class="post-template-default single single-post postid-50274 single-format-standard wp-custom-logo group-blog vl-boxed aa-prefix-matin-">
Shadow

একাত্তরের শহীদ ছবুর : যুদ্ধ শেষে যে ছেলেটি বাড়ি ফেরেনি

গাজী আবদুস ছবুর ১৯৫১ সালের ১৪ই অক্টোবর চট্টগ্রামের পটিয়া থানার ৪ নং ওয়ার্ডের শেয়ান পাড়ার গাজী বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মৃত গাজী আলী চাঁন সওদাগর পেশায় একজন লবণ ব্যবসায়ী এবং মাতা মৃত ছমেরাজ খাতুন। গাজী আলী চাঁন সওদাগরের তিন পুত্র ও দুই কন্যাসন্তানের মধ্যে গাজী আবদুস ছবুর ছিলেন পিতামাতার ২য় সন্তান। শহিদ ছবুরের বড়ো ভাই গাজী আবদুছ ছালাম ছোটোবেলায় জ¦রে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ছোটো ভাই গাজী সেলিম পেশায় ব্যবসায়ী ও  ছোটো দুই বোন জরিনা  বেগম ও জাহেদা বেগম। একাত্তরে শহীদ ছবুরের গল্পটা শোনাচ্ছেন রশীদ এনাম

 

শৈশব ও ছেলেবেলা

গাজী ছবুর ছোটোবেলা থেকে বেশ দুরন্ত ও দস্যি। ফুটবল, ব্যাডমিন্টন ছিল প্রিয় খেলা।  কৈশোরে পাড়ার বন্ধুদের সাথে হই হুল্লোড় করে ছুটিয়ে  বেড়াতেন। ছেলেবেলা থেকে ছিলেন  রসিক ও আমুদে প্রকৃতির । বন্ধুদের মন খারাপ থাকলে কৌতুক আর হাসির গল্প শুনিয়ে মন ভালো করে দিতেন।

গাজী ছবুরের কণ্ঠ ছিল অসাধারণ। ছেলেবেলায় গলা ছেড়ে গান গাইতে গাইতে বাড়ি ফিরতেন। সবসময় বাড়ির সামাজিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে জড়িয়ে রাখতেন। গ্রামে গায়েহলুদ বা মেজবান, বিয়ে শাদির অনুষ্ঠানে তাঁর উপস্থিতি থাকত।

ইশকুলবেলায় বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে শেয়ান পাড়ার অদূরবর্তী বাঁকখালী গ্রামের পশ্চিম বিলে গিয়ে চড়ুইভাতি আয়োজন করতেন। দিনভর বাঁকখালীর বাঁকে জাল পেতে মাছ শিকার করতেন। রাতভর চড়ুইভাতি খেয়ে বাড়ি ফিরতেন। জোছনাভাঙা রাতে গানের আসর বসাতেন পুকুর ঘাটে। বাড়ির ছোটো শিশুদের খুব ভালোবাসতেন এবং গ্রীষ্মকালে দল বেঁধে পুকুরে ডুবসাঁতার, কখনো ফুটবল, কখনো-বা দাঁড়িয়াবান্ধা, বউছি, কানমাছি খেলতে  খেলতে বেলা কাটিয়ে দিতেন। দুরন্ত ও দস্যিপনায় বেড়ে ওঠেন গাজী ছবুর।  ছোটোবেলায় বলতেন, ফুল এবং শিশু দুটোই আমার প্রিয়।

শহীদ ছবুর
শহীদ ছবুর

শিক্ষাজীবন

পটিয়া পৌরসভার ৪ নং ওয়ার্ড-র শেয়ান পাড়া গ্রামের পশ্চিম পটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক এবং আবদুস সোবহান রাহাত আলী উচ্চ বিদ্যালয় হতে এসএসসি পাশ করে পটিয়া সরকারি কলেজে ভর্তি হন। সে সময় পটিয়া কলেজে ছাত্রলীগের  কান্ডারি ও দিশারী  নামে দুটি সংগঠন ছিল।

