অবশেষে চলেই এসেছে মাহে রমজান মাস। তবে এই সময় রোজা রাখতে গিয়ে বেশিরভাগ সময়ই বেশ অসুবিধায় পড়ে যান ডায়াবেটিস রোগীরা। কারণ এই রোজার সময় তাদেরকে খাদ্যাভাস ও ওষুধের সময়সূচি পরিবর্তন করতে হয়। আর পরিবর্তনের কারণে তাদের শরীরের ক্যালরি, রক্তে শর্করার পরিমাণ এবং ওষুধের মধ্যে সামঞ্জস্যহীনতা দেখা দেয়।
এতে করে রক্তে শর্করার মাত্রা হঠাৎ বাড়তে পারে আবার কমে যেতে পারে। আর ঠিক এই কারণেই রমজান মাসে রোজা রাখার জন্য ডায়াবেটিস রোগীদের আগে থেকেই পূর্ব-প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ দরকার। আগে থেকেই কিছু কিছু নফল রোজা রেখে দেখতে পারেন যে রোজা রাখলে আপনার কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা।
রোজা রাখলে ডায়াবেটিস রোগীদের কী কী হতে পারে
১. হাইপোগ্লাইসিমিয়া (রক্তে সুগারের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কমে যাওয়া) ।
২. হাইপারগ্লাইসিমিয়া (রক্তে সুগারের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যাওয়া) ।
৩. কিটো আসিডোসিস বা হাইপার অসমোলার নন কিটোটিক ডায়াবেটিক কোমা (শরীরে কিটো অ্যাসিড বা অসমোলারিটি বেড়ে গিয়ে মারাত্নক অসুস্থ হয়ে পড়া বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়া)
এগুলো হলে দ্রুত প্রাথমিক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে এবং হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।
রমজানে ডায়াবেটিস রোগীদের করণীয়:
সর্বপ্রথম প্রস্তুতি হিসেবে ডায়াবেটিস রোগীদের জেনে নেওয়া উচিত তাদের শরীর রোজা রাখার জন্য উপযুক্ত কি না। শরীরে যদি শর্করার মাত্রা অনিয়ন্ত্রিত থাকে অথবা বিগত তিন মাসের মধ্যে যদি কোন হাইপার বা হাইপোগ্লাইসেমিয়ার বা কিটোঅ্যাসিডোসিসের ঘটনা ঘটে থাকে তাহলে রোজা রাখা উচিত নয়।
ডায়াবেটিস ছাড়াও অন্যান্য শারীরিক সমস্যা যেমন গুরুতর যকৃতের সমস্যা, হৃদরোগ ও কিডনি সমস্যায় আক্রান্ত হলেও রোজা না রাখাই ভালো। এই তালিকায় অবশ্য গর্ভবতী ডায়াবেটিস রোগী ও ডায়ালাইসিস নিচ্ছেন এমন রোগীরাও পড়বেন।
অন্যদের মধ্যে যারা কেবল খাদ্যাভ্যাস ও ব্যায়ামের মাধ্যমেই শর্করা নিয়ন্ত্রণ করছেন তাদের জন্য রোজা রাখা সাধারণত নিরাপদ।
যারা ইনসুলিন বা ওষুধ ব্যবহার করেন তাদের ক্ষেত্রে কিছুটা ঝুঁকি রয়েছে। এক্ষেত্রে তাদের অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে রোজা রাখতে হবে এবং নতুন করে ওষুধের মাত্রা ও সময় জেনে নিতে হবে।
ডায়াবেটিস রোগীর খাদ্যাভ্যাস:
রমজান মাসে ডায়াবেটিস রোগীদের ক্যালরির চাহিদা আগের মতোই থাকবে। এ সময় শুধুমাত্র খাবার গ্রহণ ও সময়ের কিছুটা পরিবর্তন হবে। ইফতারে বিকল্প চিনি দিয়ে ইসবগুলের ভুষি, তোকমা, লেবু, কাঁচা আম বা তেঁতুল শরবত এসব রোগীদের জন্য উপকারী।
