ডায়াবেটিস আক্রান্তের সংখ্যা উত্তোরত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমনকী কঠোরভাবে চিকিৎসকের নির্দেশমতো চলার পরেও নিয়ন্ত্রণে আসছে না রক্তে শর্করার মাত্রা। সাম্প্রতিক কিছু সমীক্ষায় জানা যাচ্ছে, ভাত খাওয়ার অভ্যেস, মহিলাদের দীর্ঘক্ষণ কর্মরত থাকা হয়ে উঠতে পারে ডায়াবেটিসের অনুঘটক। বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস উপলক্ষে রইল বিশেষ প্রতিবেদন।
১৪ নভেম্বর। দিনটিকে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস বলা হয়। ডায়াবেটিস রোগটি সম্পর্কে বিশ্বময় সচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রতিবছর এই দিনটিকে পালন করা হয়। এই অভিযানের মূল লক্ষ্য হল, আরও বেশি শিশু ও তরুণকে এই রোগের পরিচর্চার আওতায় আনা। ডায়াবেটিসের জরুরি সংকেত সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা। এ রোগের একটি জটিলতা ‘ডায়াবেটিক কিটো এসিডোসিস’ হ্রাস করার উদ্যোগ উৎসাহিত করা। এ দিবসের নীল বৃত্তের ‘লোগো’টি ডায়াবেটিসকে পরাভূত করার জন্য বিশ্বব্যাপী লড়াইয়ের সূচক। অবশ্য উল্লেখ্য, বস্তুত, এই দিনটিতে জন্ম নিয়েছিলেন বিজ্ঞানী ফ্রেডরিক বেন্টিঙ্ক এবং তিনি বিজ্ঞানী চার্লস বেস্টের সঙ্গে একত্রে ইনসুলিন আবিষ্কার করেছিলেন।
মুশকিল হল, ডায়াবেটিস রোগটি ক্রমশ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। আজ পৃথিবীতে ২৫ কোটিরও বেশি মানুষ ডায়াবেটিস রোগের শিকার হয়ে বসে আছেন। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে ডায়াবেটিস ‘মহামারী’ আকার ধারণ করেছে জানিয়ে আগামী বছরগুলোতে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে ইতিমধ্যে সতর্ক করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক কার্যালয়। আর আমাদের দেশ অর্থাৎ সংস্থার আঞ্চলিক কার্যালয়। আর আমাদের দেশ অর্থাৎ ভারতবর্ষকে বলা হচ্ছে বিশ্ব ডায়াবেটিস-এর রাজধানী।
চিনির থেকেও বিপদ সাদা চালে
ডায়াবেটিসের জন্য সাধারণত চিনি বা শর্করাজাতীয় খাবারকে দায়ি করা হয়। কিন্তু সম্প্রতি একদল গবেষক জানিয়েছেন চিনি জাতীয় খাবারের চেয়ে ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ সাদা চাল। সিঙ্গাপুরের স্বাস্থ্য উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান নির্বাহী ডক্টর জি ইয়ু ক্যাং বলেন, পশ্চিম বিশ্বের জন্য স্থূলতা এবং শর্করা জাতীয় খাবার ডায়াবেটিস হওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম ঝুঁকি। কিন্তু ইন্দো-ইউরোপীয় দেশগুলোর চেয়ে এশিয়ার দেশগুলোতে এই রোগটিকে নিয়ে বেশি আলোচনা হয় এবং আক্রান্তের সংখ্যাও বাড়ছে। সাদা চাল খেলে শরীরে ব্লাড সুগারের পরিমাণ বাড়ে এবং সঙ্গে ডায়াবেটিসেরও উচ্চ ঝুঁকির সৃষ্টি হয়। ডক্টর ক্যাং অন্তত চারটি গবেষণা শেষে এই তথ্য জানিয়েছেন। এই গবেষণা চালানো হয়েছে সাড়ে তিন লক্ষ মানুষের ওপর এবং তাদের বয়স ছিল চার থেকে কুড়ি বছর।
