class="post-template-default single single-post postid-18224 single-format-standard wp-custom-logo group-blog vl-boxed aa-prefix-matin-">
Shadow

হিমোফিলিয়া : বংশগত জটিল রক্তরোগ

হিমোফিলিয়া

হিমোফিলিয়া : বংশগত জটিল রক্তরোগ

হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে রক্ত জমাট বাঁধার বিশেষ উপাদান থাকে না। ফলে শরীরের কোনো অংশে আঘাতপ্রাপ্ত হলে বা কেটে গেলে সহজে রক্তক্ষরণ বন্ধ হয় না। এই রোগ সম্পর্কে জনগণের মধ্যে ব্যাপক সচেতনতা তৈরি হলে জটিলতা এড়ানো যায়। লিখেছেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মহিউদ্দিন আহমেদ খান

 

রক্তের মধ্যে কিছু প্রোটিন উপাদান এমনভাবে বিন্যস্ত, যাতে রক্ত তরল অবস্থায় থাকে এবং শরীরের বাইরে কোথাও কেটে বা ছিঁড়ে গেলেও রক্ত আস্তে আস্তে জমাট বেঁধে রক্তপাত হওয়া বন্ধ করে দেয়। অর্থাৎ এক ধরনের কণা রক্তনালির মধ্যে রক্তকে জমাট বাঁধতে বাধা দেয়, আবার এক ধরনের কণা বাইরে রক্তক্ষরণ হলে জমাট বেঁধে রক্তপাত বন্ধ করে। হিমোফিলিয়া হলো উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া একটি বংশগত রক্তরোগ। এ রোগের কারণে কোনো ধরনের আঘাত বা অস্ত্রোপচার এবং গাঁটের যন্ত্রণাদায়ক ফোলা থেকে দীর্ঘ সময় রক্তপাত হতে পারে। রক্ত জমাট বাঁধা প্রক্রিয়ার এ অস্বাভাবিকতাই হিমোফিলিয়া।

 

ধরন

হিমোফিলিয়া রোগের তীব্রতা বিভিন্ন রকম হতে পারে। যেমন—তীব্র, মাঝারি ও মৃদু। তবে এই রোগ দুই ধরনের হয়। যেমন—

হিমোফিলিয়া ‘এ’ : ক্লটিং ফ্যাক্টর ৮-এর ঘাটতিজনিত কারণে হিমোফিলিয়া ‘এ’ হয়। এটাই সাধারণ ফ্যাক্টর, যাতে প্রতি লাখে ১০ জনের ক্ষেত্রে ঘটে থাকে।

হিমোফিলিয়া ‘বি’ : ক্লটিং ফ্যাক্টর ৮-এর ঘাটতিজনিত কারণে হিমোফিলিয়া ‘বি’ হয়। এটি সচরাচর দেখা যায় না, যাতে প্রতি লাখে দুজনের ক্ষেত্রে ঘটে থাকে।

 

কারা বাহক?

সাধারনত নারীদের দুটি এক্স ক্রোমোজোম থাকে। একটি এক্স ক্রোমোজোমে হিমোফিলিয়া জিন না থাকলেও অন্য এক্স ক্রোমোজোমে থাকা জিন ৫০ ভাগ পর্যন্ত ফ্যাক্টর ৮ বা ৯ তৈরি করতে পারে। ফলে রক্ত জমাট বাঁধতে সমস্যা তৈরি হয়। হিমোফিলিয়া জিন বহনকারী বেশির ভাগ নারীর আলাদা করে কোনো উপসর্গ লক্ষ করা যায় না। তবে অস্ত্রোপচার হলে অত্যধিক রক্তপাত, ঋতুস্রাবের সময় প্রচুর রক্তপাত এবং গায়ে নীল দাগ দেখে অনেক সময় বোঝা যায়—সেই নারী হিমোফিলিয়ার বাহক। যখন এই পরিবর্তন উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া যায়, তখন এটি মা-বাবা থেকে সন্তানদের কাছে চলে যায়।