 শহিদ ছবুর ১ম বর্ষে অধ্যয়নরত অবস্থায় কান্ডারি সংগঠনে যোগ দেন।  গাজী  ছবুর পড়ালেখায় যেমন মেধাবী তেমনই বেশ সাহসীও ছিলেন। তাঁর কণ্ঠ ছিল অসাধারণ, পটিয়া কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রায় গান গাইতেন,  তাঁর খুব প্রিয় একটা গান ছিল।  গানটা গেয়ে  বেশ সুনামও অর্জন করেছিলেন রিকশাওয়ালা বলে কারে তুমি আজ ঘৃণা করো, কৃষক শ্রমিকদের হেলা করো, গরিব দুঃখীদের এড়িয়ে চলো। মাত্র ২২ বছর বয়সে ইন্টারমিডিয়েটে অধ্যয়ন করার সময় কান্ডারি গ্রুপের সাহসী কান্ডারি হয়ে ওঠেন টগবগে যুবক গাজী ছবুর ।

 

৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ও তাঁর স্মৃতিকথা

১৯৭১ সালে তিনি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। কান্ডারি গ্রুপের অন্যতম ছাত্র নেতা গাজী আবদুস ছবুর (২২) তখন পটিয়া সরকারি কলেজে ইন্টারমিডিটেয়ের ছাত্র। বেশ বীরত্বের সাথে তিনি পাক হানাদার বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করেন। একবার যুদ্ধকালীন খানমোহনা রেল স্টেশনে রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করে মুক্তিযোদ্ধারা। সে আক্রমণে গাজী আবদুস ছবুরও ছিলেন এবং সে  অপারেশন  তিনজন রাজাকার মারা যায়। সে সময় গাজী ছবুরসহ মুক্তিযোদ্ধারা হাইদগাঁও এর বড়ো মিয়ার দরগাহ (পূর্ব দরগাহ নামে পরিচিত) হাজির মাঠে অবস্থান করেন। সেখানে  মশার যন্ত্রণায় নাকি বসা যেত না, ঘুমাতে পারতেন না মুক্তিযোদ্ধারা। এক বিকেলে গাজী ছবুর  মুক্তিযোদ্ধাদের বললেন,  বন্ধুরা ভয় পেয়ো না। বিষাক্ত মশাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। মশাকে ভয় পেলে রাজাকার, পাক বাহিনী কেমনে খতম করবে? এই দেখো, আমি একসাথে ১০টা মশা খতম করে দিয়েছি। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে গাজী ছবুর ছিলেন অত্যন্ত সাহসী। ১৯৭১ সালে, সে সময় তিনি বীরত্বের সাথে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে মুক্তিবাহিনীর কাছে বেশ সুনাম ও বীরত্বের পরিচয় দিয়েছেন।  সে সময় অনেক মুক্তিযোদ্ধা বাড়ি ফিরলেও শহিদ আবদুস ছবুর বাড়ি ফিরেননি। কী ঘটেছিল সেদিন ?

 

যেভাবে শহীদ হলেন গাজী ছবুর

দক্ষিণ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার চৌধুরী মাহবুব জানান,  ১৯৭১ সালের ২রা অক্টোবর রোজ শনিবার  ছবুরসহ আমরা গিয়েছিলাম ভট্টাচার্য হাটে। ৭১ এর ঘাতক রাজাকার রশীদ কে ধরার জন্য। রশীদকে না পেয়ে তার ভাই  মনু মিয়াকে মুক্তিযোদ্ধারা ধরে নিয়ে যায় পটিয়া ভট্টাচার্য হাটে, মনু মিয়া পটিয়া থানা হাটের হাসিল (খাজনা বা ভাড়া বিশেষ) উঠাত। মনু মিয়ার পরিবারের সদস্যরা  ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে বেশ সখ্যতা করে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে ধরিয়ে দিত এবং ওদের সাথে যোগসাজশে মুক্তিবাহিনীর উপর অত্যাচার করত। পাক হানাদার বাহিনীকে মুক্তিযোদ্ধাদের সব তথ্য ফাঁস করে দিত।

রাজাকার অপারেশনে যাওয়ার সময় ছবুরের সাথে অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধা সঙ্গীসাথিদের মধ্যে ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা চৌধুরী মাহাবুব, এসএম ইউসুফের ভাই মুক্তিযোদ্ধা নাছির উদ্দিন, মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ ছফা চৌধুরী প্রমুখ। রাজাকার রশিদের ভাই মনু মিয়াকে শহিদ আবদুস ছবুর পিছন দিক থেকে জাপটে ধরে ফেলে। এই কোথায় যাচ্ছিস তুই বলে চিৎকার করে ওঠেন। মনু মিয়াকে দু হাতে শক্ত করে  চেপে ধরেন। গাজী ছবুর ছিলেন শক্তিশালী বীর, তাঁর ছিল সুঠাম লম্বা দেহ। 

