শিশুদের গল্প : মেঘে ঢাকা চাঁদ । লিখেছেন : জসীম আল ফাহিম
দূর আকাশে ঝলমল করছিল পূর্ণিমা চাঁদ। আপনমনে আলো বিলাচ্ছিল উজ্জ্বল চাঁদ। চাঁদের হিমেল শান্ত আলোয় আলোকময় পৃথিবী। চাঁদের আলোয় রাতের আকাশ যেন উপছে পড়ছিল! সে সময় আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছিল অনেক সাদা মেঘ। মেঘগুলো ভেসে ভেসে একসময় জড়ো হলো। জড়ো হওয়া সাদা মেঘ ভাসতে ভাসতে কালো হয়ে গেল। ঘন কালো মেঘ একসময পূর্ণিমা চাঁদকে এসে ঢেকে দিলো। দেখে মনে হলো যেন চাঁদের মুখে মেঘের কালো নেকাব!
পরে চাঁদকে উদ্দেশ্য করে গর্ব ভরে মেঘ বললো, দেখলে তো কেমন তোমাকে ঢেকে দিলাম। মেঘের আড়াল থেকে তুমি কোনোদিন আর বেরোতে পারবে না। কোনোদিন আর আলো বিলাতে পারবে না। মেঘের আড়ালে থেকে থেকে একদিন তুমি এমনিতেই শেষ হয়ে যাবে।
মেঘের এরূপ কথা শুনে পূর্ণিমা চাঁদ কিছুটা ভাবনায় পড়ে গেল। পরে বললো, আমার তো শেষ হয়ে যাওয়ার কথা নয়। ফুরিয়ে যাওয়ার জন্যও আমি আসিনি। পনেরো দিন ধরে একটু একটু করে বেড়ে বেড়ে আমি বর্তমান অবস্থায় পৌঁছেছি। যেভাবে বেড়েছি ঠিক সেভাবেই আমি আগামি পনেরো দিনে ছোট হয়ে হয়ে একসময় লুকিয়ে যাবো। তারপর আবারও আমি নতুনরূপে নতুন উদ্যমে জন্ম লাভ করবো। সৃষ্টির আদি থেকে আজ অবধি আমার জীবনে এমনটিই ঘটেছে। কখনও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। সৃষ্টির আদিতে যেমন আমি ছিলাম, বর্তমানে আছি; তেমনি ভবিষ্যতেও থাকবো।
চাঁদের কথামালা শুনে মেঘ বললো, এর আগে নিশ্চয়ই এভাবে তুমি মেঘে ঢাকা পড়োনি?
চাঁদ বললো, অনেকবার পড়েছি। অসংখ্যবার পড়েছি। বার বার পড়েছি। বার বার আমাকে কোনো না কোনো মেঘ এসে এভাবে তোমার মতোই ঢেকে রাখার চেষ্টা করেছে বটে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেউ আর সফল হয়নি। কারণ আমি তো স্রষ্টার আশীর্বাদপুষ্ট। আমাকে ঢেকে রাখার সাধ্য কার?
