা, পেঁয়াজ, ডালসহ কয়েকটি ভোগ্যপণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারে গত ছয় মাসে তেমন কোনো অস্থিরতা দেখা যায়নি। কোনো কোনো পণ্যের দাম পড়তির দিকে, যার প্রভাব রয়েছে দেশের বাজারেও। ওই সব পণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ থাকায় স্বাভাবিক আছে বাজার। তবে রমজান মাসে পেঁয়াজের বাজার নিয়ে কারসাজিতে মেতে উঠতে পারে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীর সিন্ডকেট। তদারকি সংস্থার কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী ও বিশ্লেষকরা মনে করেন, অসাধু ব্যবসায়ীদের ওই সিন্ডিকেট অকেজো রাখতে পারলে আসন্ন রমজানে ওই সব পণ্যের দাম হুট করে বেড়ে যাওয়ার সুযোগ থাকবে না।
আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সংযোগ নেই এমন কয়েকটি পণ্যের দাম অবশ্য এরই মধ্যে বেড়ে গেছে স্থানীয় বাজারে। মাছ, মাংস, ডিম ও সবজির বাজারে অস্থিরতা এখন চরমে। এই অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণে আনতে জরুরি কিছু পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাঁদের মতে, উৎসব ঘিরে বিভিন্ন দেশে বাজারে জিনিসপত্রের দাম কমে যায়। বাজারের স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী, পণ্য বিক্রির পরিমাণ বাড়লে মুনাফার হার কিছুটা কমিয়েও সামগ্রিকভাবে লাভবান হয়ে থাকেন ব্যবসায়ীরা। অথচ বাংলাদেশে বর্ধিত চাহিদার সুযোগ নিয়ে বাড়তি মুনাফা লুটতে মরিয়া হয়ে ওঠে একশ্রেণির ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ীদের এমন প্রবণতার কারণে উৎসবের সময় দাম বাড়ার আশঙ্কায় ভোক্তারাও আগেভাগে বেশি করে পণ্য কিনতে শুরু করে।
পেঁয়াজের মজুদ ও সরবরাহ পরিস্থিতি ভালো থাকা সত্ত্বেও দেশি পেঁয়াজের দাম কেজিপ্রতি পাঁচ টাকা বেড়েছে কয়েকদিন আগে। যদিও এবার দেশে পেঁয়াজের ফলন খুবই ভালো হয়েছে। স্বাভাবিক আছে আমদানি করা পেঁয়াজের দামও। দেশে পেঁয়াজের চাহিদা বছরে ২৪ লাখ টন। এর মধ্যে শুধু রমজান মাসেই লাগে পাঁচ লাখ টন। রমজানে এই বর্ধিত চাহিদার সুযোগে পণ্যটি নিয়ে অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের সক্রিয় হওয়ার আশঙ্কা করছেন অনেক বিশ্লেষক। প্রতি বছরই রমজানে বাজার অস্থির করে তুলতে বড় ভূমিকা রাখে এই পণ্যটি।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দ্রব্যমূল্য পর্যালোচনা ও পূর্বাভাস সেলের তথ্যমতে, বছরে ১৮ লাখ টন চাহিদার বিপরীতে চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে (গত ৯ মার্চ পর্যন্ত) ভোজ্য তেল (সয়াবিন, পাম অয়েল) আমদানি হয়েছে ১৪.৬৯ লাখ টন। আরো প্রায় ১৭.৬৬ লাখ টন আমদানির এলসি বা ঋণপত্র খোলা হয়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ভোজ্য তেল আমদানি হয়েছিল ২১.১৬ লাখ টন। আন্তর্জাতিক বাজারের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত ২৯ মার্চে অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের সিঅ্যান্ডএফ দর ছিল আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৯.১১ শতাংশ কম। আমদানি পরিস্থিতিতে কোনো সমস্যা না থাকায় প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১০৪-১০৬ টাকায় আর খোলা সয়াবিন ৮৪-৮৫ টাকায়।
সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরাই বলছেন, এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিনের দাম বাড়লেও স্থানীয় বাজারে রমজানে দাম বাড়ার সুযোগ নেই। কারণ রমজানের জন্য প্রয়োজনীয় সয়াবিন তেল বাজারজাতকারী কম্পানিগুলোর কাছে মজুদ আছে। এখন কোনো কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লেও সেই তেল আসতে অনেক সময় লাগবে। চিনি ব্যবসায়ীরাও বলছেন, বাজারজাতকারী কম্পানিগুলোর কাছে এ বছর চিনির মজুদও পর্যাপ্ত। এর দাম বাড়ার কোনো সুযোগ নেই।
সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিত সাহা বলেন, ‘আমাদের কাছে পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। দাম এখন যেমন আছে, রমজানেও সেরকমই থাকবে। বেড়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমরা সরকারকে সেটা জানিয়েছে।’
একইভাবে ছোলা ও মসুর ডালের বাজারও স্বাভাবিক। মাস দেড়েক আগে ডালের দাম কেজিপ্রতি ৫-১০ টাকা বাড়লেও বর্তমানে বাজার স্থিতিশীল।
বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনের তথ্যানুযায়ী, দেশে চিনির চাহিদা ১৮ লাখ টন। চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চিনি উৎপাদন হয়েছে ৩৬ হাজার টন। অর্থবছরের ৯ মাসে (গত ৯ মার্চ পর্যন্ত) আমদানি হয়েছে ১০.৭৩ লাখ টন। এলসি খোলা রয়েছে আরো ১২.৪৭ লাখ টন আমদানির। অর্থাৎ আমদানির ধারাবাহিকতা ঠিক আছে। চিনির আন্তর্জাতিক বাজারদর বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত ২৯ মার্চ অপরিশোধিত চিনির সিঅ্যান্ডএফ দর ছিল আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২.২৭ শতাংশ কম। আর পরিশোধিত চিনির দর ১.৬০ শতাংশ কম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা সুযোগ বুঝে দাম বাড়ানোর একটা পরিস্থিতি তৈরি করে রাখেন। ভোক্তারাও মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিয়ে থাকে যে রমজানে কিছু পণ্যের দাম বাড়বেই। দুই পক্ষের একই ধরনের মানসিকতার কারণে আমরা এখনো এই অবস্থার মধ্যে আটকে আছি। এ জন্য বেশি বিক্রি হলেও যে কম দামে পণ্য বিক্রি করা সম্ভব সে পথে বিক্রেতারা হাটেন না।’
এই অর্থনীতিবিদ মনে করেন, পণ্যের খুব বেশি পরিমাণ সরবরাহ এবং হঠাৎ কোনো ধরনের ‘শক’ যা ক্রেতাকে এসব পণ্য কেনা থেকে বিরত রাখতে পারে—এরকম অবস্থা তৈরি না হলে দাম কমার তেমন সুযোগ নেই। ‘শক’ বলতে কোনো পণ্য খেলে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হতে পারে এমন তথ্য প্রকাশিত হওয়াকে বুঝিয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন অবশ্য বলেন, ‘সবাই যদি রোজার আগে হুমড়ি খেয়ে না পড়ে তাহলে কোনো সমস্যা হবে না। কোনো কিছুই আগে না কিনে ঠিক রোজা শুরুর মুহূর্তে গিয়ে একসঙ্গে সব কিনতে চায়। এ থেকে বের হতে হবে।’ তিনি বলেন, তেল, চিনির মজুদ ভালো থাকায় দাম বাড়বে না। তবে বেগুন, মরিচসহ কিছু পণ্যের দাম অতিমাত্রায় বেড়ে যাওয়ার কারণ হলো জোগানটা ঠিক থাকে না। অতি চাহিদার বিপরীতে জোগানের স্বল্পতা দেখা যায়। সে কারণে দাম বাড়ে। তাঁর দাবি, বিক্রি বেশি হলে দাম কমবে এই যুক্তি তখনই খাটে যখন মজুদ পর্যাপ্ত থাকে। কাঁচা পণ্যের ক্ষেত্রে সেই মজুদ তৈরির সুযোগ কম।
