Monday, December 23
Shadow

একটি প্রেমের গল্প – অভিজিৎ দাস

প্রেমেরতিনদিন হল শোভন বাড়ি থেকে বেরয়নি। নতুন যে কাজটা পেয়েছে, সেখান থেকে ছুটি নিয়েছে। বাড়ির লোক ভাবছে, হয়তো শরীরটা খারাপ। খোঁজখবর নেবে ভেবে অনিমেষ একদিন শোভনের বাড়িতে হাজির হল। সে শোভনের একেবারে বাচ্চাবেলার বন্ধু। একই সঙ্গে ওঠাবসা। ঘরে ঢুকে অনিমেষ শোভনকে জিজ্ঞেস করে, ‘‘কেমন আছিস? শুনলাম ঘর থেকে বেরনো বন্ধ করে দিয়েছিস?’’

শোভন উত্তর দেয়, ‘‘কী করব বল, অক্ষম পুরুষ। ভিতরে-ভিতরে জ্বলে-পুড়ে মরছি। এদিকে বন্ধুবান্ধব যার সঙ্গেই দেখা হয় সেই বলছে যে কুহেলির ব্যাপারটা আমি যেন সহানুভূতির সঙ্গে বিচার করি। ওর নাকি আর কিছু করার ছিল না। অর্থাৎ, ‘তুমি যে চাকরি পেয়েছ তাতে বউকে সমস্ত সুখ-সুবিধে দিতে পারবে না। কুহেলি তোমায় বিয়ে করবে কেন?’ কথাটা অস্বীকারও তো করতে পারি না।’’

অনিমেষ বলল, ‘‘তোর মাইনের টাকায় সংসার চালানো একেবারে অসম্ভব নয়, তবে কষ্ট আছে। তা, কুহেলির শেষ কথাটা কী?’’

শোভন বলল, ‘‘কুহেলি বলেছে এই চাকরিতে বাবা-মা বিয়েটা মেনে নেবে না।’’

অনিমেষ বলে, ‘‘শোভন, তোর কম রোজগার এটা মেনে নিয়েও বলছি, যারা বিয়ের সময় বাবা-মা মেনে নেবে না বলে পিছিয়ে আসে তাদের মতো শয়তান আর কেউ হয় না। ও যেদিন তোকে প্রপোজ় করেছিল, সেদিন কি বাবা মা-কে জিজ্ঞাসা করে করেছিল? নাকি যে চারবছর তোর সঙ্গে প্রেম করল, ঘুরে বেড়াল, সেসব বাবা মায়ের অনুমতি নিয়ে করেছে? সোজা কথায়, সুখ-সুবিধে-বিলাসিতা ছাড়তে পারবে না বলে পিছিয়ে আসার একটা অজুহাত চাই।’’

শোভন বলে, ‘‘বিশ্বাস কর অনিমেষ, ও একটু আধুনিকা হতে পারে, কিন্তু ওর মতো ভাল মেয়ে আর হয় না। আমার প্রতি ওর ভালবাসা নিয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই।’’

অনিমেষ বলল, ‘‘তাই কি তোর সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে বাবার দেখা পাত্রের সঙ্গে বিয়ে করতে চলল? আমি প্রথম দিনই ওকে এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিলাম।’’

(২)

