Monday, December 23
Shadow

টিউশন ফির চাপে দিশেহারা অভিভাবকরা

করোনাভাইরাসের কারণে সারাদেশে বন্ধ থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো টিউশন ফি আদায়ে অভিভাবকদের ওপর চাপ প্রয়োগ করছে। এ নিয়ে দ্বন্দ্ব-ফ্যাসাদে জড়িয়ে পড়ছেন অভিভাবক ও প্রতিষ্ঠানপ্রধানরা। এ বছর বার্ষিক পরীক্ষা না হওয়ার কারণে মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে এখন শিক্ষার্থীরা অ্যাসাইনমেন্ট তৈরি করছে। বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এই অ্যাসাইনমেন্টকে ইস্যু করে শিক্ষার্থীদের জিম্মি করতে চাইছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। এছাড়া করোনা মহামারির মধ্যেও অনেক প্রতিষ্ঠান ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত আগাম টিউশন ফি আদায় করছে। সংশ্নিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, টিউশন ফি নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অভিভাবক- দুই পক্ষকেই সহনশীল হতে হবে। তিনি প্রশ্ন রাখেন, অভিভাবকরা ফি না দিলে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা কীভাবে হবে। তবে একথাও সত্য যে করোনার কারণে বহু অভিভাবকের আয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে মানবিক হতে হবে। এ বিষয়ে শিগগিরই একটি নির্দেশনা দেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
বৈশ্বিক এই মহামারিকালে কর্মহীন হয়ে পড়েছে সারাদেশের নিম্ন আয়ের অসংখ্য মানুষ। চাকরি হারিয়েছেন মধ্যবিত্তের অনেকে। গত ১৮ মার্চ থেকে সারাদেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। এ সংকটকালে বেতন-ফি আদায়ে চাপ প্রয়োগ না করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা থাকলেও তা মানছে না অনেক প্রতিষ্ঠান। টিউশন ফিসহ অন্যান্য ফি জমা দিতে প্রতিনিয়তই অভিভাবকদের মোবাইলে এসএমএস পাঠানো হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান ফোন করে তা পরিশোধের জন্য চাপও দিচ্ছে বলে অভিযোগ আছে। বকেয়া রাখলে পরবর্তী সময়ে জরিমানাও গুনতে হবে বলে সতর্ক করা হচ্ছে।

জানা গেছে, রাজধানীর সাউথপয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজ সবচেয়ে বেশি চাপ প্রয়োগ করছে অভিভাবকদের ওপর। তারা এসএমএস পাঠিয়ে টিউশন ফিসহ অন্যান্য ফি পরিশোধের তাগাদা দিচ্ছে। কেবল সাউথপয়েন্ট নয়, রাজধানীর প্রায় সব বেসরকারি বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যম স্কুল নিয়ে একই অভিযোগ করছেন অভিভাবকরা। কখনও কখনও ‘হুমকি’ও দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তারা। রাজধানীর অন্যতম নামিদামি প্রতিষ্ঠানের একটি মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ। এই প্রতিষ্ঠানটি বেতন রকেট, নেক্সাস পেসহ ইত্যাদি মাধ্যমে আদায় করছে। গত ২৪ ও ২৫ অক্টোবর রাজধানীর রূপনগরে সড়ক অবরোধ করে শিক্ষার্থীদের বকেয়া বেতন মওকুফের দাবিতে আন্দোলনে নামেন মনিপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের অভিভাবকরা। নাজমুন নাহার নেলী নামের এক অভিভাবিকা জানান, করোনায় অনেক অভিভাবক আর্থিক সংকটে রয়েছে। অনেকে সন্তানের টিউশন-পরীক্ষার ফি পরিশোধ করতে পারছেন না। অথচ মনিপুর স্কুল কর্তৃপক্ষ নানা অজুহাতে বকেয়া পরিশোধের জন্য প্রতিনিয়ত চাপ সৃষ্টি করছিল। বকেয়া পরিশোধ করতে না পারলে শিক্ষার্থীদের পরবর্তী ক্লাসে তোলা হবে না বলেও হুমকি দেওয়া হচ্ছিল। অভিভাবকরা রাস্তায় নামার পর স্কুল কর্তৃপক্ষ চাপ প্রয়োগ বন্ধ করেছে।

ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান মু. জিয়াউল হক বলেন, আমরা বার বার বলছি টিউশন ফি আদায়ে কোনো প্রকারের জোরজবরদস্তি করা যাবে না। চাপ প্রয়োগ করা যাবে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কোনো ব্যবসার জায়গা নয়, এটা মে রেখে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে হবে।

