রোমান্টিক-থ্রিলার গোয়েন্দা উপন্যাস: ছায়া এসে পড়ে পর্ব-৪
রোমান্টিক থ্রিলার ঘরানার বইটি মধ্যবয়সী পুরুষ তৈয়ব আখন্দকে ঘিরে। জীবন সংসারের প্রতি খানিকটা উন্নাসিক কিন্তু বুদ্ধিমান এ মানুষটা পালিয়ে বেড়াতে চায়। কিন্তু আচমকা টাঙন নদী ঘেঁষা গ্রাম পদ্মলতায় এসে সে আটকা পড়ে চাঁদের আলোয় ঝুলতে থাকা একটা লাশ আর লাবনীর জালে। তৈয়ব নিজেকে বের করে আনার চেষ্টা করে। চলতে থাকে জড়িয়ে পড়া ও ছাড়িয়ে আনার মাঝে এক সমঝোতা।
রোমান্টিক প্রেমের গল্প ও একই সঙ্গে থ্রিলার স্বাদের উপন্যাস ছায়া এসে পড়ে । লেখক ধ্রুব নীল
কুরিয়ারে হার্ড কপি পেতে এই পেইজে অর্ডার করুন
ছায়া এসে পড়ে
ছায়া এসে পড়ে পর্ব -১ এর লিংক
ছায়া এসে পড়ে পর্ব -২ এর লিংক
ছায়া এসে পড়ে পর্ব -৩ এর লিংক
৪
‘বাড়ি যাবে না লাবনী?’
‘বিয়ার পর মাইয়াগো বাড়ি থাকে না। আফনের এতো বুদ্ধি, এইটা জানেন না?’
‘রেবেকার তো তিনটা ফ্ল্যাট আছে সম্ভবত। চাইলে আরও দুচারটা বাড়ি বানিয়ে দেবে আজমল সাহেব।’
‘বড়লোক বাপের মাইয়া। তার হিসাব আলাদা। সে হইল যক্ষের ধন। আমার এমন একটা মাইয়া থাকলে আমি তারে ঘর বানাইয়া দিতাম। বিয়াশাদির নামও নিতাম না। বিয়েকরলে সে করবে। কিন্তু থাকবে নিজের বাড়িতে।’
‘যদি ছেলে হয়?’
‘একটা হইলেই হইব। বিয়ার পাঁচ বৎসর হইল। এখন পোলা যা মাইয়াও তা।’
‘বিয়ের প্রথম বছরে কীসের শখ ছিল? মেয়ের?’
কিছু বলল না লাবনী। তৈয়বের সব প্রশ্নের উত্তর না দিলেও চলবে। সে এখন নিশ্চয়ই কল্পনায় তার মেয়ের চুলে বেণী বেঁধে দিচ্ছে। সুখকর কল্পনায় বাধা দিতে চাইল না তৈয়ব। কাত হয়ে শুয়ে পড়লো।
পরের দিনও লাবনী কোথাও গেলো না। তৈয়বের কথায় হ্যাঁ হুঁ বলেই জবাব দিচ্ছে। এর মধ্যে অপরিচিত এক লোক এসে তৈয়বকে একটা খবর দিয়ে গেছে। খবরটা গোপন। লাবনীকে বলা যাবে না। লোকমান আলী তৈয়বের সঙ্গে দেখা করতে চান। গভীর রাতে যেন আসে।
তৈয়ব সেদিন গেলো না দেখা করতে। লোকমান লোকটাকে আর সিরিয়াস মনে হচ্ছে না তার কাছে। সিরিয়াস হলে এতদিনে একটা কিছু ঘটতো। সে দ্বিতীয় বিয়ে করেছে। লাবনীকে নিয়ে তার আগ্রহ না থাকারই কথা এখন।
সারাদিন শুয়েবসে কাটালো তৈয়ব। খাতা বের করে টুকটাক এটা ওটা লেখার চেষ্টা করলো। এরপর ঘুমালো একেবারে রাত পর্যন্ত। লাবনী এসে মাঝে খাবার দিয়ে গেছে। তবে তাকে জাগায়নি। টেংরার ঝোল আর ভাত। গরমই আছে। তার মানে বেশিক্ষণ হয়নি দিয়ে গেছে।
