Monday, December 23
Shadow

গানের তালে তালে কখনও তারা নীচু হয়ে বসে যাচ্ছে, আবার কখনো দাঁড়াচ্ছে

একটা স্কুলকক্ষের ভেতরকার দৃশ্য। হাতে গাঁদা ফুলের মালা নিয়ে সারি বেঁধে এগিয়ে আসছেন কয়েকজন ছাত্রী। সবার বয়সই বারো-চৌদ্দ বছরের মধ্যে হবে, এর বেশি কারো নয়। তারা যেখানে এসে দাঁড়ালো, সামনে চেয়ারে বসে আছেন বেশ কয়েকজন বয়স্ক মানুষ। মালাগুলো তারা দোলাচ্ছে ধীরে ধীরে, একবার সামনে নিচ্ছে, আবার পিছিয়ে আনছে। পেছনে বাজছে ডি-এল রায়ের বিখ্যাত গান ‘ধনধান্যে পুষ্পে ভরা…আমাদের এই বসুন্ধরা’, সেই গানের তালে তালে কখনও তারা নীচু হয়ে বসে যাচ্ছে, আবার কখনো দাঁড়াচ্ছে। হুট করে দেখলে মনে হতে পারে, কোন ধ্রুপদী নৃত্যের রিহার্সেল চলছে বুঝি! কিংবা অদ্ভুত কোন ধর্মীয় প্রথা পালন করা হচ্ছে কিনা!

ছাত্রীদের গায়ের স্কুল ইউনফর্ম দেখে সেটাতেও ধন্ধ লাগতে পারে। কিছুক্ষণ মালা নিয়ে ছেলেখেলা করার পরে সেগুলো একে একে পরিয়ে দেয়া হলো সামনে উপবিষ্ট মানুষগুলোর গলায়। তারাও হাসিমুখে মালা বুঝে নিয়ে নিজ নিজ আসনে গ্যাট হয়ে বসে রইলেন! অদ্ভুত একটা দৃশ্য বটে! এরকমই একটা ভিডিও গতকাল ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সেখানে মালা পরিহিত অবস্থায় মধ্যমণি হয়ে বসে থাকতে দেখা গেছে যশোর-২ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মনিরুল ইসলাম মনিরকে!

ঘটনাটা কবেকার সেটা জানা যায়নি কিছু এখনও। তবে ফেসবুকে আপলোড হওয়া সেই ভিডির নিচে কমেন্টবক্সে কয়েকজন জানিয়েছেন, এটা যশোরের ঝিকরগাছার কোন স্কুলই হবে। কারন যে সংসদ সদস্যকে সেখানে দেখা যাচ্ছে, তিনি ওই এলাকারই সাংসদ। এই অদ্ভুত দৃশ্য দেখে মোটামুটি থ হয়ে গেছেন সবাই। এভাবে যে কাউকে অভিবাদন জানানো যায়, বা বিদ্যালয়ে বিশেষ কোন অতিথির আগমন উপলক্ষ্যে যে ছাত্রীদের দিয়ে এমন অদ্ভুত কাজ করানো হয়, সেটা আগে কেউ দেখেননি জীবনে।

ভাইরাল হওয়া সেই ভিডিওতে দেখা গেছে, ছাত্রীরা লাইন ধরে এগিয়ে আসছে ফুলের মালা নিয়ে, সেগুলো অতিথিদের গলায় পরিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্ত সরাসরি মালা না দিয়ে যে অদ্ভুত কোরিওগ্রাফিটা করানো হলো ছাত্রীদের দিয়ে, এই আইডিয়াটা কার মাথা থেকে বেরিয়েছিল কে জানে! প্রায় তিন-চার মিনিট ধরে এই কমেডি সার্কাস চলেছে, কাউকে দেখা যায়নি এই ভাঁড়ামীটা বন্ধ করার জন্যে বলতে, কেউ এটার প্রতিবাদও করেননি। পুরো ভিডিওতে সবচেয়ে দৃষ্টিকটু যেটা লেগেছে, সেটা হচ্ছে মুজিব কোট গায়ে দিয়ে প্রসন্ন মুখে সংসদ সদস্যের বসে থাকাটা।

