class="post-template-default single single-post postid-21210 single-format-standard wp-custom-logo group-blog vl-boxed aa-prefix-matin-">
Shadow

মুহম্মদ জাফর ইকবালের সাদাসিধে কথা : ভাইস চ্যান্সেলরের জীবনকাহিনি

সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ : এই লেখাটি দেশের সত্যিকারের শিক্ষাবিদ এবং নীতিবান ভাইস চ্যান্সেলরদের জন্য প্রযোজ্য নয়।

 

যাঁরা খবরের কাগজ পড়েন, তাঁরা সবাই জানেন গত কিছুদিন দেশে দুই ধরনের দুর্নীতি নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড হচ্ছে। একটি হচ্ছে যুবলীগ নেতাদের ক্যাসিনো ব্যবসা, অন্যটি হচ্ছে ভাইস চ্যান্সেলরদের দুর্নীতি এবং স্বেচ্ছাচারিতা। যুবলীগ কিংবা ছাত্রলীগের অপকর্মের কাহিনি শুনে কেউ বেশি অবাক হয় না। (তার পরও সরকারি ইঞ্জিনিয়ারদের হাজার কোটি টাকা ঘুষ দেওয়ার খবরটি মনে হয় হজম করা যথেষ্ট কঠিন। টাকাগুলো ট্রাকে করে নিতে হয় কি না ব্যাপারটা জানার আমার এক ধরনের কৌতূহল আছে।) যুবলীগ-ছাত্রলীগের অপকর্মের কথা শুনে দেশের মানুষ অবাক না হলেও ভাইস চ্যান্সেলরদের অপকর্মের কথা শুনে সবাই বুকের মাঝে এক ধরনের ধাক্কা খায়। একটা দেশের সবচেয়ে বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হচ্ছেন ভাইস চ্যান্সেলর। যখন তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি কিংবা অনৈতিক কাজকর্মের অভিযোগ আসে, তখন আমরা কার দিকে মুখ তুলে তাকাব বুঝতে পারি না।

আমি এই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পঁচিশ বছর কাটিয়ে বিদায় নিতে যাচ্ছি। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সুখ-দুঃখ, সাফল্য-ব্যর্থতা (এবং কখনো কখনো হীনতা-নীচতা) আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। তাই আমার মনে হয়েছে, কিভাবে দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ কাজ করেন, সে সম্পর্কে একটা ধারণা দিই। তবে কাজটা খুব গুছিয়ে করতে পারব বলে মনে হয় না। যেকোনো বিষয় বিশ্লেষণ করতে হলে প্রথমে বিষয়টা খুব ভালো করে বুঝতে হয়। আমি ভাইস চ্যান্সেলরদের একেবারে গোড়ার বিষয়টিই বুঝতে পারি না, কেন একজন শিক্ষক ভাইস চ্যান্সেলর হতে চান? একজন শিক্ষকের জীবন কত আনন্দের, আমি যখন আমার শিক্ষকতা জীবনের পঁচিশ বছরের কথা চিন্তা করি, সেখানে কত মধুর স্মৃতি। সেই তুলনায় একজন ভাইস চ্যান্সেলরের জীবনে দাপ্তরিক কাজ ছাড়া আর কী আছে? স্যুট-টাই পরে একটা মিটিংয়ের পর আরেকটা মিটিং, একটা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণ দেওয়ার পর আরেকটা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণ, এই জীবনের জন্য কেন একজন লালায়িত হয়?

