সংঘবদ্ধ চক্রের (সিন্ডিকেট) মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণের অভিযোগে বন্ধ হয়ে যায় বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজার মালয়েশিয়া। নতুন কর্মী নিয়োগ হচ্ছে না আট মাসের বেশি সময়। এতে অন্তত এক লাখ লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ হারিয়েছে বাংলাদেশ। অথচ ওই চক্রের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সরকার। দ্রুত বাজার চালু না হলে কমে যাবে প্রবাসী আয়ের (রেমিট্যান্স) প্রবাহ।
প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের কর্মী পাঠানোর ব্যাপারে অন্তর্বর্তীকালীন প্রক্রিয়া চালু করতে দুই দেশের জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ (জেডব্লিউজি) একাধিকবার বৈঠক করলেও সংকটের সুরাহা হয়নি। অভিযোগ তদন্তে মালয়েশিয়া সরকারের গঠিত স্বাধীন কমিটি ইতিমধ্যে একটি খসড়া প্রতিবেদন তৈরি করেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশে উচ্চ আদালত ছয় মাসের মধ্যে অভিযোগ তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দিতে বলেছিলেন মন্ত্রণালয়কে। কিন্তু সেই সময়সীমা পার হয়ে গেছে। এখন মন্ত্রণালয় সময় বাড়ানোর আবেদন করবে বলে জানা গেছে। গত বছর তদন্ত কমিটি করা হলেও থমকে আছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধান। বরং পুনরায় এ বাজারের নিয়ন্ত্রণ নিতে ওই সংঘবদ্ধ চক্র চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
গত বছর একতরফা ও অনৈতিকভাবে ব্যবসা পরিচালনার মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর অভিযোগ ওঠে বাংলাদেশের ১০ রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে। এই ১০ এজেন্সি সিন্ডিকেট হিসেবে পরিচিতি পায়। এর সঙ্গে জড়িত দুই দেশের সরকারি-বেসরকারি লোকজন। এই চক্রের বিরুদ্ধে সরকারি খরচের অতিরিক্ত ৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে শ্রমবাজার বন্ধ করে দেয় মালয়েশিয়া।
প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ওই চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার চেয়ে এখন বাজার চালু করায় সরকারের মনোযোগ বেশি। বাজার চালু করতে ১৪ মে কুয়ালালামপুরে দুই দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী ইমরান আহমদের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল যাচ্ছে এ সফরে।
এ বিষয়ে প্রবাসীকল্যাণসচিব রৌনক জাহান প্রথম আলোকে বলেন, নতুন করে যাতে কোনো চক্র তৈরি না হয়, এ জন্য কঠোর নজরদারি থাকবে। তবে বাজার বন্ধ করার ক্ষেত্রে দায়ীরা অবশ্যই শাস্তি পাবে। এখন বাজার চালু করাটাকেই বেশি প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে।
তিন মাসে মাত্র ৫৫ জন
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর থেকে নতুন করে কোনো বাংলাদেশি কর্মীকে ভিসা দেয়নি মালয়েশিয়া। তবে এর আগে ভিসা পাওয়া কর্মীরা সেপ্টেম্বরের পরও মালয়েশিয়া গেছেন। সব মিলিয়ে ২০১৮ সালে মালয়েশিয়ায় গেছেন ১ লাখ ৭৫ হাজার ৯২৭ জন।
গত বছরের প্রথম তিন মাসে কর্মী গেছেন ৩৮ হাজার ৮৬৫ জন। এ বছরের প্রথম তিন মাসে গেছেন মাত্র ৫৫ জন। অথচ গত বছর প্রতি মাসে গড়ে কর্মী গেছেন প্রায় ১৫ হাজার। এ হিসাবে বাজার চালু থাকলে গত ৮ মাসে নতুন করে এক লাখের বেশি কর্মী চাকরি পেতেন বলে মনে করেন শ্রমবাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
কমবে প্রবাসী আয়
মালয়েশিয়ায় একজন কর্মী মাসে ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা আয় করেন। কিন্তু সেখানে মাসের পর মাস বাজার বন্ধ থাকায় একপর্যায়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে প্রবাসী আয়ে।
জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণত বিদেশে যাওয়ার পর একজন কর্মীকে দেশে টাকা পাঠানোর পর্যায়ে পৌঁছাতে ৮ থেকে ১২ মাস সময় লেগে যায়। তাই কর্মী যাওয়ার সংখ্যা বাড়া-কমার সঙ্গে সঙ্গেই প্রবাসী আয়ের প্রবাহে প্রভাব পড়ে না।
বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, ধারাবাহিকভাবে প্রতিবছর বাড়তে থাকলেও ২০১৩ সালে কমে যায় প্রবাসী আয়। এর আগে টানা চার বছর সৌদি আরব ও মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানি কার্যত বন্ধ ছিল। ২০১৪ ও ২০১৫ সালে প্রবাসী আয় বাড়লেও ২০১৬ ও ২০১৭ সালে আবার তা কমে যায়। যদিও ২০১৭ সালে রেকর্ড ১০ লাখের বেশি কর্মী বিভিন্ন দেশে যান। ফলে ২০১৮ সালে জনশক্তি রপ্তানি কমলেও রেকর্ড প্রবাসী আয় আসে দেশে।
প্রস্তুতি প্রায় চূড়ান্ত মালয়েশিয়ার
সম্প্রতি মালয়েশিয়ার মানবসম্পদমন্ত্রী এম কুলাসেগেরান দেশটির গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, নতুন লোক নিয়োগের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। বিশেষ করে নেপাল ও বাংলাদেশের কর্মী নেওয়ার প্রক্রিয়া শিগগিরই শুরু করা হতে পারে।
গত বছর একজন বিচারপতির নেতৃত্বে বিদেশি কর্মী-বিষয়ক স্বাধীন কমিটি গঠন করে মালয়েশিয়ার সরকার। নতুন কর্মী নিতে একটি সমন্বিত কাঠামোর প্রস্তাব করেছে কমিটি। কমিটির খসড়া প্রতিবেদনে একটি অনলাইন জব পোর্টাল খোলার সুপারিশ করা হয়েছে। মালয়েশিয়ান রিক্রুটিং এজেন্সি (এমআরএ) নামে ওই পোর্টালে নিয়োগকর্তারা তাঁদের চাহিদা জানাতে পারবেন এবং কর্মীরাও আবেদন করতে পারবেন। নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানকে আড়াই লাখ মালয়েশিয়ান মুদ্রা জামানত দিয়ে নিবন্ধন করতে হবে। কোনো কর্মীর বেতন-ভাতা বকেয়া হলে কিংবা ক্ষতিপূরণ প্রয়োজন হলে জামানত থেকে অর্থ কেটে কর্মীকে পরিশোধ করা হবে। চাকরির আবেদন জমা দেওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে জবাব দেবে এমআরএ। এ প্রক্রিয়া চালু হলে মধ্যস্বত্বভোগী নিয়ে সৃষ্ট সংকটের সমাধান হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
অবশ্য বাংলাদেশের জনশক্তি খাতের একাধিক ব্যবসায়ী ও মন্ত্রণালয়ের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ১০ এজেন্সির চক্র অনেক শক্তিশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। নতুন করে আবারও বাজার চক্রটি দখলে নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মালয়েশিয়া সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে তারা সুবিধা করতে পারছে না।
জানতে চাইলে জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বায়রার মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বাজার চালু হলে কর্মী পাঠাতে সব এজেন্সির সমান সুযোগ রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সরকার। তা করা হলে কোনো চক্র বাজার নিয়ন্ত্রণের সুযোগ পাবে না।
২০০৭-০৮ সালে চার লাখের বেশি বাংলাদেশি কর্মী মালয়েশিয়া গিয়েছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের নানা অব্যবস্থাপনা ও মালেয়িশায় বেকারত্ব বেড়ে যাওয়ায় ২০০৯ সালে শ্রমবাজারটি বন্ধ হয়ে যায়। ২০১২ সালের নভেম্বরে দুই দেশের মধ্যে জিটুজি চুক্তি সই হয়। এতেও অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় বেসরকারি জনশক্তি রপ্তানিকারকদের যুক্ত করে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে জিটুজি প্লাস চুক্তি হয়। এর মাধ্যমে ২০১৬ সালে ৪০ হাজার ১২৬ জন ও ২০১৭ সালে ৯৯ হাজার ৭৮৭ জন কর্মী মালয়েশিয়া যান। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে বারবার হোঁচট খাচ্ছে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারের সম্ভাবনা কাজে লাগানোর সুযোগ।
অভিবাসন খাতের বেসরকারি সংস্থা রামরুর পরিচালক সি আর আবরার প্রথম আলোকে বলেন, অভিযোগ খতিয়ে দেখে জড়িতদের শাস্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সরকার। কিন্তু সমস্যা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ দৃশ্যমান হয়নি। সম্ভাবনাময় এ বাজার অন্যদের দখলে চলে গেলে বিরাট সুযোগ হারাবে দেশ।