শিশুদের গল্প : মেঘে ঢাকা চাঁদ
মেঘ তবু বললো, সে যাই বলো না কেন তুমি এ যাত্রা কিন্তু ঠিকই ঢাকা পড়েছো। এভাবে চিরকাল তুমি ঢাকা পড়েই থাকবে। মেঘের আড়াল থেকে কোনোদিন তুমি বের হতে পারবে না। আমি তোমাকে কিছুতে বের হতে দেবো না।
মেঘের কথা শুনে চাঁদ মিটিমিটি হাসলো। হেসে হেসেই বললো, যতো পারো তুমি চেষ্টা করে যাও। দেখা যাক কার ভাগ্যে কী লেখা রয়েছে। শেষ পর্যন্ত কার কী হয়।
চাঁদের অদূরেই ছিল সূর্য, বাতাস এবং পৃথিবী। চাঁদ এবং মেঘের কথাবার্তা তারা সবই শুনলো। শুনে প্রথমে সূর্যই মুখ খুললো। চাঁদকে অভয় দিয়ে সূর্য বললো, ভয় পেয়ো না চাঁদ। ভয় পেয়ো না। আমরা সব সময় তোমার সাথে ছিলাম, এখনও আছি; ভবিষ্যতেও থাকবো। তোমার প্রতি স্রষ্টার আশীর্বাদ রয়েছে। ভয় কী তোমার? আমি চিরকাল তোমাকে আলো দিয়ে যাবো।
সূর্যের পর বাতাস বললো, ভয় নেই তোমার; কোনো ভয় নেই। মেঘ তোমাকে চিরকাল ঢেকে রাখতে পারবে না। এভাবে তোমাকে ওর ঢেকে রাখাটা ভারি অন্যায়। এটাকে সাময়িক পরিস্থিতি মনে করে সয়ে যাও। সে তোমাকে কতক্ষণ আর ঢেকে রাখতে পারবে? কিছু সময় পর দেখো না তার নিজের কী অবস্থা হয়। নিজের সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই। অথচ অন্যের ব্যাপারে নাক গলাতে আসে। বেকুব মেঘ কোথাকার!
সূর্য এবং বাতাসের পর পৃথিবী তার মুখ খুললো। পৃথিবী বললো, মেঘ তোমাকে কতক্ষণ আর ঢেকে রাখবে শুনি? কালো মেঘেরা চিরকাল এমনি হয়। তারা অন্যের ভালো দেখতে পারে না। অন্যের প্রশংসার কথা শুনলে হিংসায় জ্বলেপুড়ে মরে। এটা তাদের চরিত্র। তাদের স্বভাব। অথচ নিজের সম্পর্কে তারা সঠিক কোনো ধারণাই রাখে না। তাই বলছি একটু ধৈর্য ধরো ভাই। এই তো কালো মেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়লো বলে …। বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ামাত্র আমি ওকে এমন শিক্ষা দিবো না, একেবারে শুষে নিবো।
শিশুদের গল্প : মেঘে ঢাকা চাঁদ
পৃথিবী বাতাস এবং সূর্যের মুখে সুন্দর আশার কথাগুলো শুনে চাঁদ অনেকটাই আশ্বস্ত হলো। মুখে একটু হাসি ছড়িয়ে চাঁদ বললো, তোমরা আছো বলেই তো আমি আছি ভাই। আমি জানি সব সময় তোমাদের আমি পাশে পাবো। তোমাদের অনেক ধন্যবাদ।
এদিকে কালো মেঘ বাতাসে ভাসতে ভাসতে কখন যে ভারি হয়ে গেল বুঝতেই পারলো না। এ অবস্থায় কালো মেঘকে কাঁধে নিয়ে বয়ে বেড়ানো বাতাসের দায় পড়েছে নাকি? বাতাস মেঘের ভার না নিয়ে ধীরে ধীরে সরে পড়লো। বাতাস সরে গেলে কালো মেঘ আর আকাশে ভেসে থাকে কী করে? শেষে কালো মেঘ নিজের ভার সামলাতে না পেরে ভেঙ্গে একেবারে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। পরে টুকরো মেঘগুলোই ছুড়ে ফেলা বস্তুর মতো আকাশ থেকে নিচে নামতে লাগলো। অতি দর্পের জন্য কালো মেঘের অধপতন হলো। অধপতিত মেঘের টুকরোগুলো শেষে মেঘের কান্না হয়ে বৃষ্টিরূপে পৃথিবীতে এসে ঝরে পড়লো।
আর হা করে থাকা তৃষ্ণার্ত পৃথিবী ঝরে পড়া বৃষ্টি পান করে তার তৃষ্ণা মিটালো। বৃষ্টি ঝরা শেষ হলে বৃষ্টিভেজা হিম বাতাস মনের আনন্দে শির শির করে বইতে শুরু করলো। আকাশে তখন লক্ষ-কোটি তারকার মাঝে পূর্ণিমা চাঁদ আবারও ঝলমল করে ওঠল।