অনিমেষের ধারণা সঠিক নয়। কুহেলি শোভনকে মন থেকেই ভালবাসে। প্রথম দিনই যখন শুনল যে তার জন্য বাবা পাত্র ঠিক করেছে তখনই সে বাবাকে শোভনের কথা খুলে বলে। বাবা শোভনের রোজগার শুনে রাজি হয়নি। উলটে তার দেখা বিশাল রোজগেরে পাত্রকে বিয়ে করলে জীবনে কত সুখ-সুবিধে ইত্যাদির কথা ফলাও করে বর্ণনা করেছে। শেষে যখন কুহেলি প্রচণ্ড কান্নাকাটি শুরু করল, তখন বাবা তার জানা কয়েকটা ঘটনার কথা উল্লেখ করল, যার সারার্থ এই যে : কোনও-কোনও মেয়ে আবেগের বশে পছন্দের ছেলের সঙ্গে পালিয়ে যায় বটে, কিন্তু তাতে অনেকেই না-খেয়ে মরে। আবার কেউ প্রতারিত হয়ে ফিরে আসে। যখন কুহেলি তাতেও মানল না তখন বাবাও জানিয়ে দিল যে তার কথা দেওয়া হয়ে গেছে। অতএব, শীঘ্রই কুহেলির বিয়ে। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে কুহেলির। কিন্তু সে এ-ও জানে যে বাবা যে গল্পগুলো তাকে বলেছে সেগুলো খুব ভুল বা মিথ্যে গল্প নয়। শোভনের ভালবাসা নিয়ে তার বিন্দুমাত্রও সন্দেহ নেই, কিন্তু ভবিষ্যতে সংসার খরচ কতটা চালাতে পারবে তা নিয়ে সে দৃঢ়তার সঙ্গে এখনই কিছু বলতে পারবে না। রাতদিন সে পুরনো কথা ভেবেছে আর চোখের জল ফেলেছে। তার মনে পড়ে, কলেজে ঢোকার সময় তার বয়ফ্রেন্ডের অভাব ছিল না। প্রসূন, অমরের মতো নানা ছেলের সঙ্গে তার ওঠাবসা ছিল। কিন্তু কারও সঙ্গেই তার মনের আদানপ্রদান হয়নি। এভাবে চলতে-চলতে কুহেলি একদিন লক্ষ করে যে কলেজে দুটো ছেলেকে সবসময় একসঙ্গে দেখা যায়। লোকে ওদের স্বামী-স্ত্রী বলে। এরা হল শোভন আর অনিমেষ। এদের সঙ্গে কুহেলির আলাপ হল যখন ওরা একসঙ্গে অভয় স্যারের কোচিংয়ে ভর্তি হল। কুহেলি উগ্র আধুনিকা। সপ্তাহে-সপ্তাহে হেয়ারস্টাইল বদলায়। পশ্চিমি পোশাক ছাড়া দেখা যায় না। তবুও ওর আস্তে-আস্তে শোভনকে ভাল লাগতে থাকে। শোভন দেখতে সুন্দর। যা বলে, সরাসরি বলে। ক্রমশ কুহেলি ভাবে, এবার একটা সম্পর্কের দিকে যাওয়া দরকার। একদিন ওর বেস্ট ফ্রেন্ড সুনীতাকে মনের কথা খুলে বলল। সুনীতা প্রথমে অনিমেষকে ধরে অনিমেষের মাধ্যমে প্রপোজ় করতে বলল। সেই মতো কুহেলি একদিন ক্যান্টিনে অনিমেষকে একা পেয়ে বলল, ‘‘তোমার সঙ্গে একটু ব্যক্তিগত কথা আছে, একটু শুনবে?’’

অনিমেষ বলে, ‘‘আমার সঙ্গে?’’

কুহেলি বলে, ‘‘হ্যাঁ।’’

দু’জনে গিয়ে বসল পুকুরের পাড়ে, বেঞ্চে। কুহেলি বলল, ‘‘দেখো, কথা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলে কোনও লাভ নেই, তোমার বন্ধু শোভনকে আমার ভাল লাগে। ও যদি কারও সঙ্গে এনগেজ্ড না হয়ে থাকে, তবে আমি ওর সঙ্গে একটা সম্পর্ক চাইছি। তুমি যদি এ ব্যাপারে একটু সাহায্য করো…’’

অনিমেষ শুনে বলল, ‘‘দেখো, শোভন ভাল ছেলে। কিন্তু স্মার্ট নয়। মোট কথা, তোমার উপযুক্ত নয়। তুমি অন্য কোনও ছেলে দেখলে ভাল করবে।’’

শুনে কুহেলি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। বলল, ‘‘তুমি কী ভাবো বলো তো! আমি কি জামাকাপড় কিনতে বেরিয়েছি নাকি যে দোকানে অপশনের শেষ নেই কিনা দেখব! আর স্মার্টনেস? ও আমার পাল্লায় পড়লেই স্মার্ট হয়ে যাবে’’

অনিমেষ বলল, ‘‘না-না, তুমি ব্যাপারটা ওভাবে ভেবো না। ঘটনাটা হল আমি আর শোভন প্রেমের একমাত্র, কেবল একমাত্র পরিণতি বলতে বিয়েকে বুঝি। সব কিছু ঠিকঠাক চললে তুমি কি ওকে বিয়ে করবে? ব্রেক আপ বা কোনও দর্শনতত্ত্ব দেখিয়ে আলাদা হয়ে যাওয়াকে আমরা ঠিক ভাল ভাবে মেনে নিই না। কারণ হাজার হোক, প্রেম দুটো মনের সম্পর্ক। কতগুলো যুক্তি-তর্ক দিয়ে মনের মানুষকে ভুলে যাওয়া যায় কি? বঙ্কিমচন্দ্রের একটা উদ্ধৃতি আছে জানো তো, ‘মায়া কাটাইতে কে পারে? যে বলে মায়া কাটাইয়াছি তার মায়া কোনওদিনও ছিল না’ (আনন্দমঠ)। তারপর ধরো দু’জনেই প্রেমটা সিরিয়াসলি করলে, কিন্তু বিয়ে হল না। বিয়ে অন্য কারও সঙ্গে হল। একজনকে মন দিয়ে অন্যজনের হয়ে যাওয়া কি এতই সহজ?’’