সাধারণত পুরুষরা এ রোগে আক্রান্ত হয় বা রক্তক্ষরণজনিত সমস্যায় ভোগেন বেশি। তবে নারীরা রোগটির জিন বৈশিষ্ট্য ধারণ করলেও রক্তক্ষরণজনিত সমস্যায় তেমন ভোগেন না।

 

ভয়াবহতা

হিমোফিলিয়া হলে শরীরে রক্ত জমাট বাঁধা প্রক্রিয়ার অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়। তবে এই রোগে সামান্য কাটা-ছেঁড়ায় তেমন সমস্যা হয় না; কিন্তু দুর্ঘটনার কারণে অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা দেহের কিছু গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যেমন—অস্থিসন্ধি (হাঁটু, কনুই) মস্তিষ্ক, পেটের গহ্বর ইত্যাদি কেটে গেলে বা সার্জারির সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়ে মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। অর্থাৎ আক্রান্ত ব্যক্তির দেহের কোনো অংশ কেটে গেলে স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি রক্তপাত হয়। এই অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে রোগী অকালে মৃত্যুবরণ করতে পারে। যারা বেঁচে থাকে, তাদের শরীরের ভেতর বিভিন্ন জায়গায় অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণে আস্তে আস্তে হাত পা গিরাগুলো নষ্ট হয়ে যায় বা পঙ্গু হয়ে যায়।

 

লক্ষণ

বেশির ভাগ হিমোফিলিয়ার লক্ষণ প্রকাশ পায় শৈশবকালে। অনেকের আরো পরে প্রকাশ পেতে পারে। সাধারণত জন্মের ছয় মাস বয়স থেকে অর্থাৎ শিশুটি যখন হামাগুড়ি দিতে শেখে তখন থেকেই কিছু লক্ষণ দেখা দেয়, যা দেখে বোঝা যায় সেই নবজাতকের হিমোফিলিয়া রয়েছে কি না। যেমন—

 

❏জন্মের পর নাড়ি কাটার পরও রক্তক্ষরণ হয়।

❏এই রোগ থাকলে শিশুদের চলাফেরা বা খেলাধুলার সময় পড়ে গেলে মাংসপেশিতে কালশিরা পড়ে যায়।

❏পেশির অভ্যন্তরে রক্তক্ষরণের ফলে দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো ফুলে যায় এবং ব্যথা অনুভব করে।

❏অভ্যন্তরীণ রক্তপাতের ফলে অস্থিসন্ধিতে চাপ পড়ে এবং ক্ষয় হয়।

❏খতনা করার পর অতিরিক্ত রক্তপাত হয়।

❏প্রস্রাব-পায়খানার সঙ্গে রক্ত যায়।

❏দুর্ঘটনা ঘটলে বা শরীরের কোনো স্থান কেটে গেলে অনেক বেশি রক্ত ঝরতে থাকে।

❏শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলো যেমন—অস্থিসন্ধি, মস্তিষ্ক, পেটের গহ্বর ইত্যাদি কেটে গেলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হতে পারে।

 

চিকিৎসা

হিমোফিলিয়া নিরাময়যোগ্য রোগ নয়। তবে সঠিক চিকিৎসা ও যত্ন পেলে সুস্থ এবং সক্রিয় জীবনযাপন করা যায়। ব্যয়বহুল হলেও এই রোগের আধুনিক চিকিৎসা ও ওষুধ দেশেই পাওয়া যাচ্ছে। তবে এর চিকিৎসা নির্ভর করে রোগের ধরন, মাত্রা ও রোগীর বয়সের ওপর। রক্তপাত বন্ধ করা ও রক্তপাতের হার কমানোই হিমোফিলিয়ার মূল চিকিৎসা।

