বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে আমাদের অন্য চিকিৎসক বন্ধুদের সঙ্গে রোগীদের দেখা হলে সেখানেই তারা চিকিৎসকের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলেন, কোন ওষুধ খাবেন, কোন ওষুধে তার পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হচ্ছে ইত্যাদি। কেবল ব্যতিক্রম আমি। আগের রাতে যে মানুষটি নানান সমস্যা নিয়ে আমার কাছে এসেছিলেন, পরেরদিন রাতে এক বিয়ের অনুষ্ঠানে তিনি আমাকে দেখে পালিয়ে গিয়ে বসলেন অন্য একটি খাবার টেবিলে। যেন তিনি আমাকে চেনেনই না। কারণ,আমার সঙ্গে কথা হলে অন্যরা বুঝে ফেলবেন যে তিনি আমার কাছে এসেছিলেন। তাকে আমি ওষুধ দিয়েছি। তা হলে তো মানুষ তাকে পাগল বলবেন। কারণ তিনি পাগলের ডাক্তারের কাছে এসেছিলেন।…ঠিক এখানেই আমাদের সমস্যা, এই মানসিকতাটাই আমাদের বদলাতে হবে। মানসিক সমস্যা মানেই যে পাগল নয়, এটা সমাজকে বোঝানো খুব জরুরি। বলছিলেন, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ। বাংলা ট্রিবিউনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ডা. হেলাল বলেন, বাংলাদেশে মানসিক সমস্যায় যারা ভুগছেন তাদের শতকরা ৯০ ভাগেরই স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরা সম্ভব। তাদের শুধু দরকার পরিবারের সদস্যদের ভালোবাসা। পরিবারকে পাশে পেলেই তারা সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারবেন।
গত এপ্রিলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক সদর দফতরে আত্মহত্যা প্রতিরোধের আঞ্চলিক কর্মকৌশল চূড়ান্তকরণ সভায় অংশ নিয়েছেন। এটা আমাদের জন্য কেন গুরুত্বপূর্ণ?
ডা. হেলাল: এখানে বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, মালদ্বীপ, শ্রীলংকা, নেপাল, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া থেকে প্রতিনিধিরা অংশ নেন। এছাড়া যুক্তরাজ্যের কিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধ্যাপক অথুলা পর্যবেক্ষক হিসেবে যোগ দেন। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ পূর্ব আঞ্চলিক কার্যালয়ের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ের পরামর্শক ডা.নাজনীন আনোয়ার সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করেন।২০১৪ সালের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে ২০১২ সালে মোট আত্মহত্যার সংখ্যা ছিল ১০ হাজার ১৬৭। এর মধ্যে পুরুষ ৪ হাজার ৩৯৪ জন আর নারী ৫ হাজার ৭৭৩ জন। বাংলাদেশে মোট ৬৫ লাখ মানুষ আত্মহত্যার ঝুঁকিতে রয়েছে যাদের মধ্যে বেশিরভাগই কম বয়সী এবং প্রায় ৮৯ শতাংশই নারী। আমি সেখানে ২০১৪ সালে উত্তরায় দুই ভাইবোনের আত্মহত্যার ঘটনাটি তুলে ধরে সেটির কারণ,প্রতিরোধ করা যেত কিনা আর মিডিয়ার ভূমিকা বর্ণনা করি।
বাংলাদেশে আত্মহত্যার প্রবণতা কেন বেশি বলে আপনি মনে করেন?
ডা. হেলাল: বাংলাদেশে যৌতুক ও পারিবারিক নির্যাতন, দাম্পত্য কলহ, প্রেম, সর্ম্পকের নানা জটিলতার কারণে এই ঝুঁকি এখানে বেশি। এছাড়াও রয়েছে ইভটিজিং এর মতো বিষয়, অনাকাঙ্খিত গর্ভধারণ,লোকলজ্জার ভয়, পরীক্ষায় ব্যর্থতায় বাবা-মায়ের কঠোর শাসন, অর্থনৈতিক অসক্ষমতা, মানসিক অসুস্থতা। আমাদের দেশে বিষন্নতা, মাদকনির্ভরতা, ব্যক্তিত্বের বিকারসহ সিজোফ্রেনিয়াতে প্রায় ১৬ দশমিক ১ শতাংশ পরিণত বয়সের নারী পুরুষ এবং ১৮ দশমিক ৪ শতাংশ শিশু মানসিক সমস্যায় ভুগছে।
পরিবার,সমাজের উদ্দেশ্যে কিছু বলবেন?
ডা. হেলাল: শিশু এবং কিশোর বয়সে যারা রয়েছেন তাদের ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের ভূমিকা অনেক বেশি। সন্তান আত্মহত্যার কথা বললেই তার বিষয়ে সতর্ক হতে হবে। তাকে এমন কিছু বলা যাবে না যাতে করে এতে আরও বেশি প্ররোচিত হয়। আত্মহত্যা প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং উপযুক্ত নীতি নির্ধারণসহ দক্ষ নেতৃত্ব দরকার, দরকার মাঠপর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, মানসিক, শারীরিক ও সামাজিক স্বাস্থ্যের উন্নতি সাধন।
একইসঙ্গে আত্মহত্যা উপকরণের সহজপ্রাপ্যতা হ্রাস করতে হবে রাষ্ট্রকে, ২৪ ঘণ্টা আত্মহত্যা বিষয়ক হটলাইন চালু করতে হবে, ক্রাইসিস ইন্টারভেনশন সেন্টার স্থাপন, বাল্যবিবাহ, যৌতুক ও পারিবারিক সংঘাত হ্রাস, নারীশিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়ন, মাদকাসক্তি প্রতিরোধ, মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ও মানসিক রোগের যথাযথ চিকিৎসা, স্কুল মেন্টাল হেলথ স্থাপন, আত্মহত্যাকে অপরাধ হিসেবে দেখা বন্ধ করে একে চিকিৎসার আওতায় আনতে হবে রাষ্ট্রকে।
এসব ক্ষেত্রে মিডিয়ার ভূমিকা নিয়েও অনেক সময় প্রশ্ন তোলা হয়। সেটা নিয়ে যদি বলতেন ।
ডা. হেলাল: মিডিয়াতো সমাজের আয়না। এখানে যা দেখানো হবে সেটা প্রতিফলিত হবে। তাই মিডিয়ার এ ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। আত্মহত্যার পর মৃতদেহের ছবি বা ভিডিও ফুটেজ কোনওভাবেই প্রকাশ করা উচিৎ নয়।একইসঙ্গে বিকল্পধারার ইন্টারনেটভিত্তিক প্রচারমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলোর ব্যবহারকারীদেরও সতর্কতার সঙ্গে আত্মহত্যার বিষয় নিয়ে মন্তব্য ও ছবি পোস্ট করতে হবে। কোনও আত্মহত্যার ঘটনাকে মহৎ করে দেখানোর চেষ্টা করা যাবে না। কিভাবে একজন আত্মহত্যা করেছেন বা করবার চেষ্টা করে কেন ব্যর্থ হয়েছেন সে বিষয়গুলোর বিস্তারিত বিবরণ যেনো আত্মহত্যার সংবাদে না থাকে।এ ধরনের বিবরণ ভবিষ্যতে আরও একজনকে একটি ‘সফল’ আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিতে পারে।বাংলা ট্রিবিউন