Tuesday, May 7
Shadow

পিজি হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ্ বললেন, মাথা ব্যথা রোগ নয়, একটি উপসর্গ

মাথা ব্যথা

সমস্যা যখন মাথা ব্যথা

বেশ যন্ত্রণাদায়ক একটি বিষয় হলেও মাথা ব্যথা কিন্তু খুব সাধারণ একটি সমস্যা। প্রত্যেকে জীবনের কোনো না কোনো সময় মাথা ব্যথায় আক্রান্ত হন। এটি আসলে কোনো রোগ নয়, একটি উপসর্গ। লিখেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ্

 নানা কারণে মাথাব্যথা হতে পারে। এর নির্দিষ্ট কারণ নেই। বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, প্রায় ৫০ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ মাথা ব্যথায় ভুগে থাকেন, যার মধ্যে টেনশন টাইপ মাথা ব্যথার রোগী বেশি। মাথা ব্যথার সাধারণ কিছু কারণ হলো—

► সাইনাস

► ক্লান্তি

► পানিশূন্যতা

► পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব

► দুশ্চিন্তা ও অতিরিক্ত মানসিক চাপ

► অতিরিক্ত ব্যথানাশক ব্যবহার বা ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া

► সর্দি-কাশি

► মাথায় আঘাত, টিউমার

► ইনফেকশন

► দাঁতের রোগ

► খুব ঠাণ্ডা পানীয় বা খাবার দ্রুত খাওয়া ইত্যাদি।

► অতিরিক্ত মদ্যপান, ধূমপান

ধরন ও চিকিৎসা

অনেক ধরনের মাথাব্যথা রয়েছে, যেমন মাইগ্রেন, টেনশন টাইপ মাথা ব্যথা, ক্লাস্টার মাথা ব্যথা ইত্যাদি। তবে রোগ নির্ণয়ের সুবিধার্থে মাথা ব্যথাকে প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি—এই দুই ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে। মাইগ্রেন, টেনশনে ব্যথা ইত্যাদি প্রাইমারি ক্যাটাগরিতে পড়ে। অন্যদিকে মাথায় আঘাত বা টিউমার, ইনফেকশন ইত্যাদি সেকেন্ডারি ক্যাটাগরিতে পড়ে।

 

টেনশন

বেশির ভাগ মাথা ব্যথাই হয় টেনশন বা অতিরিক্ত দুশ্চিন্তার কারণে। টেনশন হলেই শরীরের অ্যাড্রিনাল গ্রন্থিগুলো উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে, সেখান থেকে ‘অ্যাড্রিনালিন’ নামে বিশেষ এক ধরনের জৈব রাসায়নিক পদার্থ ক্ষরিত হয়। ফলে দেহকোষ থেকে হিস্টামিন, সেরাটোনিন ও অন্যান্য রাসায়নিক দ্রব্য নিঃসৃত হয়। এতে মস্তিষ্কে অতিরিক্ত চাপ পড়ে মাথাব্যথা শুরু হয়। মাথাব্যথা ছাড়া অতিরিক্ত টেনশন থেকে হার্টের রোগ, ডায়াবেটিস ইত্যাদিও হতে পারে।

করণীয় : সুশৃঙ্খল পারিবারিক জীবনাচরণ ও আনন্দময় ঝামেলাহীন জীবনই পারে টেনশন ও এর থেকে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে।

 

মাইগ্রেন

মাথা ব্যথার মধ্যে মাইগ্রেনের ব্যথা অধিকতর তীব্র। ব্রেনের ভেতরে রক্তবাহী নালিগুলো কোনো কারণে সংকুচিত হলে মস্তিষ্কে রক্ত চলাচলের তারতম্যের কারণেই এ ধরনের মাথা ব্যথা হয়। এ জন্য শরীরের পরিপাকপ্রক্রিয়া, মস্তিষ্কের রক্তসঞ্চালনে সমস্যা, এমনকি জেনেটিক্যালিও নানা সমস্যা হতে পারে। এ ধরনের ব্যথা মাথার এক পাশ দিয়ে শুরু হয় এবং আস্তে আস্তে অস্বস্তিকর অবস্থা তৈরি করে। এই ব্যথা শুরু হলে তা কয়েক ঘণ্টা, এমনকি কয়েক দিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। মাথা ব্যথার পাশাপাশি বমি ভাব এ রোগের প্রধান লক্ষণ।