সাধারণত ফ্যাক্টর ৮ বা ৯ অথবা প্লাজমা শিরাপথ দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। এ ছাড়া ছোট কোনো ক্ষত সৃষ্টি হলে ব্যান্ডেজও করতে হয়। ত্বকের নিচে রক্তপাতের ক্ষেত্রে অনেক সময় আইস ব্যাগ ব্যবহার করতে হয়। অভ্যন্তরীণ রক্তপাতের কারণে অস্থিসন্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হলে ফিজিওথেরাপি দিতে হয়। সামান্য কেটে গেলে ব্যান্ডেজ করে দিলেই চলে।

 

সতর্কতা

পরিবারের কারো হিমোফিলিয়া থাকলে, শিশুদের অস্থিসন্ধি ফুলে গেলে বা ব্যথা অনুভব হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। এ ছাড়া জীবনযাপন পদ্ধতিতে তাদের বেশ কিছু পরিবর্তন আনা উচিত। যেমন—

 

❏হিমোফিলিয়া রোগীকে প্রতিদিন কিছু ব্যায়াম যেমন—সাঁতার কাটা, সাইকেল চালানো এবং হাঁটার অভ্যাস করতে হবে। তবে ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, রেসলিংয়ের মতো খেলা থেকে বিরত থাকতে হবে।

❏আঘাত লাগতে পারে এমন কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে।

❏রক্তক্ষরণ শুরু হলে দ্রুত নিকটস্থ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। রোগীকে বিশ্রামে থাকতে হবে এবং রক্তক্ষরণের স্থানে বরফ দিয়ে চেপে রাখতে হবে।

❏অস্থিসন্ধিস্থলে রক্তক্ষরণ হলে জায়গাটির নড়াচড়া বন্ধ করে দিতে হবে অথবা ক্রেপ ব্যান্ডেজ ব্যবহার করতে হবে।

❏যাদের রক্ত জমাট বাঁধার বা রক্তপাত দীর্ঘ সময় ধরে হওয়ার প্রবণতা রয়েছে, তাদের অবশ্যই দাঁতের চিকিৎসা বা যেকোনো অপারেশনের আগে চিকিৎসকের পরামর্শে শিরাপথে ওষুধ, রক্ত বা রক্তজাত পদার্থ নিতে হবে। এতে যাদের হিমোফিলিয়া রয়েছে তাদের রক্ত জমাট বাঁধা বা দীর্ঘ রক্তপাতের সমস্যা কম হবে।

❏রক্তক্ষরণ বৃদ্ধি পেতে পারে এমন ওষুধ যেমন—এসপিরিন এনএসআইডি, ক্লোপিডিগ্রল ইত্যাদি সেবন করা যাবে না। মাংসপেশিতে কোনো ধরনের ইনজেকশন প্রয়োগ করা যাবে না।

❏কোনো ক্ষত থেকে ক্রমাগত রক্তক্ষরণ হতে থাকলে এবং নির্দিষ্ট সময় পরেও বন্ধ না হলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।

❏ক্রমাগত জয়েন্টে ব্যথা অনুভব হলে এবং স্পর্শ করলে গরম অনুভূত হলেও চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

❏কোনো নারী যদি হিমোফিলিয়া জিন বহন করে থাকেন তবে সন্তান জন্মদানের আগে (প্রিন্যাটাল) রোগ নির্ধারণ করে ভ্রূণের অবস্থা জেনে হিমোফিলিয়া সম্পর্কে সতর্ক হতে হবে।

 

বাড়াতে হবে সচেতনতা

হিমোফিলিয়া সম্পর্কে ব্যাপক সচেতনতা তৈরি হলেই এতে জটিলতা এড়ানো সম্ভব। এখনো এ সম্পর্কে মানুষ তেমন অবগত নয়। আশার কথা যে, এই রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধিতে বাংলাদেশেও বিশ্ব হিমোফিলিয়া ডে বেশ গুরুত্ব দিয়েই পালিত হচ্ছে। হিমোফিলিয়া সোসাইটি অব বাংলাদেশ, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটির হেমাটোলজি বিভাগসহ দেশের বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজগুলো কাজ করে যাচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!