লাবনী গেছে কোথায়? বাবার বাড়ি? তার বাবার বাড়ি মায়ের বাড়ি এসব কোথায় জানে না তৈয়ব। আদৌ আছে কিনা কে জানে। অবশ্য তা না থাকলে যাবে কোথায় সে? অন্য কারো কাছে যায় না তো? তৈয়ব দিন দিন নিজের কাছে বদলোক হয়ে যাচ্ছে। যে যত বদ, তার মনে তত বদ সন্দেহ ঘুরপাক খায়। তৈয়বের মন বলছে, লাবনী আসলেই একটা ডেঞ্জারাস মেয়ে।
লোকমান নামের মধ্যে একটা সরল ভাব আছে। নাম শুনে লোকটাকে যেমন ভেবেছিল তেমন নয়। বেশ কেতাদূরস্ত। বয়স পঞ্চান্নর ঘরে।বসার স্টাইলের মধ্যে একটা সত্যজিৎ রায় ধাঁচ আছে। লম্বাচওড়া। এলাকার রাজনীতি করে নির্ঘাৎ। সমস্যা হলো গলার স্বরে। চাপা স্বরে কথা বলতে বলতে ফ্যাসফ্যাসে হয়ে গেছে। মুখের ভেতর যেন অনেকগুলো সাপ বসে আছে।
‘তুমি কইরাই বলি। তুমি হক সাবের নাতি। তোমারে চিনি। ছেলে ভালো।’
তৈয়ব হাসলো। মিষ্টিমধুর হাসি।
‘শুনলাম লাবনী তোমার বাড়িতে রাত কাটায়। ঘটনা সত্য?’
‘জি, এখন খেয়েদেয়ে ঘুমাচ্ছে। রাত তো কম হয় নাই। পৌনে একটা। ঝড় তুফানের রাত। ঘটনা হলো সে ভয়ে ভয়ে আছে। ভয় পেয়ে আমাদের বাড়িতে চলে এসেছে। আমার সঙ্গেই থাকে।’
‘আমি তার স্বামী। এইটা তার শ্বশুরবাড়ি। সে তোমার বাড়িত গেল কেন?’
‘সে আপনার ভয়েই আছে। তার ধারণা আপনি তাকে গলা টিপে খুন করবেন।’
‘মেরে ফেললে মেরে ফেলবো। গলা টিপে মারবো। মন চাইলে গরম খুন্তি দিয়া ছ্যাঁক দিয়া মারবো। সেটা আমার ইচ্ছা। কিন্তু সে পরপুরুষের বাড়িতে যাইব ক্যান, তাও এত রাইতে…।’
তৈয়ব জোর চেষ্টা চালাচ্ছে মুখে কাঁচুমাচু ভাব আনার। বোধহয় তার চেষ্টা সফল হচ্ছে। লোকমান তাকে একটু আধটু বিশ্বাস করতে শুরু করেছে।
বাড়িটা বেশ যত্ন করে বানানো। আধুনিক ড্রয়িং রুমও আছে। ভেতরের রুমগুলোর সঙ্গে পর্দার বেড়া। তাতে একটু পর পর উঁকি দিয়ে যাচ্ছে একটা মুখ।
লোকমান মাথা নিচু করে মেঝের টাইলস দেখছে যে ভেতর থেকে উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করছে তাকে আবার কড়া দৃষ্টিতেআবার ভেতরে পাঠাচ্ছে। লোকমানের ভাবভঙ্গি পড়ার চেষ্টা করছে তৈয়ব। দাবার গুটি এখনও এখনও তার হাতেই আছে।
ধীরেসুস্থে আরেকটা চাল দিল তৈয়ব।
‘আপনের মতো আমিও বিষয়টা ভাবছি। পরপুরুষের ঘরে এতো রাইতে আপনার স্ত্রী। গ্রামদেশ বলে কথা। বিষয়টা জানাজানি হইলে..।’