ছাত্রীদের দিয়ে যে বিদঘুটে একটা পারফরম্যান্স করানো হলো, কেউ সেটার প্রতিবাদ করলেন না একবারও, কেউ বললেন না এই ফাজলামিটা থামাতে। যে গানটা মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে প্রচারিত হতো মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা দেয়ার জন্যে, সেই গানের তালে তালেই মালা হাতে ওঠাবসা করছে ছাত্রীরা, কখনও অতিথিদের পায়ের কাছেও বসে পড়েছে, কিন্ত সামনাসামনি এসব দেখেও কারো কোন বিকার হয়নি।

আর ভিডিওতে এই দৃশ্যটা দেখেই আমরা শিউরে উঠেছি, লজ্জায় গা রি রি করে উঠেছে। অথচ সাংসদের পাশে যারা বসে ছিলেন, তারা সবাই মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বা আওয়ামী লীগের নেতা। মনিরুল আলম মনির নিজেও তো আওয়ামী লীগেরই সাংসদ। বঙ্গবন্ধুর নামাঙ্কিত মুজিব কোট পরে তিনি কি করে উপভোগ করেছেন এই নাচটা, সেটাই ভেবে পাই না। তার কি একবারও মনে হলো না যে কাজটা ঠিক হচ্ছে না? কিংবা বাকি যেসব ‘গণ্যমান্য’ অতিথিরা সেখানে উপবিষ্ট ছিলেন, কারোই কি মাথায় আসেনি যে বিষয়টা ভীষণ দৃষ্টিকটু লাগছে? নাকি সংবর্ধনা বা আগমনী শুভেচ্ছা পাবার আনন্দে সব ভুলে গিয়েছিলেন তারা?

এক ফেসবুক পোস্টে মনিরুল আলম মনির অবশ্য নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেছেন, এই ডিসপ্লে-টি হবার কথা ছিল স্কুল মাঠে। কিন্ত মাঠ ভেজা থাকায় ক্লাসরুমেই সেটা করতে হয়। সেইসঙ্গে তিনি দাবী করেছেন, এই ফুলেল শুভেচ্ছার দিক নির্দেশনা দিয়েছেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, সেই শিক্ষককে তিনি বিএনপিপন্থী বলে আখ্যায়িত করেছেন। ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতিও নাকি বিএনপির এক রাজনীতিবিদ।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপির রাজনীতি করা শিক্ষক বা বিএনপির রাজনীতিবিদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তিনি কেন প্রধান অতিথি হয়ে উপস্থিত হলেন, যেখানে তার জানা ছিলই যে এই লোকগুলো তার ‘সম্মান ক্ষুণ্ণ’ করার চেষ্টা করবে! এটা কি পুরোপুরি ব্লেইম গেম হিয়ে গেল না? নিজের গা বাঁচাতে অন্যের দিকে বন্দুক তাক করার মতো?

কিছুদিন আগে এক জনপ্রতিনিধি আলোচনায় এসেছিলেন এক স্কুলে বিচিত্র রকমের অভিবাদন নিয়ে, সেখানকার ছাত্রদের উপুড় করিয়ে বানানো ‘মানব ব্রীজ’ এর ওপর দিয়ে হেঁটে পার হয়েছিলেন তিনি! সেটা নিয়ে প্রচণ্ড সমালোচনা হয়েছিল। পরে সেই জনপ্রতিনিধিকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। তিনিও আওয়ামী লীগের রাজনীতিবিদই ছিলেন। এত বছর রাজনীতি করেও এই মানুষগুলো কি এসব পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে শেখেননি? কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ, সেসবের ভেদাভেদটা কি তারা জানেন না? নইলে এমন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের অংশ কি করে হন তারা? এসব রাজনীতিবিদদের কারণে আওয়ামী লীগকে মানুষ গালি দেয়, এই রাজনীতিবিদেরা যখন মুজিব কোট গায়ে চাপিয়ে এমন সব নৃত্যানুষ্ঠান উপভোগ করেন, তখন বঙ্গবন্ধুর চেতনাকে অপমান করা হয়। আফসোস, তারা সেটা বোঝেন না, বোঝার চেষ্টাও করেন না!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!