করণীয় : চিকিৎসকের অধীনে এবং নিয়মিত চেক আপের মাধ্যমে মাইগ্রেনের চিকিৎসা করা উচিত। তবে মেডিটেশন, নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমানো, অতিরিক্ত বা কম আলোতে কাজ না করা, কড়া রোদ বা তীব্র ঠাণ্ডা, উচ্চশব্দ ও কোলাহলপূর্ণ পরিবেশ পরিহার, পিসি ও টিভির সামনে বেশিক্ষণ না থাকা, প্রচুর পানি পান ইত্যাদি মাইগ্রেনে বেশ উপকারী।

 

ক্লাস্টার

ক্লাস্টার মাথা ব্যথা হঠাৎ করেই শুরু হয়, তবে আস্তে আস্তে এর তীব্রতা বাড়ে। ব্যথা এক পাশে শুরু হয়ে অনেক সময় চোখের পেছনের দিকেও প্রবাহিত হয়ে তীব্র আকার ধারণ করে। এ সময় নাক, চোখ বা ব্যথার স্থান লাল বর্ণও ধারণ করতে পারে। তীব্র আলো, ঘ্রাণ বা গন্ধ এবং শব্দে এ ধরনের মাথা ব্যথা বেড়ে যায়।

করণীয় : মাইগ্রেনের চিকিৎসা এবং ক্লাস্টারের চিকিৎসা একই। তবে বেশি সিরিয়াস ব্যথা হলে চিকিৎসক ‘ভেরাপামিল’জাতীয় ওষুধ খেতে পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এ ছাড়া অ্যালকোহল, ধূমপান ত্যাগ করা, সঠিক সময়ে ঘুমানোর অভ্যাস ইত্যাদি এসব সমস্যা থেকে মুক্ত রাখতে সহায়তা করে।

 

সেকেন্ডারি

ব্যথার উৎস যখন মাথার বাইরে থাকে, তখন তাকে সেকেন্ডারি মাথা ব্যথা বলে। যেমন—গ্লুকোমা, দাঁতের সমস্যা, আঘাত, মস্তিষ্কের টিউমার, সিজার, ব্রেনের রক্তনালিতে ইনফেকশন ইত্যাদি।

করণীয় : কারো এ ধরনের মাথা ব্যথা থাকলে বিলম্ব না করে একজন স্নায়ু বা মেডিসিন বিশেষজ্ঞের পরামর্শে যেসব কারণে মাথা ব্যথা হচ্ছে, তা শনাক্ত করে চিকিৎসা নেওয়া উচিত। বিলম্ব করলে বরং জটিলতা বাড়ে।

 

সাইনাস

সাইনাসজনিত মাথা ব্যথার রোগী অনেক। খুলির হাড়ের মধ্যে অবস্থিত কিছু ফাঁকা জায়গা থাকে, যাকে বলে সাইনাস। চোখের পেছনে, নাকের হাড়ের দুই পাশে এ রকম ফাঁকা জায়গা রয়েছে, যাতে সর্দি জমে সাইনোসাইটিস বা প্রদাহ হয়। ফলে বাতাস আটকে যায় এবং মাথা ব্যথা করে। এ মাথা ব্যথা কপালে বা গালের দুই দিকে কিংবা চোখের পেছনে হয় এবং কিছুটা জ্বরবোধ হয়।

করণীয় : আগে কারণ নির্ণয় করতে হবে যে এটা সাইনাস কি না। এরপর চিকিৎসা দিতে হবে। তবে সাইনাসজনিত মাথা ব্যথায় অ্যান্টিহিস্টামিনজাতীয় ওষুধ বেশ কাজ করে। এ ছাড়া গরম পানি দিয়ে গোসল করলে অথবা গামলায় গরম পানি নিয়ে নাক দিয়ে বাষ্প টেনে নিলে আরাম পাওয়া যায়। খুব বেশি মাথা ব্যথা করলে এক টুকরো কাপড় গরম পানিতে ভিজিয়ে কপাল, চোখের ওপর বা নাকের দুই পাশে ছেঁক দিলে সাইনাসের বদ্ধতা কাটার পাশাপাশি আরাম পাওয়া যায়।

 

হরমোনাল

নারীদের ঋতুকাল, গর্ভধারণ এবং মেনোপজের সময় হরমোনের মাত্রার পরিবর্তন হয়। তখন মন-মেজাজ পরিবর্তন, এমনকি মাথা ব্যথাও হতে পারে। জন্মনিয়ন্ত্রণের ট্যাবলেট সেবনের পর হরমোনের পরিবর্তনগুলোর কারণেও অনেকের মাথা ব্যথা বেড়ে যায়।