সে সময় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার শামসুদ্দিন মনু মিয়াকে হঠাৎ করে ব্রিটিশের তৈরি কাঠের বাঁটের স্টেনগান দিয়ে ধপাস করে ফায়ার করল, মনু মিয়ার শরীরে গুলি ভেদ করে হঠাৎ বীর মুক্তিযোদ্ধা গাজী ছবুরের বুকে ও ডান হাতে ৬টি বুলেট বিদ্ধ হয়। রাজাকারের ভাই মনু মিয়ার সাথে শহিদ ছবুরও মাটিতে লুটিয়ে পড়েন ভট্টাচার্য হাটে। বুকে বুলেট বিদ্ধ অবস্থায় প্রায় তিন ঘণ্টা মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়েন। শহিদ আবদুস ছবুরের চিৎকারে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। গাজী ছবুর মৃত্যুর সময় বারবার বলছিলেন, খবরদার ! তোরা হাত থেকে অস্ত্র  ফেলবি না বন্ধু, আমি মরে গেলেও দেশ স্বাধীন হবে। আমার মৃত্যুর খবর মাকে বলবি না । তঁাঁকে বলবি আমি ইন্ডিয়ায় ট্রেনিং নিতে গিয়েছি। পারলে  আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যা। সে সময় হাইদগাঁও এলাকার বাসিন্দা নবী (আমিনার বাপ), কে দিয়ে সামান্য ট্রিটমেন্ট দেওয়া হয়।

যুদ্ধকালীন এমন পরিস্থিতি ছিল  যে, হাসপাতালে নেওয়ার মতো পরিস্থিতিও ছিল না । চারিদিকে রাজাকার, আলবদর ও পাক বাহিনীরা উৎপেতে থাকত। একসময় ভট্টাচার্য হাটে শাহাদতবরণ করেন গাজী আবদসু ছবুর।

শামসুদ্দিন খুব নার্ভাস হয়ে বাক্-রুদ্ধ হয়ে পড়েন। শহিদ আবদুস ছবুরের লাশটা মাটিতে পড়ে থাকল কিছুক্ষণ। মুক্তিযোদ্ধা  চৌধুরী মাহাবুব এবং মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ ছফা, মুক্তিযোদ্ধা নাসির আরও পাহাড়ি এলাকার কিছু লোক মিলে শহিদ ছবুরের লাশ বাঁশের তৈরি মাচাং  এ করে, কেলিশহরস্থ খিল্লাপাড়ার গুড় টিলা পাহাড় থেকে দুই তিন কিলোমিটার দূরে ভুঁড়ি পাড়ায় নিয়ে যাওয়া হলো।

শহীদ গাজী আবদুস ছবুরের বুলেটসহ নিথর মরদেহ। রক্ত  ভেজা ছিল জামা। রক্তমাখা সেই জামাটি  প্রায় ১২ বছর সংরক্ষণ ছিল (গাজী আমিন মঞ্জিলে) শহিদ ছবুরের দাদি মরহুমা জোবেদা খাতুনের কাছে। পরবর্তীতে উইপোকা জামাটি  খেয়ে ফেললে তা আর সংরক্ষণ করা যায়নি। ২রা অক্টোবর  শেয়ান পাড়া গ্রামের এমনকি পরিবারের কেউ জানত না যে গাজী আবদুস ছবুর শহিদ হয়েছেন।

এক দিন পরে শেয়ানপাড়ার প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ কবির শহিদ ছবুরের চাচা মৌলবি আবদুল লতিফ ( প্রকাশ লালু ফকির )কে শহিদ ছবুরের মৃত্যুর সংবাদটি প্রথমে জানায়। ওদিকে ছবুরের মা ছমেরাজ খাতুন ৭১ এর তরুণ মুক্তিযোদ্ধা গাজী ছবুরের জন্য প্রতীক্ষায় রইলেন।

১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধারা বাড়ি ফিরল, ছমেরাজ খাতুন কলিজার টুকরো গাজী ছবুরের জন্য চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়লেন। ছমেরাজ খাতুন তাঁর ছোটো ছেলে গাজী সেলিমকে বলে তুই একটু খবর নে বাবা, তোর মেজো ভাই  ছবুর কেন বাড়ি আসছে না। ছেলেটা না খেয়ে আছে। অনেক মুক্তিযোদ্ধা বাড়ি ফিরেছে সে কেন ফিরছে না