কুহেলির কথাগুলো ভাল লাগল না ও বলল, ‘‘আসলে তুমি আমাকে কাটাতে চাইছ। তোমরা আসলে আমাকে ভাল চোখে দেখো না। আমি বলব, আমার কী-কী তোমাদের খারাপ লাগে? আমি বয়ফ্রেন্ড নিয়ে ঘুরি। আলট্রামর্ডান পোশাক, মানে জ়িন্‌স, কেপ্রি এবং বাড়িতে শর্টস পরি। সর্বোপরি একটা মেয়ে নিজে থেকে প্রপোজ় করতে এসেছে। এগুলো থেকে তোমার মনে হয়েছে আমি ভাল মেয়ে নই। আমি ফ্র্যাঙ্কলি বলছি, তুমি একটা পুরনো মানসিকতা বয়ে বেড়াচ্ছ।’’

অনিমেষ বলল, ‘‘মোটেও তা নয়। মেয়েদেরও একটা মন থাকে। তার ভাল লাগা থেকে সে প্রপোজ় করতেই পারে। শুধু গল্পের শেষটুকু তোমায় আগে শুনিয়ে দিলাম। প্লিজ়, তুমি একদিন আমার কথাগুলো ভেবে দেখো। আমি তোমার কথা শোভনকে বলব।’’

পরদিন কুহেলি ফের অনিমেষকে বলল, ‘‘তোমার কথাগুলো ভেবে দেখলাম। একটা অনুরোধ, প্লিজ় কয়েকদিন তোমার বন্ধুকে নিজেই যাচাই করে দেখে নিতে দাও। বিশ্বাস করো ওকে নাচানোর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই।’’

অনিমেষ ওই দিনই শোভনকে ডেকে বলল, ‘‘শোভন, কুহেলি তোর প্রেমে পড়েছে। মেয়েটা রেখেঢেকে কথা বলে না। তুই এগিয়ে দেখতে পারিস।’’

শোভন বলল, ‘‘আমারও কয়েকদিন ধরে মনে হচ্ছিল। কী করি বল তো!’’

অনিমেষ বলল, ‘‘এগিয়ে যা, এগিয়ে যা’’

অনিমেষের কয়েকদিন ধরেই মনে হচ্ছিল, শোভনেরও একজন মনকল্পিতা আছে। বাস্তবে যার দেখা শোভন পায়নি। ফলে যা হওয়ার হল তাই। শোভন এগিয়ে গেল, প্রথমে দু’জনের সামান্য দ্বিধা, পরে মুগ্ধতা, মুগ্ধতা এবং মুগ্ধতা। দু’জন দু’জনের মধ্যে যেন হারিয়ে গেল।

কিছুদিনের মধ্যে কলেজের পড়ুয়ারা শোভনকে ‘কুহেলির বর’ আর কুহেলিকে ‘শোভনের বউ’ বলে ডাকতে আরম্ভ করল। অবশ্য এতে দু’জনের কারওই কোনও আপত্তি ছিল না। শুধু অনিমেষ শোভনকে বারবার বলত, ‘‘ওরে, চাকরিবাকরির ব্যাপারে ভাব, নয়তো এ প্রেম বেশিদিন টানতে পারবি না। অনিমেষের সবচেয়ে ভাল লাগত যে এদের দু’জনের মাঝখানে কোনওদিন আর কাউকে দেখা যায়নি। তবে হ্যাঁ, অনিমেষের প্রশ্নের জবাব কুহেলি এখনও দেয়নি।

(৩)

কুহেলি অনিমেষকে ফোন করেছে, ‘‘অনিমেষ, শোভন কেমন আছে রে?’’

