Monday, December 23
Shadow

আমাদের আয়রন ম্যান সানজাদুল ইসলাম সাফা

আয়রন ম্যানপাঁচবার বাংলা চ্যানেল পাড়ি দিয়েছেন। দৌড়েছেন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া। সম্প্রতি আয়রন ম্যান ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিয়ে সফল হয়েছেন। তিনি মোহাম্মদ শামসুজ্জামান আরাফাত। তাঁর সঙ্গে দেখা করে এসেছেন সানজাদুল ইসলাম সাফা

২০১০ সাল। আরাফাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।  খাগড়াছড়ি গিয়ে প্রথম পাহাড়ে চড়েন। ফিরে এসে খবর পেলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এভারেস্ট মিশনে দল পাঠাচ্ছে। আরাফাত প্রশিক্ষণ শিবিরে নাম লেখালেন। দুই মাস প্রশিক্ষণ নেয় ১৫০ জন। শেষে মিশনের জন্য নির্বাচিত হলো সাতজন। ওই সাতজনের মধ্যে আরাফাত নিজের নামও দেখলেন। কিন্তু তাঁর তখন পাসপোর্ট ছিল না। আরাফাত দেশে থেকেই অনুশীলন চালিয়ে গেলেন। প্রতিদিন ৫ থেকে ১০ কিলোমিটার দৌড়াতেন।

 

ফুল ম্যারাথনে মেঘালয়ে

২০১৩ সালে কক্সবাজারে হাফ ম্যারাথনে অংশ নিয়েছেন। ২০১৫ সালে প্রথমবারের মতো পাড়ি দেন বাংলা চ্যানেল। তারপর ২০১৬ সালে ভারতের মেঘালয়ে ফুল ম্যারাথনে অংশ নেন। পাহাড়ি রাস্তায় বৃষ্টির মধ্যে ৪২ কিলোমিটার দৌড়াতে ৪ ঘণ্টা ৪১ মিনিট সময় নেন। এর পর ২০১৭ সালের টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া দৌড়ানোর উদ্যোগ নেন।

 

টেকনাফ টু তেঁতুলিয়া

টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া প্রায় এক হাজার কিলোমিটার পথ। প্রতিদিন ৫০ কিলোমিটার করে ২০ দিনে পাড়ি দেওয়ার পরিকল্পনা নিলেন। দৌড় শুরু করেন ২০১৭ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারি। মাঝখানে যমুনা নদী পাড়ি দিয়েছেন সাঁতরে। পরিকল্পনা মতোই  ৬ মার্চ শেষ হয় মিশন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া।

 

আয়রন ম্যান মালয়েশিয়া

২০১৭ সালে আয়রন ম্যান হতে মালয়েশিয়া যান। দেশে আয়রন ম্যান কেউ না থাকায় অভিজ্ঞতা জানার সুযোগ ছিল না। সাইক্লিস্ট আবদুল্লাহ তাহিদ চৌধুরী সাইকেল দিয়ে সহযোগিতা করলেন। কিন্তু বিমানে পরিবহনের সময় সাইকেলটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে মালয়েশিয়ার এক বন্ধুর সাইকেল নিয়ে রেসে অংশ নেন। আয়রনম্যান মালয়েশিয়া শেষ করেন ১২ ঘণ্টা ৪৩ মিনিটে। এর মধ্যে ৩.৮ কিলোমিটার ছিল সাঁতার, সাইকেল চালাতে হয়েছে ১৮০ কিলোমিটার আর দৌড়াতে হয়েছে ৪২ কিলোমিটার। মালয়েশিয়া আয়রন ম্যান সফলভাবে সম্পন্ন করতে পারায় তাঁর আত্মবিশ্বাস চলে আসে।

 

ইউরোপীয় আয়রন ম্যান চ্যাম্পিয়নশিপ

সাধারণ মানের ভালো একটি রেসিং সাইকেলের দাম সাড়ে ছয় লাখ টাকা। এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংককে সাইকেলের স্পন্সর হওয়ার আবেদন করেন। এ বছর ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখে সাইকেল পেলেন। ইউরোপিয়ান আয়রন ম্যান চ্যাম্পিয়নশিপের জন্য রেজিস্ট্রেশন করেছিলেন এর মধ্যেই। চার মাস অনুশীলন শেষে তাতে অংশ নেন জুনের ৩০ তারিখে। এখানে তিনি ১২ ঘণ্টা ১৪ মিনিট সময় নিয়ে সবই সম্পন্ন করেন। এখানে সাঁতরেছেন ৩.৮ কিলোমিটার, সাইকেল চালিয়েছেন ১৮৫ কিলোমিটার, দৌড়েছেন ৪২.২ কিলোমিটার। ফ্রাংকফুর্টে অনুষ্ঠিত এ প্রতিযোগিতায় ৮১টি দেশের তিন হাজার ৩৬০ জন নাম লিখিয়েছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত অংশ নেন দুই হাজার ৭৪৮ জন। নির্ধারিত ১৫ ঘণ্টার মধ্যে সব রেস শেষ করতে পারেন দুই হাজার ৬৮ জন। আরাফাত বয়সভিত্তিক ক্যাটাগরিতে ৬০তম হন। দুই হাজার ৭৪৮ জনের মধ্যে ৮২১তম হন। অংশগ্রহণকারী ৯৬ জন এশীয়র মধ্যে পঞ্চম হন।