হার্ভার্ড স্কুল অব পাবলিক হেলথ-এর করা এই গবেষণাটি সম্প্রতি ‘ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল’-এ প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, দিনে নিয়মিত এক প্লেট সাদা চাল খেলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি এগারো শতাংশ বাড়ে। দুই ক্যান কোমল পানীয়ের চেয়ে এক ডিশ সাদা চালের ভাতে দ্বিগুণ কার্বোহাইড্রেট আছে। আমাদের শরীরে থাকা অগ্ন্যাশয় ইনসুলিন উৎপন্ন করে এবং রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। সাদা চালের ক্ষেত্রে শর্করা খুব দ্রুত রক্তে পৌঁছে যায়। যার ফলে অগ্ন্যাশয়ের কার্যক্রমকে কঠিন করে তোলে। এটা যখন প্রায়ই ঘটে তখন ইনসুলিন তৈরিতে অগ্ন্যাশয় দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে পারে না। ফলে এই শর্করা কিডনির ব্যাপক ক্ষতি করতে পারে। কেবল চাল নয়, নুডলসেও অনেক শর্করা আছে।
অতিরিক্ত কাজ মেয়েদের সুগার-ঝুঁকি বাড়ায়
এতো গেল চালের কথা। এবার আসা যাক কাজের কথায়। বলা হচ্ছে, অতিরিক্ত কাজ নারীদের ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়, সপ্তাহে ৪৫ ঘণ্টা বা তার বেশি কাজ করলে নারীদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে বলে জানিয়েছেন কানাডার একদল বিজ্ঞানী। তবে যেসব নারী সপ্তাহে ৩০-৪০ ঘণ্টা কাজ করেন তাদের এ ভয় নেই। মজার ব্যাপার হল, পুরুষদের ক্ষেত্রে বিষয়টা সম্পূর্ণ উল্টো। কানাডার বিজ্ঞানীরাই বলেছেন, বেশি কাজ পুরুষদের ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে ডায়াবেটিস রোগ আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাওয়ায় এ নিয়ে সেখানে উদ্বেগের শেষ নেই। প্রায় সাড়ে তিন কোটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ সেদেশে এ রোগে আক্রান্ত। প্রতি বছর সেখানে ১৫ লক্ষ করে মানুষ নতুন করে এ রোগের শিকার হয়ে চলেছে। তাই উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে গেছে চিকিৎসা সংক্রান্ত খরচাপাতিও। যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের সক্ষমতা কমছে দ্রুত ও অর্থনীতিতে এর একটা বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাবও পড়ছে। গবেষকদের ভাষ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে সে দেশে ৩২ হাজার কোটি ডলার ক্ষতি গুনতে হয়েছে। আর এই কারণেই দেশটির নীতি নির্ধাকরদের মধ্যে টনক নড়েছে। শুরু হয়ে গেছে ডায়াবেটিস নিয়ে ব্যাপক গবেষণার তোড়জোড়। এই গবেষণায় সম্পৃক্ত হয়েছেন কানাডার বিজ্ঞানীরাও।
২০০৩ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত কানাডার ৩৫ থেকে ৭৪ বছর বয়সি ৭ হাজার ৬৫ জন নারী-পুরুষ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে এবং তাদের চিকিৎসা-বিষয়ক রেকর্ডের ওপর ভিত্তি করেই বিজ্ঞানীরা এমন মতামত প্রকাশ করেছেন। কানাডার বিজ্ঞানীদের এই সংক্রান্ত গবেষণা রিপোর্টটি ‘ডায়াবেটিস রিসার্চ অ্যান্ড কেয়ার’ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণায় বিচার্য বিষয়গুলির মধ্যে ছিল তাদের বয়স, লিঙ্গ, তারা কোন সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত, তাদের জন্ম কোথায়, তাদের লাইফ স্টাইল, তারা বিবাহিত কি না, সন্তান আছে না নেই, পূর্বে কোনও অসুখ হয়েছিল কি না— এসবই বিবেচনায় রাখা হয়।