অনিমেষের মুখে শুধু ‘‘আপসেট,’’ শুনে কুহেলি কান্নায় ভেঙে পড়ল, ‘‘প্লিজ়, ওকে একটু বোঝা’’

অনিমেষ বলল, ‘‘কুহেলি, ভেঙে না-পড়ে একটা উপায় বের কর না। তোর বাবাকে বল না কিছুদিন অপেক্ষা করতে। তোর বাবার ইতিহাস জানি। শোভনের বয়সে তোর বাবাও ওর চেয়ে বেশি রোজগার করেননি। শোভনের অবস্থাটা তোকে বলছি। কোনও পক্ষপাতিত্ব করছি মনে করিস না। সবাই ওকে বোঝাচ্ছে যে যেহেতু ও তোকে এখনও অর্থনৈতিক সাপোর্ট দিতে পারে না, তাই তোকে যেন তোর রাস্তা বেছে নিতে দেয়। এখন এই অর্থনৈতিক চাপের সামনে ওর ভালবাসাটাই সবচেয়ে কম দামি জিনিস হয়ে গেছে। অথবা যার কোনও দামই নেই। এটাই পুরুষমানুষের ট্র্যাজেডি। রোজগার না-থাকলে পুরুষের ভালবাসার কোনও দাম নেই। কিন্তু ওকে ছেড়ে তুই কি সুখী হবি? এই জন্য বলছি, বাবাকে বোঝা’’

কুহেলি বলল, ‘‘শুনবে না। ওর রোজগার নিয়ে অনেক ভেবেছি। হাটে-বাজারে-দোকানে ঘুরেছি। জিনিসপত্রের দাম জিজ্ঞাসা করেছি। ডাল-ভাত হয়তো জুটে যাবে। কিন্তু আরও হাজার প্রয়োজন আছে। অসুখ-বিসুখ আছে। নিজের সংসারটা তোর বাবা-মা কীভাবে চালায়, একদিন দেখ। বুঝতে পারবি। প্লিজ় অনিমেষ, আমায় একটা থিয়োরি দিয়ে ছেড়ে দিস না। একটা উপায় বল।’’

অনিমেষ চুপ করে থাকে। ওর মনে হয় কুহেলিকে আর চাপ দেওয়াটা হয়তো ঠিক হচ্ছে না। বিশেষত মেয়েটা একসময় নিজে প্রপোজ় করেছিল বলে ওকে এভাবে ব্ল্যাকমেল করা ঠিক হচ্ছে না। বিশেষত শোভন যখন ভরনপোষণের ব্যাপারে সঠিক দিশা দেখাতে পারছে না। কিন্তু মন নিয়ে কারবার। যদি পৃথিবীতে প্রেম থাকে তবে সমর্পণও আছে। সে সমর্থন কি ভাল থাকা, ভাল খাওয়া-পরার আশ্বাস পেলেই বদলে যায়? অনিমেষ মনে করে, মানসিক টান না-থাকা সত্ত্বেও একজন আধুনিক, হ্যান্ডসাম কারও সঙ্গে দু’দিন ঘোরার জন্য প্রেম করা আসলে প্রেমের মতো একটা পবিত্র জিনিসকে নষ্ট করা। কুহেলি বলে চলে, ‘‘অনিমেষ, আজ খবরের কাগজে একটা খবর ছেপেছে। একটা মেয়ে তার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করতে চেয়েছিল, বাবা-মা রাজি না-হওয়ায় সে মেয়ে আত্মহত্যা করেছে। আমি যদি তাই করি, তোরা কি এটা মেনে নিবি যে কুহেলির মনে শোভন ছাড়া আর কারও জায়গা নেই? বল, আমি রাজি!’’

অনিমেষ চেঁচিয়ে উঠল, ‘‘কুহেলি, প্লিজ় না! তুই আত্মহত্যা করলে শোভনকেও ধরে রাখতে পারব না। আর বন্ধু হিসেবে তোকে আমি যথেষ্ট ভালবাসি। আমার দুঃখের শেষ থাকবে না! প্লিজ় বেঁচে থাক! আমি ততক্ষণই উপায়ের কথা ভাবতে পারি যতক্ষণ মানুষ বেঁচে থাকে। একটা উপায় বের করতেই হবে।’’

ফোন শেষ হলে অনিমেষ ভাবে, যখন একটা ছেলে আর একটা মেয়ে প্রেমে পড়ে তখনই তারা জানে যে ভবিষ্যতে সমস্যাগুলো কী-কী হতে পারে। এগুলো এতই কমন ব্যাপার! এর থেকে বেরিয়ে আসার জন্য কোনও গেমপ্ল্যান খুঁজে বের করা যায় কি?