‘চুপ।’ ঠোঁটে আঙুল রেখে ভেতরের দিকে ইশারা করলো লোকমান। বোঝালো বাড়ির কাউকে জানাতে চায় না। উসখুস করার ভাব করলো তৈয়ব।
ভেতর থেকে কে যেন খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। লোকমান আলী মুখ কঠিন করে মেঝের দিকে তাকাল। এবার আর তেড়ে গেল না। কে হাসলো? তৈয়বের হিসাব বলছে সে লোকমানের ছোট বউ।
বাড়িতে কান্নাকাটির শব্দ নেই। এরই বা কারণ কী। মিজান আলীর স্ত্রী-সন্তানরা কোথায়? নাকি ছিলই না। এতো কিছু ভাবতে চাইল না তৈয়ব। সে গোয়েন্দা না যে সব রহস্যের সমাধান নিয়ে তাকে ভাবতে হবে।
‘এখন কী করবো বলেন।’ নীরবতা ভাঙলো তৈয়ব।
‘কিছুই করা লাগবো না। যা করার আমিই করবো। তুমি বাড়ি যাও। টর্চ নিয়া যাও। ছাতাটাও সঙ্গে রাখো। আর চাইলে তুমি গিয়া লাবনীর সঙ্গে শুইতেও পারো। তোমার উপর আমার রাগ নাই। তুমি ছেলে ভালো। আইজ হোক, কাইল হোক, লাবনী তো মরবোই। হে হে হে।’
তৈয়ব না বোঝার ভান করে হা করে তাকিয়ে আছে। লোকমান তাকে চা-নাস্তা সাধলো না। লোকটাকে মনে হলো বিষধর সাপ। সাপের হাতের বানানো চা-ও হবে বিষাক্ত। এ চা তৈয়ব গিলতেও পারতো না।
লোকমান লোকটা চালাক চতুর। তবে ভীতু প্রকৃতির। হুট করে কিছু ঘটাবে না বোধহয়।
যাওয়ার আগে আরেকটা চাল দেওয়া বাকি। উঠে গিয়েই আবার ধপকরে বসে পড়লো তৈয়ব। উঁকি দিয়ে দেখে নিলো পর্দার আড়ালে কেউ আছে কিনা। লোকমান মেজাজ গরম করে তেড়ে গেল ভেতরে। গলা চড়িয়ে ধমকে এলো কাকে যেন। ‘আরেকবার কান আউগাইবি তো কানের লতি কাইট্টা কুত্তারে খাওয়ামু’। ফিরে এলো সঙ্গে সঙ্গে।
‘বলো,কী বলবা।’
তৈয়ব গলা খাদে নামিয়ে বলল, ‘লাবনী মানে, আপনার স্ত্রী ফোনে কার সঙ্গে যেন আলাপ সালাপ করতেসিল। সলিমুল না সাইফুল নাম।’
‘বুঝছি, বলো। কী কইসে তারে?’
‘সে বলল তার সঙ্গে এখন দশ হাজার আছে। বাকি দশ হাজার কাজ শেষ হওয়ার পর। আমার কাছে মনে হইলো খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে কাকা।’
কাকা সম্বোধন শুনে পা নামিয়ে বসলো লোকমান। তৈয়বকে সে এখন নিজের লোক ধরে নিয়েছে। ‘লোকটার নাম রবিউল। গাছি রবিউল। ভাড়ায় মানুষ মারে। লাবনী আমারেও মারতে চায়। আমার ভাইরেমারসে।এরপর আমারে মারবে। মালকিন হওয়ার শখ তার। আমার সম্পত্তি দখলের খায়েস।মাগীর খায়েসের পায়েস বানাইয়া খামু আমি।’
‘আমি যাই। সঙ্গে মোবাইলও নাই। ঢাকায় ফেলে আসছি। আপনার নাম্বারটা যদি দিতেন।’
‘সব খবর তো দিয়াই দিলা। নতুন আর কী জানাইবা?’
