class="post-template-default single single-post postid-2325 single-format-standard wp-custom-logo group-blog vl-boxed aa-prefix-matin-">
Shadow

তারা দরকার হলে এদেশে ভিক্ষা করে খাবেন কিন্তু সৌদি আরবে আর যাবেন না

সৌদি আরবদীর্ঘ অপেক্ষার পর সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরে ভয়াবহ শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের বর্ণনা দিলেন নারী শ্রমিকরা। বৃহস্পতিবার (১৩ সেপ্টেম্বর) রাত সোয়া আটটায় ইতিহাদ এয়ারওয়েজের ইওয়াই ২৫৮ ফ্লাইটে আবুধাবি থেকে ঢাকার শাহ্জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান তারা। এই  ফ্লাইটে দেশে ফিরেছেন  অন্তত ৭৮ জন নারী শ্রমিক। তবে প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক থেকে বলা হয়েছে ৪৬ জন নারী শ্রমিকের দেশে ফেরার কথা। তবে এই নারী শ্রমিকরা বলেছেন, ইতিহাদ এয়ারওয়েজের এই ফ্লাইটের প্রায় এক-তৃতীয়াংশই ছিল সৌদি ফেরত নারী শ্রমিকরা।

এয়ারপোর্টে কথা হয় সৌদি ফেরত নারী শ্রমিক শেফালি আক্তারের (পরিচয় না প্রকাশ করার শর্তে ছদ্মনাম ব্যবহার করা হলো) সঙ্গে। প্রায় একবছর আগে গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে পাড়ি দিয়েছিলেন সৌদি আরবে। প্রথম প্রথম ঘরের কাজ করানো হলেও পরবর্তীতে কফিলের (নিয়োগ কর্তার) আচরণে পরিবর্তন দেখতে পান শেফালি। তিনি অভিযোগ করেন— কফিল বাসার কাজের ফাঁকে তাকে ‘খারাপ’ কাজে বাধ্য করতো। রাজি না হলে শারীরিক নির্যাতন চালাতো। এরই মধ্যে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন তিনি। তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় কফিল তার গর্ভপাত করায় বলে দাবি করেন শেফালি। গৃহকর্তার নির্মম এই অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে একসময় সেই বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে পুলিশের কাছে ধরা দেন তিনি।

শেফালি আক্তার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কী যে খারাপ খারাপ কাজ করতো তারা।  রাজি না হইলেই ইচ্ছামতো মারতো। একবার অসুস্থ হইয়া পড়ায় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। সেখানে জানতে পারি, আমার প্যাটে তিন মাসের বাচ্চা। পরে কফিল ওষুধ খাওয়ায়ে বাচ্চা ফালায় দেয়। এরপর আবারও অত্যাচার করতো আমারে। এক মাস আগে আমি কফিলের বাড়ির থেইক্যা পালায়ে পুলিশের কাছে ধরা দেই। পুলিশ আমারে প্রায় সপ্তাহখানেক জেলে রাখে। এরপর সফর জেলে (ডিপোর্ট সেন্টারে) দিয়া দেয়। সেখান থেকে আজকে আমারে দেশে পাঠাইসে। আমারে যেই কোম্পানি পাঠায়সিল আমি তার বিরুদ্ধে মামলা করমু।’