জানা গেছে, মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে মূল শাখা এবং রূপনগর, ইব্রাহীমপুর ও শেওড়াপাড়ায় আরও তিনটি শাখায় প্রায় ৩০ হাজার ছাত্রছাত্রী রয়েছে। প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ১৫৫০ টাকা করে বেতন আদায় করা হচ্ছে। নবম-দশম শ্রেণির (বিজ্ঞান) বেতন ১৭০০ টাকা। প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি ইংরেজি ভার্সনের বেতন তিন হাজার টাকা করে নেওয়া হচ্ছে। এ বিদ্যালয়ে গত ২৮ অক্টোবর দ্বিতীয় অনলাইন পরীক্ষার আয়োজন করে ২০০ টাকা করে ফি নেওয়া হয়। ফি না দিলে পরীক্ষায় অংশ নিতে দেওয়া হবে না, অনলাইন লিংক দেওয়া হবে না- এমন হুমকি দেওয়া হলে অভিভাবকরা আন্দোলনে নামেন। তাদের আন্দোলনের মুখে ওই পরীক্ষা বাতিল করা হয়। পরে স্থানীয় সাংসদ ও শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার বিদ্যালয়ে গিয়ে অভিভাবকদের নিয়ে সভা করে ফি আদায়ে চাপ প্রয়োগ না করতে স্কুল কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। অভিভাবকরা এ সময় ৫০ শতাংশ ফি মওকুফ করার দাবি করেন। প্রতিমন্ত্রী করোনায় আর্থিক ক্ষতিগ্রস্তদের আবেদন করার পরামর্শ দেন। জানা গেছে, স্কুল কর্তৃপক্ষের নির্দিষ্ট ফরমে বিপুল সংখ্যক অভিভাবক ফি আংশিক অথবা সম্পূর্ণ মওকুফ করার আবেদন করেছেন। গত ৫ নভেম্বর আবেদন করার সময় শেষ হয়। কতগুলো আবেদন জমা পড়েছে জানতে চাইলে মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ ফরহাদ হোসেন সমকালকে বলেন, আমরা এখনও গুনে দেখিনি।

রাজধানীর অপর খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের বনশ্রী, মুগদা ও মতিঝিল মিলিয়ে তিনটি পৃথক ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ২৮ হাজার। এ প্রতিষ্ঠানে অগ্রিম বেতন আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। বর্তমানেও ডিসেম্বর পর্যন্ত বেতন পরিশোধের জন্য শিক্ষকদের মাধ্যমে অভিভাবকদের তাগাদা দেওয়া হচ্ছে। প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ১৩৫০ টাকা, ইংরেজি ভার্সনে ১৫৫০ টাকা ও কলেজ শাখায় ২১০০ টাকা করে টিউশন ফি আদায় করা হচ্ছে বলে অভিভাবকরা জানিয়েছেন।

ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বেইলি রোডের মূল ক্যাম্পাসসহ ধানমন্ডি, আজিমপুর ও বসুন্ধরায় আরও তিনটি ক্যাম্পাস রয়েছে। মোট ছাত্রী সংখ্যা প্রায় ২৭ হাজার। এ প্রতিষ্ঠানে প্রথম থেকে দশম শ্রেণির জন্য ১৪০০ টাকা, ইংরেজি ভার্সনের জন্য ১৬০০ টাকা এবং একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির টিউশন ফি হিসেবে ২১০০ টাকা করে অভিভাবকদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে। সংশ্নিষ্টরা জানান, রাজধানীর অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তুলনায় ভিকারুননিসার অভিভাবকদের আর্থিক অবস্থা ততটা খারাপ না। অধ্যক্ষ ফৌজিয়া রিজওয়ান সমকালকে জানান, এরপরও তারা অভিভাবকদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে অন্তত দুই হাজার ছাত্রীর টিউশন ফি আংশিক অথবা পুরোপুরি মওকুফ করেছেন।

অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু সমকালকে বলেন, তারা ছেলেবেলা থেকেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হাফ ফ্রি, ফুল ফ্রি শব্দগুলো শুনে আসছেন। অথচ বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখন তা মানতে চায় না। করোনার এই মুহূর্তে সরকারের কাছে আমাদের দাবি, অন্তত ছয় মাসের টিউশন ফি পুরোপুরি মওকুফ করে দেওয়া হোক।
অ্যাসাইনমেন্ট বাবদ ফি নেওয়া যাবে না :ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের শিখনফল মূল্যায়নে অ্যাসাইনমেন্ট গ্রহণের জন্য কোনো ফি আদায় করা যাবে না বলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক বলেন, শিক্ষার্থীদের শিখনফল মূল্যায়ন করতে যে অ্যাসাইমেন্ট নেওয়া হচ্ছে, সেজন্য তাদের কাছ থেকে কোনো ফি নেওয়া যাবে না।

করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে এবার বার্ষিক পরীক্ষা না নিয়েই মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের ওপরের শ্রেণিতে তোলা হবে। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ঘাটতি পূরণের জন্য ৩০ কর্মদিবসে শেষ করা যায় এমন একটি সিলেবাস প্রণয়ন করেছে এনসিটিবি। সেই সিলেবাসের আলোকে শিক্ষার্থীদের প্রতি সপ্তাহে তিনটি করে অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হচ্ছে; যার উত্তর শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তক অনুসরণ করে লিখতে বলা হয়েছে।

এই অ্যাসাইনমেন্ট মূল্যায়ন করে শিক্ষার্থীদের ঘাটতিগুলো চিহ্নিত করে পরবর্তী ক্লাসে তা পূরণের চেষ্টা করা হবে বলে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি আগেই জানিয়েছেন।
নির্দেশনা আসছে, মওকুফ হচ্ছে অতিরিক্ত ফি :শিক্ষার্থীদের মাসিক টিউশন ফি নিয়ে অভিভাবকদের সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দ্বন্দ্ব ও দূরত্ব ঘোচাতে চলতি সপ্তাহেই সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা জারি করতে যাচ্ছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। এতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি সুস্পষ্টভাবে দুটি নির্দেশনা থাকবে বলে জানা গেছে। প্রথমত, কোনো অতিরিক্ত ফি আদায় করা যাবে না। দ্বিতীয়ত, অসচ্ছল, দরিদ্র ও করোনার কারণে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত- এমন অভিভাবকদের ফি মওকুফ অথবা আংশিকভাবে ছাড় দিতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে টিউশন ফির বিষয়ে চলতি সপ্তাহেই এ নির্দেশনা জারি করা হচ্ছে বলে মাউশি থেকে জানা গেছে।

মাউশি সূত্র জানায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলে টিউশন ফি আদায়ের একটি গাইডলাইন তৈরি করা হচ্ছে। এতে শিক্ষার্থীদের মাসিক বেতনের সঙ্গে বার্ষিক মিলাদ মাহফিল ফি, বিদ্যুৎ, পানির বিল, ল্যাব ফি, খেলাধুলা ফি, বার্ষিক ক্রীড়া, বার্ষিক শিক্ষা সফরসহ বিভিন্ন ধরনের ফি বাতিল করা হবে। করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এসব টাকা আদায়ের কোনো প্রয়োজন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নেই। নির্দেশনায় শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনের স্বার্থে, শুধু টিউশন ফি আদায় করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে বলা হবে। এজন্য ঢাকাসহ দেশের জেলা শহরগুলোর শীর্ষ পর্যায়ের স্কুল-কলেজ থেকে এরই মধ্যে তথ্যও সংগ্রহ করা হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভেদে নানা ধরনের অতিরিক্ত ফি চিহ্নিত করে তা বাতিলের জন্যও এ নির্দেশনা জারি করা হবে। মাউশির মহাপরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ গোলাম ফারুক সমকালকে বলেন, আগামী দুই-তিন দিনের মধ্যে টিউশন ফি-সংক্রান্ত নির্দেশনা জারি করা হবে। তার ভিত্তিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তৃপক্ষ বেতন-ভাতা আদায় করবে।

তিনি বলেন, আমরা দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছি। কোন প্রতিষ্ঠানে কত টাকা আদায় করা হয় তা চিহ্নিত করা হয়েছে। তার আলোকে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক টিউশন ফির সঙ্গে অতিরিক্ত ফি সব বাদ দিয়ে আদায় করতে বলা হবে। যে সব প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত টিউশন ফি আদায় করেছে সেসব প্রতিষ্ঠানের জন্য কী ধরনের নির্দেশনা থাকবে? জানতে চাইলে মহাপরিচালক বলেন, নির্দেশনা জারির আগে যে সব প্রতিষ্ঠান অর্থ আদায় করবে, তারা পরবর্তী মাসের টিউশন ফির সঙ্গে অর্থ সমন্বয় করতে বলা হবে। শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনভাতা ও প্রতিষ্ঠান চালাতে অর্থের প্রয়োজন রয়েছে। তাই অভিভাবকদের যারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হননি, তারা সম্পূর্ণ টিউশন ফি পরিশোধ করবেন বলে মহাপরিচালক আশা প্রকাশ করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!