‘না, গতকাল বাড়িতে পুলিশ আসছিল। এসআই শামীম। আমার বন্ধু মানুুষ। সেটা অন্য কেইস। যদি আপনারে জরুরি কাজে খোঁজ দিতে হয়।’
ঘোড়ার চাল চেলেছে তৈয়ব। চালটা হুট করে এসেছে মাথায়। পুলিশের কথা শুনে লোকমানের মুখ পাণ্ডুর হয়ে গেলো। কাগজে নিজের নম্বর লিখতে গিয়ে তিনবার ভুল করলো।
‘এই নাও। আর একটু দাঁড়াও।’
ভেতরে গিয়ে আবার ফিরলো টাকা গুনতে গুনতে।‘ধরো।পাঁচ হাজার রাখো। একটা মোবাইল কিনে নিও।তোমার আপন চাচা হিসেবে দিলাম। নাহ, আপন চাচা মনে করার দরকার নাই। গ্রামের চাচা মনে করলেই হবে। আপন চাচা মনে করলে আবার লাবনী তোমার চাচিআম্মা হয়ে যাবে।’
লোকটা হাসার চেষ্টা করলো। পারলো না। তৈয়ব টাকাটা পকেটে ভরে নিরবে প্রস্থান করলো।
বাড়িতে ঢুকতেই মৃদু ধাক্কা খেলো তৈয়ব। লাবনীর রুমের বাতি জ্বলছে। দরজা খোলা। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শাড়ির কুঁচি ঠিক করছে। আলমারি থেকে ভাঁজ করা শাড়ি বের করে পরেছে। ন্যাপথলিনের কড়া গন্ধ। চুল বাঁধা লাবনীকে দেখাচ্ছে অবিকল অড্রে হেপবার্নের মতো।
‘এমন করে কী দেখো। চলো ছাদে যাই। চা বসিয়েছি। চা খেতে খেতে বৃষ্টিতে ভিজবো। এরপর সকালে স্বামীর বাড়িতে চলে যাব। বলবো, রাতে বড় চাচীর বাসায় ছিলাম। সে আমার রূপ দেখে কিছু বলবে না। আমারে খুন করলেও তার আগে একটু রং তামাশা করবে। পুরুষ মানুষরে আমার চিনা আছে। তুমি কেন তার সঙ্গে দেখা করতে গেছিলা, সেটাও জানি। তুমিআবার বলো নাই তো তোমার সঙ্গে আমার ফস্টিনষ্টি হইয়া গেছে?’
‘না বলিনি। কিছুই বলিনি। টাকা দিয়েছেন। টাকা নিয়ে এসেছি। হাতে টাকার টান আছে।’
‘ও, তা আমারে কইলেই পারতা। আমি নিয়া দিতাম।’
‘তোমাকে বলবো কেন? তুমি আমার কে?’
পাত্তা দিল না লাবনী। কথা ঘোরালো।
‘তার নতুন বউটারে দেখছো?
‘না, দেখিনি। তবে হাসি শুনেছি। সে খুব সুখে আছে।’
‘সুখ না ছাই। হাসি শুইনা তাই মনে হইলো!’
‘ও সুখে থাকলে তোমার কী। তুমি তো ফস্টিনষ্টি করে বেড়াচ্ছো।’
‘বাজে কতা কইবা না।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে। বলবো না। তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে লাবনী।’
মেঘ ছিল কিছুটা। আর তাই বজ্রপাত যে হবে সেটা ছিল জানা কথা। আশেপাশেই কোথাও পড়েছে বাজটা। লাবনী ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো তৈয়বকে। তারপর কেটে যেতে লাগলো অনন্ত সময়। তৈয়বের দাবার বোর্ড উল্টেপাল্টে যাচ্ছে। সোজা পথে ছুটছে ঘোড়া, হাতিগুলো দিকভ্রান্ত, এককোনে মুখ গোমড়া করে পড়ে আছে মন্ত্রী।
তৈয়বের হাত ধরলো লাবনী। নতুন নতুন প্রেমে পড়লে মেয়েরা যেভাবে প্রেমিকের হাত ধরে। ‘চলো ছাদে যাই। চা-ও হয়ে গেছে। ঘ্রাণ পাচ্ছি।’
তৈয়ব বুঝতে পারলো তার দাবার চালে একটা বড় গ্যাপ রয়ে গেছে। গ্যাপটা ধরতে পারলেও ফসকে যাচ্ছে বার বার।
পরিস্থিতিতে পড়ে একটা মেয়ে খুন করতেই পারে। কিন্তু খুন করানোর জন্য ভাড়াটে খুনি যোগাড় করা যা-তা কথা না। লাবনীকে যতটা ডেঞ্জারাস ভেবেছিল সে তারচেয়েও বেশি ভয়ানক হতে পারে। কিন্তু ভয়ানক এ মেয়েটার প্রেমে মজে আছে তৈয়ব।নিজের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে এমন বিভ্রান্তিতে আগে কোনও দিন পড়েনি সে। আপাতত ছাদে যাওয়ার অমোঘ টান কিছুতেই এড়াতে পারছে না।