৪০ বছর বয়সী বিধবা ফরিজা অনেক আশা নিয়ে সৌদি আরবে গিয়েছিলেন। একমাত্র মেয়েকে ভালোভাবে মানুষ করবেন— সেই আশা থেকেই তার সৌদি আরবে যাওয়া। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সৌদি আরব যান তিনি। কুমিল্লার সুমন নামের এক দালাল টাকার বিনিময়ে ট্রেনিং কার্ড (বিএমইটি কার্ড) করে দেন বলে অভিযোগ করেন ফরিজা। এক বাড়িতে কাজ করার কথা থাকলেও এই সময়ের মধ্যে দুই বাড়িতে কাজ করেছেন তিনি। প্রথম মালিকের বাড়িতে দুই মাসের বেতন পেলেও পরে আর কোনও বেতন দেওয়া হতো না। ফরিজা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার স্বামী নাই। একটা মেয়ে আছে। তার জন্য আমি গেছিলাম সৌদি আরব। দালাল আমারে টাকা দিয়া ট্রেইনিং কার্ড কইরা দিছে। আমার যাওয়া লাগে নাই। ১২০০ টাকা (সৌদি রিয়াল) বেতনের কথা কইছিল। সেখানে গিয়া প্রথম দুই মাস ৯০০ টাকা পাইছি। ওইখান থেকে পরে আমারে অন্য বাসায় পাঠায়। সেখানে কাজ করছি পাঁচ মাস। কিন্তু বেতন সব রাইখা দিছে। বেতনের কথা কইলে ম্যাডাম আমারে মারতো। আমি আরবি ভাষায় তাদের কাছে কইতাম— আমার বাড়িতে টাকা পাঠানোর কথা। কেউ শুনতো না, খালি মারতো।’

বৃহস্পতিবার রাতের একই ফ্লাইটে ফেরত আসা একাধিক নারী শ্রমিক জানিয়েছেন— তারা দরকার হলে এদেশে ভিক্ষা করে খাবেন। কিন্তু সৌদি আরবে আর যাবেন না। উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখা এই নারীদের বাস্তব অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ ভিন্ন বলে জানান তারা। তাই বাংলাদেশের মেয়েদের সৌদি আরবে না পাঠাতে গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে করজোড়ে অনুরোধ জানান। তারা আরও বলেন, সৌদি আরবে নিয়োগকর্তার বাসায় পরিষ্কার জায়গায় থাকতে দেওয়ার কথা থাকলেও তাদের অনেককেই থাকতে হতো রান্নাঘরে। খাবার হিসেবে তারা পেতেন রুটি আর পানি। শারীরিক নির্যাতন, বাসস্থান  ও খাবারের সমস্যা, বেতন না পাওয়াসহ বিভিন্ন সমস্যার কারণে দেশে ফিরে আসতে  বাধ্য হচ্ছেন তারা। কেউ দুই বছর, কেউ একবছর, কেউ তিন-চার মাস, আবার কেউবা একমাসের মাথায় ফেরত চলে আসছেন সেদেশ থেকে।

এছাড়া, সেদেশের মক্তবে (নিয়োগকর্তার রিক্রুটিং এজেন্সির অফিস) নিয়েও নারী শ্রমিকদের ইচ্ছামতো শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ করেন তারা। এর মধ্যে আব্দুল্লাহর মক্তবে সবচেয়ে বেশি শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে বলে জানিয়েছেন ফিরে আসা নারী শ্রমিকরা। তারা এও বলেছেন, সেখানে আরও  ৫০-৬০ জন বাংলাদেশি নারী শ্রমিক বর্তমানে অবস্থান করছেন। তাদের ওপর বর্বর শারীরিক নির্যাতন চালানো হচ্ছে। বৃহস্পতিবার রাতে ফিরে আসা নারী শ্রমিক সুনামগঞ্জের রুজিনাকে দেখা গেছে মানসিক ভারসম্য হারিয়ে এয়ারপোর্টে উদ্ভট আচরণ করতে। তার সফর সঙ্গীরা জানান, রিয়াদে থাকাকালীন তার এই অবস্থা হয়েছে। কিছু সময় ঠিক থাকে, ফের কিছু সময় শুরু হয় তার পাগলামী।

রুজিনার মানসিক অবস্থা দেখে তাকে রাতে আশকোনায় ব্র্যাকের সেফহোমে নিয়ে যান  সংস্থার তথ্য কর্মকর্তা আল আমিন নয়ন। শুক্রবার (১৪ সেপ্টেম্বর) তিনি বিকালে জানান, রুজিনাকে তার বাড়ির উদ্দেশে পাঠানো হয়েছে সকালে। তখন তিনি কিছুটা সুস্থ ছিলেন।