ছবুরের মা ছেলের জন্য  ছটফট করতে লাগলেন। একসময় ছমেরাজ খাতুনের জানা হয়ে যায় অন্তরে। ছেলে বাড়ি ফিরছে না নিশ্চয় কোনো বিপদ-আপদ হয়েছে। ছমেরাজ খাতুন মিছেমিছি সান্ত¦না দেন নিজেকে। আমার ছেলে বীর কান্ডারি তাঁর কোনো ক্ষতি হতে পারে না। সে একাই একশ। সেলিম দেখবি, তোর  মেজো ভাই ছবুর সকালবেলা গান গাইতে গাইতে বীরের বেশে বাড়ি ফিরবে

অতঃপর  পর একসময় শহিদ ছবুরের মা ছমেরাজ খাতুন জানতে পারেন যে,  খোকা গাজী ছবুর আর নেই। প্রিয় সন্তান হারিয়ে বাক্-রুদ্ধ  হয়ে পড়েন। ছেলে হারানো মা ছমেরাজ খাতুন না খেয়ে অনাহারে চা বি¯ুট, নাশতা খেয়ে  ১২ বৎসর বেঁচেছিলেন।

শহীদ আবদুস ছবুরের মৃত্যু নিয়ে আজও অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের মনে কৌতূহল ও রহস্য রয়ে গেছে। মৃত্যুর পর তাঁর কবরটি পর্যন্ত নিজভূমে আনা হয়নি। দিশারী গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধারা বলেন, শহিদ ছবুরকে কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে মারেনি। মনু মিয়াকে মারতে গিয়ে, গাজী আবদুস ছবুর সেম সাইডে দুর্ঘটনায় শাহাদতবরণ করেন। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার  শামসুদ্দিন বলেন, আমার বন্দুকের গুলিতে শহিদ ছবুর শাহাদতবরণ করেন , আসলে এটা ছিল একটা দুর্ঘটনা।

গুলিবিদ্ধ অবস্থায় শহিদ ছবুরকে কেলিশহরের  খিল্লাপাড়া গুড় টিলা পাহাড়ের  লেকের পাশে আখেরি গোসল দেওয়া হয়। পরিধানের লুঙ্গি দিয়ে কাফন তৈরি করে দু চারজন মুক্তিযোদ্ধা মিলে  ছোটো পরিসরে শহিদ ছবুরের জানাজা পড়েন। ঐ রাতে গুর টিলা পাহাড়ে তাঁকে দাফন করা হয়। পটিয়া কেলিশহরের কিল্লাপাড়ার গুর টিলা পাহাড়ে চিরতরে ঘুমিয়ে আছেন  শহিদ ছবুর।

 

স্মরণে আবরণে একাত্তরের শহীদ ছবুর

গাজী ছবুর শহিদ হওয়ার পর ১৯৭২ সালে পটিয়া মুন্সেফ বাজারস্থ শুকুর আলী মুন্সেফ মসজিদের পাশে দুবাইস্থ কানাডিয়ান বিশ^বিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নুরুল আলমসহ তাঁর সহপাঠীরা মিলে অগ্রপথিক সংঘ শহীদ ছবুর স্মৃতি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কালের বিবর্তনে সেটিও আজ হারিয়ে গেছে। পরবর্তীতে তাঁর স্মরণে পটিয়া সদরের প্রাণকেন্দ্রে থানার মোড় সংলগ্ন শহীদ ছবুর রোড নামে একটি সড়ক রয়েছে।

 বর্তমানে পটিয়া  কেলিশহরস্থ খিল্লাপাড়ায় শহিদ আবদুস ছবুরের নামে একটি সরকারি  প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। ৫১টি বছর কেটে গেল, আজও শহিদ ছবুরের কবরটি পাহাড়ের পাদদেশে পড়ে আছে অরক্ষিত অবস্থায়। শহিদ ছবুরের গ্রাম শেয়ান পাড়ায় গ্রামবাসী রাখেনি কোনো স্মৃতিচিহ্ন।