কিন্তু আমি লক্ষ করেছি, শিক্ষকরা ভাইস চ্যান্সেলর হওয়ার জন্য খুব ব্যস্ত। সে জন্য লবিং করতে হয় এবং লবিং করে কাজ হয়। আমি নিজের কানে একজন ভাইস চ্যান্সেলরকে বলতে শুনেছি, ‘যদি কেউ দাবি করে লবিং না করে সে ভাইস চ্যান্সেলর হয়েছে, তাহলে বুঝতে হবে সে চরম মিথ্যাবাদী (ড্যাম লায়ার!)’ এ বিষয়টি আমি কোনো একটি লেখায় উল্লেখ করেছিলাম এবং সে জন্য ভাইস চ্যান্সেলরদের সংগঠনটি ক্ষুব্ধ হয়ে আমার বক্তব্যের বিরুদ্ধে একটা বিবৃতি দিয়েছিলেন। নিজের কানে যেটা শুনেছি সেটা বলেছি, সে জন্য আমার ওপর রাগ হয়ে লাভ কী? আমি ধীরে ধীরে টের পেতে শুরু করেছি, ভাইস চ্যান্সেলরের পদটি একধরনের পুরস্কার। যাঁরা খাঁটি শিক্ষাবিদ, তাঁরা এই পুরস্কারের যোগ্য নন। যাঁরা চুটিয়ে শিক্ষক রাজনীতি করেন, শুধু তাঁরা এই পুরস্কারের যোগ্য প্রার্থী। সাধারণত পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসররা এই পুরস্কারের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পেয়ে থাকেন। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়টি মোটামুটি দাঁড়িয়ে গেছে। এখানে যথেষ্ট অভিজ্ঞ শিক্ষক আছেন; কিন্তু তার পরও অর্ধেক থেকেও বেশি সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাইস চ্যান্সেলর দেওয়া হয়েছে। এখন যেহেতু আওয়ামী লীগের সরকার, কাজেই শিক্ষকরা নীল দলের শিক্ষক, তবে তাঁদের কেউ কেউ দল বদল করে নীল দলে এসেছেন। ভাইস চ্যান্সেলর হওয়ার জন্য আদর্শটি গুরুত্বপূর্ণ নয়; বর্তমান রংটি গুরুত্বপূর্ণ। যাঁরা শিক্ষক-রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন, তাঁদের সামনে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডালা খুলে দেওয়া হয়। তাঁরা সেখান থেকে কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয় বেছে নেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসররা সাধারণত ঢাকাতেই স্থায়ীভাবে থাকেন। তাই তাঁরা কোন বিশ্ববিদ্যালয়টি বেছে নেবেন, সেটা  অনেকটা নির্ভর করে ঢাকা শহরের সঙ্গে যোগাযোগ কী রকম তার ওপর। বিমান যোগাযোগ না থাকলে সেই বিশ্ববিদ্যালয়টিতে তাঁরা আসতে চান না। মফস্বলের বিশ্ববিদ্যালয়ে দু-এক দিন কাটিয়ে তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকায় বিমানে ঢাকা চলে যান। সেখানেই থাকেন, অন্য কাজকর্ম করেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সম্মানিত শিক্ষক কেন ভাইস চ্যান্সলরের  মতো একটা পদের জন্য এত ব্যস্ত থাকেন, সেটা আজকাল একটু একটু বুঝতে শুরু করেছি। আমি নিজের কানে একজন ভাইস চ্যান্সেলরকে বলতে শুনেছি, ‘আগের ভাইস চ্যান্সেলর এখান থেকে কমপক্ষে ত্রিশ কোটি টাকা নিয়ে গেছেন।’ একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেতন এবং সুযোগ-সুবিধার বাইরে একজন ভাইস চ্যান্সেলর নানাভাবে কত টাকা কামাই করেন, একবার আমার সেটা জানার কৌতূহল হয়েছিল। সেটা জানতে চেয়ে আমি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে চিঠি লিখেছি। একজনকে চিঠি লিখলেই সে চিঠির উত্তর দিয়ে সব তথ্য জানিয়ে দেবে সেটা কেউ আশা করে না; কিন্তু দেশে যেহেতু তথ্য অধিকার আইন বলে একটা আইন আছে, সেটার সূত্র ধরে আমি চিঠি লিখেছিলাম। যখন কিছুতেই চিঠির উত্তর পাই না, তখন আমি বিষয়টি তথ্য অধিকার কমিশনে জানিয়েছি। তারা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে শুনানির জন্য ডেকে পাঠিয়েছিল; কিন্তু তত দিনে ভাইস চ্যান্সেলর মহোদয় চাকরি শেষ করে চলে গিয়েছেন। আমি আমার তথ্যটি পাইনি সত্যি; কিন্তু তথ্য অধিকার আইন ব্যবহার করে যে তথ্য জানতে চাওয়া যায়, সে তথ্যটি পেয়েছি! সেটাই খারাপ কী?

যা হোক, ভাইস চ্যান্সেলর হলেই যে তিনি আর্থিক দুর্নীতি করবেন, সেটা মোটেও সত্যি নয়। কিন্তু আজকাল ঘুরেফিরে  এ কথাটি অনেক বেশি শোনা যায়। খবরের কাগজ খোলা হলেই কোনো না কোনো ভাইস চ্যান্সেলর নিয়ে কোনো একটা রগরগে খবর পাওয়া যায়। নিয়োগ বাণিজ্য আজকাল বহুল ব্যবহূত একটি শব্দ। তবে যাঁরা চালাকচতুর তাঁরা এমনভাবে সেটি করেন যে তার কোনো প্রমাণ থাকে না এবং তাঁদের ধরা খুব কঠিন। কোনো কোনো ভাইস চ্যান্সেলর শুধু যে চালাকচতুর তা নয়, একই সঙ্গে তাঁরা দুঃসাহসী। দুর্নীতির অভিযোগ পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন থেকে তদন্ত করতে এসে তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ত্রিসীমানায় ঢুকতে পর্যন্ত পারেননি—এ রকম ঘটনাও আছে। তবে অর্থনৈতিক দুর্নীতি থেকেও অনেক বড় দুর্নীতি হচ্ছে প্রশাসনিক দুর্নীতি। একজন ভাইস চ্যান্সেলরের ক্ষমতা প্রায় সীমাহীন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে তাঁরা একজন সম্রাটের মতো; ইচ্ছা করলেই তাঁরা কারো পরোয়া না করে বিশ্ববিদ্যালয় চালিয়ে যেতে পারেন। তাঁদের সবচেয়ে পছন্দসই কাজ হয় পছন্দের মানুষকে নিয়োগ দেওয়া। নিজের আত্মীয়-স্বজনকে নিয়োগ দেওয়ার জন্য সাময়িকভাবে আইন পরিবর্তন করে আবার আগের আইনে ফিরে যাওয়ার উদাহরণ আমি নিজের চোখে দেখেছি।

যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্রিয়ার সঙ্গে পরিচিত নন, তাঁরা মনে করতে পারেন, যেহেতু একজন ভাইস চ্যান্সেলর নিজের একক ইচ্ছায় যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারেন না, একাধিক কমিটির সিদ্ধান্ত নিয়ে সব কিছু করতে হয়, তাই এখানে হয়তো একধরনের ‘চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স’ আছে। কিন্তু ব্যাপারটি পুরোপুরি সত্যি নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রক্টর, প্রভোস্ট বিভিন্ন কেন্দ্রের পরিচালক-জাতীয় অনেক অর্থকরী পদ থাকে, ভাইস চ্যান্সেলর নিজের ক্ষমতাবলে সেগুলো বিতরণ করেন। সব বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষকদের দল থাকে, সব দলের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষকদের এ রকম অর্থকরী পদ দিয়ে তাঁদের মুখ বন্ধ করে ফেলা যায়। চাটুকার-জাতীয় শিক্ষকরা নিজেরাই মুখ বন্ধ রাখেন। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটিগুলো ভাইস চ্যান্সেলরের মুখের কথায় উঠে-বসে। একজন ভাইস চ্যান্সেলর একজন শিক্ষক ছাড়া কিছু নয়; কিন্তু তার পরও তাঁরা অনেক সময় অবলীলায় অন্য শিক্ষকদের প্রকাশ্যে ধমকধামক দিতে কিংবা অপমান করতে দ্বিধা করেন না। আত্মসম্মানহীন শিক্ষকরা দেখতে দেখতে কেঁচোর মতো হয়ে যান। ভাইস চ্যান্সেলররা তখন প্রবল প্রতাপে একাডেমিক কাউন্সিল কিংবা সিন্ডিকেটের মতো গুরুত্বপূর্ণ সভাগুলো নিয়ন্ত্রণ করেন। সিদ্ধান্তগুলো কাগজে লিখে নিয়ে এসে একাডেমিক কাউন্সিলে কিংবা সিন্ডিকেটে ঘোষণা করেন, আধা ঘণ্টার মধ্যে মিটিং শেষ হয়ে যায়, চা শিঙাড়া পর্যন্ত খেয়ে শেষ করার সময় পাওয়া যায় না।

একজন ভাইস চ্যান্সেলর ছলে-বলে-কৌশলে কিংবা প্রবল প্রতাপে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাইকে নিয়ন্ত্রণ করলেও সব সময় ছাত্রদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। ছাত্র-ছাত্রীদের ভয়ভীতি দেখিয়ে অনেক সময়ই নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা হয়; কিন্তু অবস্থা যখন বাড়াবাড়ি হয়ে যায়, তখন হঠাৎ তাদের মধ্যে বিস্ফোরণ ঘটে। অবাধ্য ছাত্র-ছাত্রীদের শায়েস্তা করার জন্য তখন ভাইস চ্যান্সেলরের আজ্ঞাবহ শিক্ষকরা সরকারি দলের ছাত্রদের নিয়ে মাঠে নামেন। ব্যাপক পিটুনি দিয়ে কখনো কখনো আসলেই সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের শায়েস্তা করে ফেলা হয়। কখনো কখনো অবস্থা আয়ত্তের বাইরে চলে যায়, সরকারের টনক নড়ে এবং শেষ পর্যন্ত সেই ভাইস চ্যান্সেলরকে সরিয়ে নেওয়া হয়।

মোটামুটি এই হচ্ছে আমাদের দেশের বেশির ভাগ ভাইস চ্যান্সেলরের জীবনকাহিনি!

২.

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হচ্ছে এই দেশের অনেক বড় একটা সম্পদ। এ সম্পদকে যেকোনো মূল্যে রক্ষা করতে হবে। সেটা করার একটা মাত্র উপায়, সত্যিকারের শিক্ষাবিদদের ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া। ঘড়েল রাজনীতিবিদদের নয়, অর্থলোভী মানুষদের নয়, নীতিহীন চরিত্রদের নয়—ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার জন্য খুঁজে খুঁজে বের করতে হবে সেই শিক্ষকদের, যাঁরা শিক্ষাকে ভালোবাসেন, শিক্ষকদের ভালোবাসেন এবং সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন ছাত্র-ছাত্রীদের।

এ রকম শিক্ষক অনেকেই আছেন, অন্যদের লাফ-ঝাঁপের কারণে তাঁরা চোখের আড়ালে পড়ে থাকেন। তাঁদের খুঁজে বের করা এমন কোনো কঠিন কাজ নয়।

 

লেখক : কথাসাহিত্যিক এবং সাবেক অধ্যাপক শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!