 

ভবিষ্যতে আয়রনম্যান ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ

আয়রনম্যান প্রতিযোগিতার কথা কিভাবে শুনলেন?

২০১৩ সালের কথা। পার্থ আমার সঙ্গী দৌড়বিদ। কক্সবাজারে হাফ ম্যারাথনের সময় বলেছিল সে আয়রনম্যান হতে চায়। তারপর ইউটিউবে খোঁজখবর নেই। জানলাম এখানে সাইক্লিং একটা বড় অংশ। কিন্তু আমি কখনো সাইক্লিং করিনি। তখন সাইকেলও ছিল না আমার। নিজে একটা সাইকেল কিনি। কিন্তু রেসে অংশ নেওয়ার উপযোগী সাইকেল ছিল না সেটা।

 

আপনি আয়রন ম্যান জানলে মানুষের প্রতিক্রিয়া কেমন?

সাভারে একটা প্রগ্রামে গিয়েছিলাম। অনেক বাচ্চা ছিল। ওরা আয়রনম্যান দেখবে বলে খুবই উৎসাহী ছিল। কিন্তু  দেখার পর একটু হতাশই হয়েছে। ওদের কল্পনার আয়রনম্যানের সঙ্গে আমার মিল খুঁজে পায়নি।

 

আয়রনম্যান প্রতিযোগিতার ইতিহাস কী

১৯৭৭ সালে এ প্রতিযোগিতা শুরু হয়। ইউএস নেভির মধ্যে আলোচনা হচ্ছিল সাঁতারু, সাইক্লিস্ট আর রানারের মধ্যে কে বেশি স্ট্রংগার। তারপর একটা রেসের প্রচলন হয়। তিনটিতেই যারা সফল হবে তারা আয়রনম্যান।

 

টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া লং রানে ছুটি ও স্পন্সর কিভাবে পেয়েছিলেন?

২০১৬ সালের জানুয়ারিতে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকে যোগ দিই। কর্তৃপক্ষকে জানালাম ২৩ দিনের ছুটি লাগবে। এত লম্বা সময়—তাই তারা চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল। ব্যাংকের এমডি দেওয়ান মজিবুর রহমান স্যার অবশ্য অন্যরকম মানুষ। তিনি খুব আগ্রহ দেখালেন আর সহযোগিতাও দিলেন। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ছুটি তো দিয়েছিলই আর আর্থিক সহযোগিতাও দিয়েছিল। এত সাপোর্টের কথা ভাবিওনি।

 

তখন কেমন সাড়া পেয়েছিলেন?

পথে ছোট ছোট দূরত্বে আরো কয়েকজন অংশ নিয়েছিলেন। এনআরবি ব্যাংকের চট্টগ্রাম, ফেনী, কুমিল্লা ইত্যাদি শাখায় অল্প সময়ের জন্য চা পানের বিরতি নিতাম। শেষ দিকে তখন আমি তেঁতুলিয়া ডাকবাংলোয়। মাইকে শুনলাম প্রশাসন সংবর্ধনা সভার আয়োজন করছে। শেষ দিনে দৌড়েছিলাম ৩৫ কিলোমিটার। শেষ ৩ কিলোমিটার অনেক লোক আমার সঙ্গে দৌড়েছিল। একসঙ্গে অনেকে ফিনিশিং লাইনে পৌঁছাই। স্কুল-কলেজের অনেক শিক্ষার্থী এসেছিল। সবাই ছিল উচ্ছ্বসিত। স্থানীয় প্রশাসন আমাকে ক্রেস্ট দিয়েছিল। আমার খুব ভালো লেগেছিল।

 

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?

আয়রনম্যান ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিতে চাই। এতে অংশ নিতে ভালো প্রস্তুতি দরকার। আমার পরিকল্পনা, সময় লাগলেও আয়রনম্যান ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপের জন্য কোয়ালিফাই করা। বিশ্বের ৪৫টি দেশে আয়রনম্যান হয়। সেখান থেকে সেরা অ্যাথলেটদের বাছাই করে ইউএসের হাওয়াইতে ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!