দেশে ফিরে আসা এই অসহায় নারী শ্রমিকদের বিশেষভাবে সাপোর্ট দিচ্ছে ব্র্যাকের ইমারজেন্সি সাপোর্ট প্রোগ্রাম ফর ভালনারেবল রিটার্নি। ফিরে আসা শ্রমিকদের প্রথমেই খাবার দিয়ে সহায়তা করা হয় এই প্রোগ্রামের আওতায়। এছাড়া, চিকিৎসা,থাকার জায়গা এবং মানসিকভাবে বিপর্যস্তদের কাউন্সিলিংসহ নানাভাবে তাদের সহায়তা করা হয়ে থাকে। ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, ‘প্রথমত আমরা খাবার দেই, এরপর যাদের চিকিৎসার প্রয়োজন হয়, তাও ব্যবস্থা করে থাকি। অন্য কোনও হাসপাতালে চিকিৎসার প্রয়োজন হলে আমরা সেই ব্যবস্থাও  করি। এর মধ্যে আমরা অনেককেই পাই, যারা এই মুহূর্তে বাড়িতে যেতে চান না, কিংবা পরিবার তাকে নিতে চায় না। আবার অনেকে দেশে ফিরে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগও করতে পারেন না। তাদেরকে আমাদের সেন্টারে নিয়ে যাই। কারও যদি চিকিৎসা দরকার হয়, কিংবা মানসিকভাবে বিপর্যস্তদের যদি কাউন্সিলিংয়ের প্রয়োজন হয়, আমরা সেই সাপোর্টটা দিয়ে থাকি।’

দেশে ফিরে যারা যৌন নির্যাতনের অভিযোগ করেন, তারা কীভাবে আইনি সহায়তা পেতে পারেন— এই প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে শরিফুল হাসান বলেন, ‘ঘটনাস্থলে যদি মামলা না হয়, তাহলে তো সেদেশের পুলিশ তদন্ত করতে পারে না। যেহেতু এরকম ঘটনার স্থল সৌদি আরব, সেক্ষেত্রে কী করতে পারে বাংলাদেশ। এখানে যেটা করা যায়— যদি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে কেউ প্রতারণার শিকার হন, তাহলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যায়। সে ধরনের ক্ষেত্রে ঘটনার শিকার নারী যদি মামলা করতে চান, তাহলে আমরা আইনি সহায়তা দিয়ে থাকি।’

এদিকে, সৌদি আরব থেকে ফেরত আসা সাবিনা চার মাস আগে সেদেশে গিয়েছিলেন।সৌদি আরবে কাজে যাওয়ার জন্য  দালালকে  ৪০ হাজার টাকাও দিয়েছিলেন। কথা ছিল কাজ হবে ফলের ফ্যাক্টরিতে। কিন্তু  সেখানে গিয়ে তিনি জানতে পারেন, তাকে বাসাবাড়ির কাজের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সাবিনা অভিযোগ করে বলেন, ‘কাজ করতে না চাওয়ায় আমাকে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। এমনকি ভাঙা গ্লাস দিয়ে পা কেটে দেওয়া হয়েছে।’

তিন মাস আগে সৌদি আরবে গিয়ে দুই মাস ‘সফর’ জেলে কাটিয়ে দেশে ফিরেছেন জাহানুর। তিনি এর আগে মিশরে কাজ করেছেন। কিন্তু সেদেশের অভিজ্ঞতা আর সৌদি আরবের অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ ভিন্ন বলে জানান তিনি। মালিকের কথা না শোনায় তাকে মক্তবে (অফিসে) দিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে চালানো হয় পাশবিক নির্যাতন। সেখানে জাহানুরকে বলা হতো— বাংলাদেশ থেকে তাকে কিনে নেওয়া হয়েছে। তিনি অভিযোগ করে আরও বলেন, ‘মক্তবে মেয়েদের বুকে হাত দিয়ে মারা হয়। সেখানে বাংলাদেশি যারা আছেন, তারা পরামর্শ দিতেন— এদেশে আর আইসেন না!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!