দেশেই লিভার ডায়ালিসিস
নতুন এ চিকিৎসাপদ্ধতি বিশ্বে প্রথমবারের মতো বিএসএমএমইউতে প্রয়োগ করে বেশ সফলতা মিলেছে
সম্প্রতি প্রথমবারের মতো দেশে চালু হয়েছে লিভার বিলিরুবিন ডায়ালিসিস। নতুন এ চিকিৎসা সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়েছেন বিএসএমএমইউর লিভার বিভাগের অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)
যাদের জন্য প্রযোজ্য
বাংলাদেশে প্রথম লিভার ডায়ালিসিসের রোগী ৫৫ বছর বয়স্ক মো. সিরাজুল ইসলাম হক, যিনি লিভার সিরোসিস ও লিভার ফেইলিওরের রোগী ছিলেন। তাঁর বিলিরুবিন সব সময় বেশি থাকত (সর্বশেষ ছিল ৮)। প্রচলিত চিকিৎসা প্রয়োগ করেও বিলিরুবিন কোনোভাবেই কমানো সম্ভব হয়নি। এরপর তাঁকে লিভার বিলিরুবিন ডায়ালিসিসের জন্য বাছাই করা হয় এবং একপর্যায়ে তা সফলভাবেই প্রয়োগ করা হয়। ডায়ালিসিসের পর তিনি এখন অনেকটাই ভালো আছেন এবং শারীরিক উন্নতি বুঝতে পারছেন।
লিভার রোগের অন্যতম উপসর্গ হলো জন্ডিস, যাতে রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে যায়। সাধারণ ভাইরাল হেপাটাইটিস থেকে শুরু করে একিউট লিভার ফেইলিওর, লিভার সিরোসিসজনিত ক্রনিক লিভার ফেইলিওর, এমনকি লিভার ক্যান্সার হলেও জন্ডিস দেখা দিতে পারে। ভাইরাল হেপাটাইটিসে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জন্ডিস নিজে নিজেই ভালো হয়ে যায়। কিন্তু লিভারের অন্য জটিল রোগগুলোর ক্ষেত্রে অনেক সময় তা প্রাণ সংশয়ের কারণ হয়। কখনো কখনো জন্ডিসের কারণে রোগীর চিকিৎসাও বন্ধ করে দিতে হয়। যেমন : লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত কোনো রোগীর বিলিরুবিন পাঁচের ওপর গেলে তখন আর কিছুই করার থাকে না। দুই বা তিনের মধ্যে থাকলে হয়তো চিকিৎসা করা যায়।
লিভার সিরোসিসের কোনো রোগীর পেটে পানি এলে, রক্তবমি হলে, কিডনিতে সমস্যা দেখা দিলে, রোগী অজ্ঞান হয়ে গেলে—এসবের চিকিৎসা রয়েছে। এমনকি লিভার ক্যান্সারের মতো রোগেরও খুব ভালো চিকিৎসা আছে। কিন্তু সমস্যা হয়, যখন রোগীর বিলিরুবিন বেড়ে যায় বা জন্ডিস ধরে। লিভার ফেইলিওরজনিত এই জন্ডিসের ক্ষেত্রে চলমান চিকিৎসাবিজ্ঞান এখনো অসহায়। এ ক্ষেত্রে ধন্বন্তরি চিকিৎসা হলো লিভার সংযোজন বা ট্রান্সপ্লান্টেশন, যা সারা বিশ্বেই অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এ ছাড়া রয়েছে ডোনার সংকট, যা ছাড়া ট্রান্সপ্লান্ট সম্ভব নয়। ভারতেই লিভার ট্রান্সপ্লান্ট বাবদ খরচ হয় কমপক্ষে ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকা। বাংলাদেশে এটা পুরোপুরি চালু করা সম্ভব হয়নি। ভবিষ্যতে লিভার ট্রান্সপ্লান্টেশন চালু হলে হয়তো ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকার মতো খরচ হবে। তাই জন্ডিসে দীর্ঘ মেয়াদে ভুগতে থাকা রোগী কিংবা লিভার ফেইলিওরের রোগী, যাদের প্রচলিত চিকিৎসাপদ্ধতি প্রয়োগ করেও তেমন উপকার হচ্ছে না, তাদের ক্ষেত্রে এই লিভার বিলিরুবিন ডায়ালিসিস হতে পারে জীবণরক্ষাকারী বিকল্প চিকিৎসা।