ছেলেবেলায় মায়ের মুখে প্রথম শুনেছিলাম মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা। সেই সময় নানাবাড়িতে আগুন দিয়েছিল পাক হানাদার বাহিনী। চারদিকে আগুন, গোলাগুলি আর বোমাবজি। চিৎকার আর আহাজারির শব্দ। বাতাসে লাশের গন্ধ। মায়ের বয়স আর কত চার-পাঁচ। মাকে পাখির ডানার মতো শাড়ির আঁচলে আগলে রাখতেন নানুমণি।

একাত্তরের সেই গল্প শুনে ভয়ে শিউরে উঠতাম। চোখে দেখিনি ৭১। মুক্তিযুদ্ধের নাটক, ছবি আর ইতিহাস পড়ে উপলব্ধি করতাম, যুদ্ধের স্মৃতিকথা শুনে কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যেতাম। ইশকুলবেলায় যখন জানতে পারলাম আমার খুব কাছের প্রতিবেশী শহিদ ছবুরের কথা তখন থেকে তাঁর জীবনি জানার চেষ্ঠা করেছি। তাঁর পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে, শহিদ ছবুরের বন্ধুবান্ধবও সহপাঠিদের ও সহযোদ্ধাদের কাছ থেকে অবশেষে ১৪ বছর গবেষণা করে গত ২০১৬ সালে বলাকা প্রকাশন থেকে একাত্তরের শহীদ ছবুর নামে একটি গবেষণামুলক প্রবন্ধ প্রকাশ হওয়ার পর ধামাচাপা পড়া একটা বিস্মৃত  অধ্যায় সম্পর্কে বর্তমান প্রজন্ম জানতে পারে। বইটির আলোকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যেমে একটি গ্রুপ খোলা হয়। গ্রুপটির নাম  দেওয়া হয় একাত্তরের শহীদ ছবুর ফেসবুক গ্রুপ। বর্তমানে এই গ্রুপের সদস্য সংখ্যা প্রায় দুই হাজারেরও বেশি।

গত ২০১৯ সালে ২৮ মার্চ পটিয়া প্রথম শিশুতোষ পাঠাগার করার পরিকল্পনা করি, সেই পাঠাগারটির নামকরণ করা হয় শহিদ ছবুর শিশুতোষ পাঠাগার। স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে এসেও শহিদ ছবুরের পরিবার শহিদ ভাতা পেত না। গত ২৭/১০/২০২১ সালে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আবেদন করার পর গত ১৯ মে ২০২২ তারিখ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় তাঁর নাম গেজেট ভুক্ত হয়। অবশেষে অনেক চড়াই উতড়াইয়ে দীর্ঘ ৫১ বছর পর শহিদ স্বীকৃতি পেলেন। গত ২৭ অক্টোবর ২০২২ তারিখে শহিদ ছবুরের দুই বোন ও ভাইয়ের নামে ভাতা বই ও রেশন কার্ড প্রদান করা হয়। অবশেষে শহিদ পরিবার শহিদ ভাতা ও রেশন কার্ড পাচ্ছে !

 

ফেসবুক গ্রুপের দাবি

২ অক্টোবর শহিদ ছবুরের ৫১তম শাহাদতবার্ষিকী। পটিয়ার জনপ্রতিনিধিদের কাছে শেয়ান পাড়া শহিদ ও মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিবিজড়িত পশ্চিম পটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে ৭১ এর চেতনা ও শহিদ স্মৃতিস্তম্ভ  স্থাপন করার জন্য সবিনয় নিবেদন করছি। অতীতে জনপ্রতিনিধিরা শহিদ ছবুর স্মৃতিস্তম্ভ করার  কথা দিয়েও কথা রাখেনি। বর্তমানে তাঁর পরিত্যক্ত ও অবহেলিত কবরটি পাকা করে দেয়ার জন্য পটিয়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জনাব আতিকুল মামুন একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেন। 

 বিজয়ের মাসে আমার প্রাণের দাবি শহিদ ছবুরের কবরটি তাঁর নিজভূমে শেয়ানপাড়া গ্রামে স্থানান্তর করা এবং শহিদ ছবুরের নামে ইশকুল মাঠে অতিসত্বর একাত্তরের  চেতনা ও শহিদ ছবুর স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করা। পরিশেষে একাত্তরের শহিদ ছবুরসহ বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যারা নিজের জীবন হাতের মুঠোয় নিয়ে দেশের জন্য নিজেদের উৎসর্গ করেছেন তাঁদের প্রতি রইলো বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।

 

রশীদ এনাম : একাত্তরের শহিদ ছবুর গ্রন্থের লেখক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!