(৪)

এর মধ্যেই হঠাৎ একটা ঘটনা ঘটল। অনিমেষের পাড়ার এক রিকশাওয়ালা রাস্তায় এক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে পায়ে ভয়ানক চোট পায়। পাড়ার ছেলেরা দলবল নিয়ে ছুটল হাসপাতালে! অনিমেষ অবাক হয়ে লক্ষ করে, দুই সন্তান নিয়ে সেই রিকশাওয়ালার সংসার মোটামুটি ভালভাবেই চলে যাচ্ছে। রহস্য কী! অনিমেষ জানতে পারে যে রিকশাওয়ালার বউও সকাল-বিকেল রোজ লোকের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে। তা বাদে অন্য সময় সেলাই করে অর্থ উপার্জন করে। অনিমেষ ভাবে, যদি কুহেলিও একটা চাকরি জোগাড় করতে পারে, কম মাইনের হলেও… তা হলে হয়তো দু’জনের আয়ে একটা সংসার করার স্বপ্ন দেখা যেতে পারে। অন্তত যতদিন না শোভন প্রতিষ্ঠিত হতে পারছে, ততদিন। অনিমেষ কুহেলিকে ফোন করে, ‘‘বিকেলে দেখা কর।’’

বিকেলে যখন কুহেলি দেখা করল তখন অনিমেষ প্রথমেই অনেক ক্ষমা চেয়ে পরে ওর মতলবটা কুহেলিকে বলল। কুহেলি প্রথমে কিছুক্ষণ থমকে গেল। ও কোনওদিন চাকরি করবে বলে ভাবেনি। হঠাৎ এরকম একটা প্রস্তাব ওকে হতভম্ব করে দিল। অনিমেষ বলল, ‘‘কুহেলি, একটা প্রশ্ন আছেতুই কি মনে করিস যে তুই শোভনকে ভালবাসিস বলে আমি তোকে ব্ল্যাকমেল করছি?’’

কুহেলি বলল, ‘‘হতেও পারে, তোর ছোটবেলার বন্ধুর জন্য তুই আমায় ইউজ় করতেও পারিস। তবে কী জানিস, আমিও তো আমার ভালবাসার মানুষটাকে চিরজীবনের মতো পেতে চাই। তুই ব্ল্যাকমেল করলেও সেটা একরকম আমার জন্যেই। জানিস, আজ যখন আমি আমার অবস্থাটা ভাবি তখন মনে হয় আমার জ়িন্‌স পরা মিথ্যে, মোবাইল মিথ্যে, জ়িমে যাওয়া মিথ্যে, ইন্টারনেট ঘাঁটা মিথ্যে! উপরের খোলসটা ছাড়িয়ে নিলে আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগের একটা মেয়ের সঙ্গে আমার কোনও পার্থক্য নেই। তারা যে পরিস্থিতিতে পড়ত, আমার অবস্থাও তাই। মাঝে-মাঝে শোভনের কথা মনে হয়। অত সুন্দর মনের মানুষ আমি আর দেখিনি। মনে-মনে ভাবি, আমার মনের মানুষটার দোষ কী? যদি বলা হয় রোজগার ভাল করে না, তখন মনে হয় আমি এই প্রশ্নটাকে এড়াতে পারছি কারণ আমি নিজে একটা মেয়ে। ছেলে হলে ওই একই প্রশ্নের মোকাবিলা আমাকেও করতে হত। বিশ্বাস কর, ওকে ছাড়া আমি আর কারও কথা ভাবতে পারি না।’’

অনিমেষ শুনে বলল, ‘‘আমিও খুব চেষ্টা করছি যাতে তোদের দু’জনের বিয়েটা হয়ে যায়’’

কুহেলি শুনে বলল, ‘‘হতভাগা গান্ডু! তুই ভাববি না তো কে ভাববে! শালা, নিজে প্রেম করবি না, প্রেম সংক্রান্ত যত এক্সপেরিমেন্ট আমাদের উপর দিয়ে করবি। তুই একটা আস্ত শয়তান। যাই হোক, একটা উপকার করতে পারবি?’’

অনিমেষ বলল, ‘‘কী?’’

বলতে গিয়ে কুহেলি কেঁদেই ফেলল, ‘‘ভেবেছিলাম সম্পর্কটা কাটিয়ে দেব, কিন্তু সবসময় ওর কথাই মনে পড়ছে। একদিন আমাকে আমার বরের সঙ্গে দেখা করা!’’

অনিমেষ বলল, ‘‘বেশ, পরশুদিন বাড়ির সবাই মামাবাড়ি যাবে। দুপুরে দেখা করিয়ে দেব।’’

(৫)

দুপুরে কুহেলির সঙ্গে শোভনের দেখা হল। শোভনের মুখ শুকনো, চেহারা অনেক ভেঙে গেছে। কুহেলি শোভনকে জড়িয়ে ধরল। অনেকক্ষণ ধরে চুমু খেল। তারপর বলল, ‘‘কেমন আছ?’’