ডাব ছাড়া অন্যান্য মিষ্টি ফলের রস না খাওয়াই ভালো। তবে টক ও মিষ্টি উভয় ধরনের ফলের সালাদ খাওয়া যেতে পারে। এতে খনিজ লবণ ও ভিটামিনের ঘাটতি পূরণ হবে। এছাড়া, কাঁচা ছোলার সঙ্গে আদাকুচি, টমেটো কুচি , পুদিনা পাতা ও লবণের মিশ্রণ খাওয়া যাবে। কাঁচা ছোলা রক্তের কোলেস্টেরল কমাতে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে।
সন্ধ্যা রাতে (ইফতার পরবর্তী) খাবার একেবারে বাদ দেওয়া উচিত নয়। অবশ্যই কম করে হলেও খেতে হবে। অন্য সময়ের রাতের খাবারের সমপরিমাণ হবে রমজানে ডায়াবেটিস রোগী সন্ধ্যা রাতের খাবার। রোগী ভাত খেতে পারবে তবে পুষ্টিবিদ কর্তৃক বরাদ্দ খাবারের পরিমাণের দিকে সবসময় সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। হালকা মসলায় রান্না, যে কোনো ছোট-বড় মাছ এবং সবজি নিয়মিত খাওয়া যেতে পারে।
সেহরিতে (ভোর রাতের খাবারে) রুটি অথবা ভাত নিজের রুচি অনুযায়ী গ্রহণ করুন। সেহরির খাবারের পরিমাণ হওয়া উচিত অন্যদিনের দুপুরের খাবারের সমপরিমাণ। সেহরিতে মাছ ও সবজি থাকতে পারে। দুধ অথবা ডাল যে কোনো একটা থাকলে ভালো হয়।
ইফতারে একসঙ্গে বেশি না খেয়ে অনেক খাবার ধাপে ধাপে ভাগ করে খান। এতে রক্তে হঠাৎ করে শর্করার মাত্রা বেড়ে যাবে না।
ওষুধ ও ইনসুলিন :
রমজান মাসে খাবারের সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হবে ওষুধ এবং ইনসুলিনের মাত্রা ও সময়সূচিরও । আর অবশ্যই ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে দিনের ওষুধগুলোর সময় পরিবর্তন করে সন্ধ্যায় বা রাতে তা গ্রহণ করতে হবে। কারণ ওষুধের মাত্রা রক্তে শর্করার পরিমাণের ওপর অনেকটাই নির্ভর করে। আর ঠিক এ কারণে নিজ থেকেই ওষুধের সময়সূচি পরিবর্তন করা যাবে না। অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
ব্যায়াম :
এটা সকলেই জানেন যে ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ব্যায়াম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর এদের মধ্যে যারা প্রতিদিন একটা নিয়ম করে ব্যায়াম ও হাঁটাহাঁটি করেন। এ মাসে অবশ্যই তাদের সে রুটিনেও পরিবর্তন আনতে হবে। রোজা রেখে ব্যায়াম ও খুব বেশি হাঁটাহাঁটি করা যাবে না। তবে ইফতারের একঘণ্টা পর ও সেহরির আগে হাল্কা ব্যায়াম করতে পারেন।
সর্তকতা :
. ডায়াবেটিসের সঙ্গে যাদের অন্য কোনো জটিলতা, যেমন- কিডনির রোগ, উচ্চমাত্রার ইউরিক থাকলে ডালের তৈরি খাবার থেকে বিরত থাকুন।
. আলসার বা গ্যাসট্রাইটিসের সমস্যা থাকলে ডুবো তেলে ভাজা ও ঝাল যুক্ত খাবার অবশ্যই পরিহার করুন।
. শরীরের ওজন বেশি থাকলে যতটা সম্ভব কম খাবার গ্রহণ করুন এবং খাবারে তেলের পরিমাণ কমিয়ে দিন।
. রোজা রেখে অত্যধিক হাঁটা বা ভারী ব্যায়াম থেকে বিরত থাকুন। কারণ এতে আপনার শরীরে রক্তের শর্করার মাত্রা নিচে নেমে গিয়ে বিপদ হতে পারে।
রমজানে অবশ্যই ডায়াবেটিস রোগীদের শরীরের প্রতি বিশেষ যত্নবান হওয়া উচিত। কারণ শরীর সুস্থ না থাকলে এসব রোগীর জন্য রোজা রাখা অনেক সময় নিরাপদ নাও হতে পারে। তাই শরীর সুস্থ রাখতে দৈনন্দিন খাবারের ব্যাপারে অবশ্যই সচেতন থাকতে হবে
https://www.youtube.com/watch?v=r0t64gzuqtg