দেখা গেছে, যে সব পুরুষ বেশি কাজ করে তাদের ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম, আর মহিলাদের ক্ষেত্রে ফল উল্টো। সপ্তাহে ৪৫ ঘণ্টা বা তারও বেশি কাজ করা নারীদের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা ৩৫ থেকে ৪০ ঘণ্টা কাজ করে নারীদের চেয়ে ৬৩ শতাংশ বেশি। নারীদের লাইফস্টাইলের সঙ্গেও ডায়াবেটিসের একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে বলে জানিয়েছেন ওই গবেষকরা। ধূমপায়ী ও অ্যালকোহল আসক্ত নারীদের ডায়াবেটিসের কবলে পড়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।
ডায়াবেটিস রোগকে রুখতে বিজ্ঞানীরা যে কোমর বেঁধে লড়ছেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
স্মার্ট ঘড়ি
সেই চেষ্টার আর এক সংযোজন হল একটি নামকরা মোবাইল সংস্থার স্মার্ট ঘড়ি। এটি ডায়াবেটিসের প্রাথমিক লক্ষণ শনাক্ত করতে পারে। ‘কার্ডিওগ্রাম’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের তৈরি সফটওয়্যার ব্যবহার করে ওই ঘড়ির সাহায্যে হৃৎস্পন্দনের হার সংগ্রহ করে একটি পরীক্ষা চালিয়েছে কার্ডিওগ্রাম। কার্ডিওগ্রামের গবেষকরা সানফ্রানসিসকোর ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে এক হয়ে কার্ডিওগ্রাম ডিপহার্ট নিউরাল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে পরীক্ষাটি চালান। এই পরীক্ষায় যাদের ডায়াবেটিস আছে এবং যাদের নেই—পার্থক্য করার ক্ষেত্রে ৮৫ শতাংশ সফল হয়েছে সেই ঘড়ি।
পরীক্ষাটি চালানোর জন্য কার্ডিওগ্রাম ১৪ হাজার অংশগ্রহণকারীদের ক্ষেত্রে কুড়ি কোটিরও বেশ সেন্সর ব্যবহার করেছে। যা দিয়ে হৃৎস্পন্দনের হার, চলাফেরার জন্য কত কদম ফেলা হয়েছে এবং প্রাসঙ্গিক কিছু তথ্যের সমন্বয়ে চূড়ান্ত ফল নির্ধারন করা হয়েছে। ডায়াবেটিসের প্রাথমিক অবস্থা অধিকাংশ সময়ই বোঝা এবং নির্ণয় করা যায় না।
কার্ডিওগ্রামের ডিপহার্টের মতো ওই ঘড়ি এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক অ্যালগরিদম ব্যবহার করে ব্যবহারকারীদের সতর্ক সংকেত জানানোর সম্ভাবনা রয়েছে যে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত কোনও সমস্যা রয়েছে। ফলে ব্যবহারকারী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারবে।
টক দই ও ডায়াবেটিস
ডায়াবেটিস বর্তমানে আমাদের দেশে প্রকট আকারে দেখা দিয়েছে। এর হাত থেকে ছোট-বড় কারওরই রক্ষা নেই। এর অন্যতম প্রধান কারণ আমাদের জীবনযাত্রা ও খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন। এই রোগে আক্রান্ত রোগীদের ঘনঘন প্রস্রাব হয় বেশি তৃষ্ণার্ত অনুভব করে এবং বারবার মুখ শুকিয়ে যায়। আক্রান্তরা অতিশয় দুর্বলতা, সার্বক্ষণিক ক্ষুধা, স্বল্প সময়ে দেহের ওপর হ্রাস, চোখে ঝাপসা দেখা সহ নানান সমস্যায় ভোগে। ডায়াবেটিস নির্দিষ্ট মাত্রার বাইরে গেলে তা শরীরে ভয়াবহ ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই এ রোগে আক্রান্ত হলে তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখাই সর্বোত্তম পন্থা। পাশাপাশি কিছু খাবারও ডায়াবেটিস রোগীকে সুস্থ থাকতে সহায়তা করে। এই খাবারগুলো হল সবুজ চা, ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ মাছ, ওয়াইল্ড স্যামল, টক দই, ডিমের সাদা অংশ, লেবু, সবুজ শাক-সব্জি, শস্য দানা, বাদাম, মটর শুঁটি ইত্যাদি।