শোভন বলল, ‘‘কী বলি কুহেলি, বউকে খাওয়ানোর ক্ষমতা যার নেই, ভালবাসার দাবি সে করে কী করে?’’

কুহেলি ভয় পেয়ে গেল। এই মানুষটা আর বেশিদিন তার নেই। কুহেলি বলল, ‘‘শোভন, অনিমেষ আমায় অন্য একটা রাস্তা দেখিয়েছে, তবে তার কোনও গ্যারান্টি নেই। যদি ব্যর্থ হই, তবে পারবে আমার সঙ্গে মরতে? আমি তোমার দিকে এতটাই এগিয়ে গিয়েছি যে তোমাকে ছেড়ে দেওয়া আজ নিজের স্বামীকে ছেড়ে দেওয়ার সমান হয়ে গেছে। আমার আর কোনও উপায় নেই।’’

শোভন বলল, ‘‘এই এক জায়গায় আমায় পুরো ভরসা করতে পার কুহেলি। তবে যে আমি তোমায় সংসারের আশা দেখিয়েছিলাম, সেই আমিই যদি তোমার মৃত্যুর কারণ হই, তবে তার চেয়ে বেশি দুঃখের কিছু নেই’’

দু’জনে চুপচাপ দুপুরটা কাটিয়ে দিল।

(৬)

হঠাৎ অনিমেষের কাজ অনেক বেড়ে গেল। কুহেলির জন্য একটা চাকরি খুঁজতে হবে। ছ’-সাতহাজার যাই হোক। বন্ধু-বান্ধবদের ফোন করে। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে। রাস্তার দু’ধারের দেওয়ালে পোস্টারগুলো পড়ে বেড়ায়, যদি কোনও কর্মখালি পাওয়া যায়। অনিমেষকেই এসব করতে হয়। কুহেলি পারে না। যদি কুহেলির বাড়ির লোক এসব জানতে পারে, তা হলে সব কেঁচে যাবে। প্রতিদিন সন্ধেয় কুহেলি অনিমেষকে ফোন করে। অনিমেষ ভরসা দেয়। অনিমেষের এমনও দিন যায় যেদিন সামান্য মাইনের অস্থায়ী একটা কাজের খোঁজে প্রথমে একজন তারপর আর-একজন, এরকম করতে-করতে সারা দিন কেটে যায়। অনিমেষ মনে-মনে ভাবে যে শোভন আর কুহেলি যদি কলেজ লাইফ থেকেই এই ব্যাপারটা নিয়ে ভাবত, তা হলে হয়তো আজ এত সমস্যা হত না।

অবশেষে কয়েকটা জায়গা থেকে ডাক আসে। অনিমেষ কুহেলিকে নিয়ে যায়। ফেরার পথে কুহেলি বাজারটা ঘুরে আনাজপাতি, চাল-ডালের দামের খোঁজ নেয় রাতে হিসেব করে, কত টাকা হলে ওরা একটা সংসার পাততে পারবে। আলুর দাম দু’টাকা কমলে খুশি হয়। চালের দাম একটু বাড়লে চিন্তায় সারা রাত ঘুমোতে পারে না। একদিন অনিমেষ হঠাৎ কুহেলিকে জিজ্ঞেস করে, ‘‘কুহেলি, ধর তোর সংসারের খরচ উঠে গেল, কিন্তু বাড়িতে রাজি হল না, কী করবি?’’

কুহেলি বলল, ‘‘কী করি বল তো! দেখ, বাবা আমাকে ভীষণ ভালবাসে, কোনও কিছুর প্রত্যাশা না-করেই আমাকে খাইয়ে-পরিয়ে মানুষ করেছে। এখন হঠাৎ একজনকে ভালবাসি বলে তাদের ছেড়ে আর-একজনের সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম, একে কী বলবি? বিশ্বাসঘাতকতা?’’

অনিমেষ বলল, ‘‘তা কেন? দেখ, তোর বাবা-মা একদিন তোর বিয়ে দেবেই, তখন ও ব্যাপারটা একই দাঁড়াবে। আর এটা একটা মিথ যে অ্যারেঞ্জড ম্যারেজে মেয়েরা সবসময় সুখী হয়। গৃহবধূ হত্যার খবরগুলো পড়িস না? অধিকাংশই প্রচুর পণ দিয়ে অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ। অবশ্য কখনও-কখনও লাভ ম্যারেজেও এমন হয়। তবু অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ়ের ক্ষেত্রেও গ্যারান্টি দিয়ে বলা যায় না যে মেয়ে সুখী হবে। আচ্ছা কুহেলি, একটা কথা জিজ্ঞেস করি, শোভনের সঙ্গে লেখাপড়া করেছে এমন অনেক ছেলেই তো এখন সুপ্রতিষ্ঠিত, তোর মনে হয় না যে তুই একটা অযোগ্য লোককে ভালবেসেছিস?’’