করণীয় : নারীদের মনোপজের সময় হরমোনের পরিবর্তনের জন্য বিভিন্ন ধরনের মাথা ব্যথা হতে পারে। এর চিকিৎসায় হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি উপকারী ফল বয়ে আনতে পারে। এ সময় টেনশনমুক্ত দৈনন্দিন জীবন নিশ্চিত করা, পর্যাপ্ত ঘুম, পানি পান ইত্যাদি বেশ সহায়ক।

 

ঝুঁকি

ঘন ঘন মাথা ব্যথা প্রাত্যহিক পারিবারিক ও কর্মজীবনকে বিষাদময় করে তুলতে পারে। তা ছাড়া তীব্র মাথা ব্যথা ডিপ্রেশনের ঝুঁকি বাড়ায়। তাই মাথা ব্যথা হলে যথাযথ চিকিৎসা করানো উচিত। মাথা ব্যথা বেশি হলে কেউ প্যারাসিটামলজাতীয় ওষুধ খেতে পারেন। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক নয়।

 

পরামর্শ

অতিরিক্ত ধূমপান, মদ্যপান, মাদক সেবন, চা-কফি, অনিয়মিত এবং অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ সেবন, রোদ বা অতিরিক্ত গরম আবহাওয়ায় বেশিক্ষণ থাকা, অতিরিক্ত শারীরিক, মানসিক পরিশ্রম, ক্ষুধার্ত থাকা ও সময়মতো না খাওয়া, যেকোনো ধরনের মানসিক চাপ ইত্যাদি মাথা ব্যথার কারণ। তাই এসব ব্যাপারে সতর্ক থাকলে মাথা ব্যথা বেশির ভাগ কমে আসবে। পাশাপাশি ইতিবাচক জীবনচর্চা, সুনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস, শারীরিক বা মানসিক বিশ্রাম, পর্যাপ্ত ঘুম, মেডিটেশন ইত্যাদি মাথা ব্যথার প্রকোপ কমাতে সাহায্য করে।

 

 

মাথা ব্যথায় ঘরোয়া দাওয়াই

কিছু ঘরোয়া পদ্ধতি প্রয়োগ করলে দ্রুত মাথা ব্যথা কমে যায়। যেমন—

আকুপ্রেসার :  ঘাড় ও মাথায় প্রেসার পয়েন্ট আকুপ্রেসার থেরাপি প্রয়োগ করলে অল্প সময়ের মধ্যেই মাথা ব্যথা কমে। এ জন্য বাঁ হাতের বৃদ্ধাঙুলি এবং তর্জনীর মাঝখানের অংশে অন্য হাতের বৃদ্ধাঙুলি ও তর্জনী দিয়ে চাপ দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ম্যাসাজ করতে হয়। একইভাবে ডান হাতেও করতে হয়।

গোসল : হালকা গরম পানিতে গোসল করলে মাথা ব্যথা কমে।

পানি পান : একগ্লাস পানি পান নিমেষেই মাথা ব্যথা দূর করে। শরীর আর্দ্র থাকলে ব্যথাও ধীরে ধীরে কমে।

লবঙ্গ : কিছু লবঙ্গ তাওয়ায় গরম করে তা একটি রুমালে মুড়ে নিয়ে কিছুক্ষণ ঘ্রাণ নিলে মাথা ব্যথা দূর হয়।

পুদিনাপাতা : পুদিনাপাতায় রয়েছে ম্যানথল ও ম্যানথন, যা মাথাব্যথা দূর করতে বেশ কার্যকর।

আপেল : এক টুকরো আপেলের সঙ্গে সামান্য লবণ মিশিয়ে খেলে মাথাব্যথা কমে।

আদা : সমপরিমাণ আদা ও লেবুর রস মিশিয়ে খেলে বা একটু টাটকা আদা কয়েকবার চিবিয়ে খেলে মাথাব্যথা দূর হয়।

বরফ : বরফের প্যাক ঘাড়ে বা মাথায় কিছুক্ষণ ধরে রাখলে মাথাব্যথা, বিশেষ করে মাইগ্রেনের ব্যথা অনেকটাই কমে যায়।

হাসি-খুশি মন : মাথাব্যথার কার্যকর উপায় হলো মনকে ইতিবাচক এবং পজিটিভ দিকে ডাইভার্ট করা। এতেও মাথাব্যথা দূর হয়।

 

 

 

 

https://www.youtube.com/watch?v=wfEPaBfx6p4&t=1s

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!

error: Content is protected !!