এদিকে রমজান সামনে রেখে পেঁয়াজের আড়ত ও পাইকারি বাজারে অভিযান চালানোর কথা ছিল গতকাল মঙ্গলবার থেকে। তবে তা শুরু হয়নি। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কয়েকটি টিম আজ বুধবার থেকে নজরদারি শুরু করবে বলে জানা গেছে। প্রতিটি বস্তায় পেঁয়াজের দাম ও পরিমাণ লিখে রাখার কথা থাকলেও ব্যবসায়ীরা তা মানছেন না। অধিদপ্তরের টিমগুলো বিষয়টি খতিয়ে দেখবে। দেশের যে জায়গায় যে পণ্যের উৎপাদন বেশি সেখানেও যাতে কারসাজি না হয় সে বিষয়ে নজর রাখবে প্রতিষ্ঠানটি। এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কঠোর নির্দেশনা রয়েছে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. শাহরিয়ার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মাংস, পেঁয়াজ, রসুন, আদা—কোনোটাতেই যেন সিন্ডিকেট করতে না পারে সে বিষয়ে তদারকি করব। বুধবার থেকে আমাদের চারটি করে টিম বাজারে কাজ করবে। প্রথম ধাপেই আমরা বিভিন্ন আড়তে যাব।’ তিনি বলেন, ‘সিন্ডিকেট করে কেউ যাদে দাম না বাড়াতে পারে তার জন্য সর্বোচ্চ তদারকি করব।’
প্রায় দেড় মাস ধরে অস্থিরতা চলছে মুরগির বাজারে। ব্রয়লার মুরগির দাম তিন ধাপে বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ১৭০-১৭৫ টাকা কেজি দরে। বছরের শুরুতেও এই দর ছিল ১২৫-১৩৫ টাকা। ডিমের দামও এখন চড়া। গরুর মাংসের বাজারেও অস্থিরতা চলছে। মাংস ব্যবসায়ী নেতারাই বলছেন, যে যেভাবে পারছে সেভাবে ব্যবসা করছে। এখানে সংগঠন কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। তাদের মতে, ব্যবসায়ীরা সরকারের কাছে কিছু প্রতিকার চেয়েছিলেন, যার একটি হলো অবৈধ চাঁদা নেওয়া বন্ধ করা। গাবতলী গরুর হাটে বর্তমানে গরুপ্রতি ৫০০ থেকে ৫০০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয়। অথচ সেখানে ইজারাদারদের নেওয়ার কথা ১০০ টাকা। পথে পথেও চাঁদাবাজি হয়। প্রতিবছর রমজানের আগে সিটি কর্পোরেশন মাংসের দাম বেঁধে দিলেও এবার ব্যবসায়ীরা তা মানবেন না বলে জানান।
ঢাকা মহানগরী মাংস ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব রবিউল ইসলাম বলেন, ‘বাজারে এমন অরাজকতা কখনো দেখা যায়নি। যে যার মতো ব্যবসা করছে, দাম নিচ্ছে। কেউ বলার নেই। এর জন্য আমাদের কিছু দাবি ছিল। সেটাতেও সরকার গুরুত্ব দেয়নি। দাম বেঁধে দিলেও আমাদের কিছু করার থাকবে না।’
অস্থির হয়ে উঠেছে মাছের বাজার। যদিও সরবরাহ সংকট তেমন নেই। তবে মৌসুম পরিবর্তনের কারণে বিভিন্ন সবজির দাম চড়ে গেছে। বিভিন্ন জেলার বড় আড়তগুলোতে সবজির দাম খতিয়ে দেখবে ভোক্তা অধিদপ্তর।সূত্র : কালের কণ্ঠ
https://www.youtube.com/watch?v=r0t64gzuqtg