কুহেলি বলল, ‘‘আসলে এখন আমি ওকে অত নির্মমভাবে জাজ করতে পারি না। কথাটা অন্যভাবে নিস না প্লিজ়, একজন মহিলা যেমন তার সন্তানকে হাজার অযোগ্যতা সত্ত্বেও ভালবাসে আমার ব্যাপারটা অনেকটা তাই হয়ে গেছে। মাঝে-মাঝে মনে হয়, ও হয়তো আমাকে বলতে চাইছে, ‘কুহেলি, আমি খানিকটা এগোলাম। বর্তমান পরিস্থিতি আর আমায় এগোতে দিচ্ছে না। তুমিও একটু এগোও না, যাতে আমরা এক হতে পারি।’ বলতে পারছে না লোকে কী বলবে বলে’’

অনিমেষ বলে, ‘‘যদি পরেও তোর বাড়ির লোকে মেনে না নেয়?’’

কুহেলি বলে, ‘‘বরকে জিজ্ঞেস করেছি, আমার সঙ্গে একসঙ্গে সুইসাইড করতে পারবে? বর এক পায়ে খাড়া’’

অনিমেষ বলে, ‘‘আবার সেই আত্মহত্যার গল্প শুরু করলি! যদি অর্থনৈতিক প্রয়োজন মিটে যায় তবে আত্মহত্যা না করে শুধু ‘আত্মহত্যা করব’ বলে ব্ল্যাকমেলও করা যায়’’

(৭)

শেষে খবর আসে। অনিমেষের এক বন্ধু খবর দেয়, তার চেনা এক অফিসে একজন রিসেপশনিস্ট লাগবে। অনিমেষ কুহেলিকে নিয়ে ছোটে। সে কাজের যা ফিরিস্তি শোনাল, তাতে রিসেপশনিস্টের সঙ্গে-সঙ্গে খানিকটা হাউসকিপিং, খানিকটা চা বানানো ইত্যাদি ইত্যাদি যুক্ত। পয়সার ব্যবহার কীভাবে করতে হয়, তা এদের থেকেই শিখতে হয়। অনিমেষ চুপ করে রইল। কুহেলি যে-পরিবারের মেয়ে, তাতে এতে রাজি হওয়া যায় না। কিন্তু কুহেলি রাজি হল। ওর ইন্টারভিউ নেওয়া হল। সিলেক্টেড। আসার পথে অনিমেষ বলল, ‘‘কুহেলি, এটা কী করলি বল তো!’’

কুহেলি বলল, ‘‘অনিমেষ প্লিজ়, অনেকদিন পর এত আনন্দ পেলাম! একটা আশার আলো দেখতে পেলাম! পরে ভাল কাজ পেলে ছেড়ে দেব’’

ফেরার পথে অনিমেষ কুহেলির চোখে-মুখে এক অপার্থিব আনন্দ দেখতে পেল। বারবার বায়না করতে লাগল, ‘এই রেস্তরাঁয় খাব, ওই সিনেমাটা ভাল হয়েছে, চল আজ দেখতে যাই…’

অনিমেষ কুহেলির দিকে মুগ্ধভাবে তাকিয়ে থাকে। সে তার কলেজ-জীবনে বহু প্রেমিক-প্রেমিকার বিচ্ছেদ দেখেছে। তারা কেঁদেছে, বাবা মায়ের অমতের দোহাই দিয়েছে। কিন্তু অনিমেষ খুব ভালভাবে ভেবে দেখেছে যে তাদের বিয়ে আসলে হয়নি তারা নিজেরা চায়নি বলে। আজ যদি কুহেলি বলত যে সে শোভনকে বিয়ে করতে পারবে না কারণ শোভনের সংসার চালানোর খরচ জোগাড়ের ক্ষমতা নেই, তবে অনিমেষের কিছু বলার ছিল না। কারণ দুনিয়া এমনই বলে। কিন্তু এসব সত্ত্বেও কেউ যদি প্রেমিকের দুঃখের অংশীদার হয়ে তার সঙ্গে ঘর করতে এগিয়ে আসে, তবে তার অবস্থান নিশ্চয়ই বাকিদের চেয়ে একটু উপরে হওয়া উচিত।

রাতে কুহেলি মোবাইলের ক্যালকুলেটর খুলে কাগজ আর কলম নিয়ে বসল। ওহ! সব হিসেব মিলে যাচ্ছে! কী আনন্দ, কী আনন্দ!