যেভাবে করা হয় লিভার ডায়ালিসিস
বিএসএমএমইউতে লিভার বিলিরুবিন ডায়ালিসিস নিয়ে দু-তিন বছর ধরে গবেষণা ও কাজ করা হচ্ছে। একদল লিভার, ট্রান্সফিউশন মেডিসিন ও হেমাটোলজি বিশেষজ্ঞ ক্রনিক লিভার ফেইলিওর রোগীদের দেহে এক বছরের বেশি সময় ধরে সফলতার সঙ্গেই স্টেমসেল থেরাপি প্রয়োগ করে আসছেন। সম্প্রতি শুরু হয়েছে লিভার বিলিরুবিন ডায়ালিসিস। এই দুই চিকিৎসাপদ্ধতিতেই ব্যবহার করা হয়েছে নিজস্ব উদ্ভাবনী ও লাগসই প্রযুক্তি।
রক্ত থেকে প্লাটিলেট আলাদা করার কাজটি করে হেমাটোলজি বিভাগের অ্যাফেরেসিস মেশিন। আমরা সেই অ্যাফেরেসিস মেশিন মডিফাই করে তার সঙ্গে দুটি ফিল্টার লাগিয়েছি। এরপর বিশেষ কিট ও ফিল্টার যন্ত্রের সাহায্যে বিলিরুবিন ছেঁকে ফেলা রক্ত আবার রোগীর শরীরে প্রবেশ করিয়ে লিভার ডায়ালিসিস করি। এ পদ্ধতিতে লিভার ডায়ালিসিসের জন্য কোনো বাড়তি অ্যালবুমিন ট্রান্সফিউশনের দরকার হয় না। কিডনির হেমো ডায়ালিসিসের মতোই এই পদ্ধতিতে লিভারের রোগীর ক্ষতিকারক উপাদান বিলিরুবিন রক্ত থেকে সরিয়ে নেয়। এতে রোগী তাত্ক্ষণিকভাবে আশাতীত ভালো বোধ করেন এবং শারীরিক উন্নতি বুঝতে পারেন। এটাই হলো নতুন পদ্ধতির লিভার বিলিরুবিন ডায়ালিসিস।
লিভার ডায়ালিসিস খরচাপাতি
আধুনিক বিশ্বে লিভার ডায়ালিসিসের জন্য ‘মার্স’ ও ‘প্রমিথিউস’ নামে দুটি মেশিনের সীমিত ব্যবহার রয়েছে। এই মেশিনগুলোর দাম বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১০ কোটির মতো, যাতে প্রচুর অ্যালবুমিন ট্রান্সফিউশনের দরকার হয়। ডায়ালিসিস বাবদ এতে প্রতি সেশনে খরচ হয় তিন থেকে চার লাখ টাকা। আমাদের টিম প্লাজমা অ্যাফেরেসিস মেশিনকে মডিফাই করে ফিল্টার লাগিয়ে লিভার বিলিরুবিন ডায়ালিসিসে সফল হয়েছেন। এতে খরচ কমেছে এক-দশমাংশ। এই প্রক্রিয়ায় তিনবার ডায়ালিসিস করা যায়, যাতে প্রতিবার খরচ পড়ে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকার মতো।
হতে পারে আশাজাগানিয়া
দেশে প্রায় দুই কোটি লোক হেপাটাইটিস ‘বি’, ‘সি’ কিংবা ফ্যাটি লিভারের মতো লিভারের নানা রোগে আক্রান্ত। পাশাপাশি হেপাটাইটিস ‘এ’ ও ‘ই’র মতো অ্যাকিউট হেপাটাইটিস ভাইরাসগুলোর প্রকোপও অনেক বেশি। দেশে প্রতিবছর প্রায় ২০ হাজারের মতো লোক লিভারের রোগে মৃত্যুবরণ করে। সার্বিক সহযোগিতা পেলে নতুন আশাজাগানিয়া স্টেমসেল থেরাপি ও লিভার বিলিরুবিন ডায়ালিসিস ভবিষ্যতে অনেক রোগীকে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরিয়ে আনবে, এমনটি আশা করা যেতেই পারে।
https://www.youtube.com/watch?v=Geg0SPadJxM&feature=youtu.be&fbclid=IwAR2HglGA9JSXIEbcvEWF0-NSYX9OzQEZymVGMbPrRjOZLDTmhxxrotcebkA