(৮)

প্রায় একমাস কুহেলি উলটোপালটা বলে সকালে বেরিয়ে যায় এবং কাজ করে সন্ধেয় ফেরে। আজ প্রথম মাইনে পেয়েছে, অনিমেষ বলে দিয়েছে যে আজই বাবাকে কথাটা বলতে হবে। অনিমেষ আরও বলেছে যে এই অবস্থায় দুটো উপায় আছে এক, পালিয়ে বিয়ে করা আর দুই, ‘আত্মহত্যা করব’ বলে বাবাকে ভয় দেখানো। কিন্তু দু’জন যদি কিছুদিনের জন্য পালিয়ে যায়, তবে দু’জনেরই চাকরির সমাধি। সুতরাং দ্বিতীয়টিই করতে হবে। প্রায় একমাস ধরে মনে-মনে প্রস্তুতি নিয়েছে কুহেলি। সন্ধেয় এসে দেখে যে বাবা অফিস থেকে ফিরে চা খেয়ে খবরের কাগজ নিয়ে বসেছে। কুহেলি একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘‘বাবা, তোমায় একটা কথা বলার ছিল’’

বাবা বলল, ‘‘বলো’’

কুহেলি বলল, ‘‘বাবা, আমি শোভনকে বিয়ে করতে চাই’’

বাবা খুব শান্তভাবেই উত্তর দিল, ‘‘শোভন খারাপ ছেলে নয়, আমি খোঁজ নিয়েছি। কিন্তু যা মাইনে পায় তাতে আমি রাজি হতে পারি না’’

কুহেলি তৈরিই ছিল। বলল, ‘‘তার জন্য আমি একটা উপায় করেছি, আমি একটা চাকরি জোগাড় করেছি’’

ভদ্রলোক এবার ধড়ফড় করে উঠে বসলেন। তার আদরের মেয়ে প্রেমে পাগল হয়ে শেষে এই কাজ করবে, ভাবতে পারেননি! জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘মাইনে কত?’’

কুহেলি বলল, ‘‘আট হাজার’’

ভদ্রলোক মেয়ের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন, তারপর আদর করে কাছে টেনে নিলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘‘কনফিডেন্স আছে, কোনও দিন শোভনের রোজগার বন্ধ হয়ে গেলে বা চিরদিন এরকম থাকলে একা চালিয়ে নিতে পারবি?’’

কুহেলি মাটির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘‘হ্যাঁ’’

বাবা বললেন, ‘‘দেখ, তোরা মনে করিস যে ছেলে-মেয়ে প্রেমে পড়লেই বাবা-মা এরকম ভিলেন হয়ে ওঠে কেন? কিন্তু আসলে আমরাও তোদের মতোই সাধারণ। শুধু জীবনটাকে তোদের চেয়ে একটু বেশি দেখে ফেলেছি। অনেক সময় অনেকে লাভ ম্যারেজ করেও সুখী হয় না। সংসার করতে গেলে একটা ন্যূনতম অর্থাগম লাগেই। খালি পেটে বেশিদিন সুখে ঘর-সংসার করা যায় না। অনেক সময় দেখা যায় প্রেমিকটিই একটি প্রতারক। সুতরাং আমাদের মনের মধ্যে একটা দ্বিধা কাজ করেই। ছেলেটির রোজগারও দেখতে হয়। এইরকম ক্ষেত্রে আমরা একটা অন্য উপায় খুঁজে পাই, যদি মেয়ে নিজেই নিজের খরচ চালাতে পারে। অর্থাৎ অর্থনৈতিকভাবে যদি ছেলেটির উপর নির্ভরশীল না হয়। ছোটবেলা থেকে তোকে আমি চাকরি করার মতো করে মানুষ করিনি। কথাগুলো মনে হল যখন তোর বিয়ের বয়স হল। যা রোজগার করিস, তাতে তোর হয়ে যাবে। দেখিস রোজগার যেন একটু বাড়ে। শোভনকেও বোঝা যেন আর-একটু ভাল মাইনের চাকরির চেষ্টা করে। যা আশীর্বাদ রইল, সুখী হ’’

কুহেলি ছলছল দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়ে রইল।

সুতরাং সানাই বাজল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!