নাড়ির টানে ঘরমুখো মানুষের ভিড়ে বাস, ট্রেন, লঞ্চ স্টেশনগুলোতে তিল ফেলার জায়গা নেই। সব কষ্ট সহ্য করে হলেও মানুষ ফিরে যাচ্ছে শৈশবের স্মৃতিমাখা গ্রামের বাড়ি। উদ্দেশ্য হলো প্রিয় মানুষগুলোর কাছাকাছি থেকে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করা। বাঙালির এ নজিরবিহীন প্রাণের বন্ধন বিশ্বের আর কোথাও আছে কি না, তা আমার জানা নেই। সাধারণত ঈদের মৌসুমে সবচেয়ে বেশি মানুষকে সফর (ভ্রমণ) করতে হয়। ভ্রমণেও রয়েছে প্রিয় নবী (সা.)-এর কিছু সুন্নত , যা অনুসরণ করলে আমাদের ভ্রমণও ইবাদতের শামিল হবে, ইনশাআল্লাহ।
ভ্রমণে বের হওয়ার আগে কোনো অভিজ্ঞ ব্যক্তির (যিনি ওই রাস্তাঘাট কিংবা গন্তব্যের অবস্থা সম্পর্কে অবগত আছেন) সঙ্গে পরামর্শ করা। আগেকার যুগে মানুষকে অনেক দূরে হেঁটে বা ঘোড়া-উটে চড়ে কয়েক দিন সময় নিয়ে যেতে হতো। রাতের বেলায় বিভিন্ন এলাকায় রাত কাটাতে হতো। ফলে রাস্তাঘাটের স্পষ্ট ধারণা না থাকলে বিপদের আশঙ্কা ছিল। বর্তমান যুগেও প্রয়োজনে গুগল ট্রাফিক ব্যবহার করেও রাস্তাঘাটের অবস্থা সম্পর্কে ধারণা নেওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি কোনো অভিজ্ঞ লোকের সঙ্গেও পরামর্শ করা যেতে পারে। এতে কোন রাস্তায় গেলে ভ্রমণ সহজ হবে, তা জানা যাবে এবং সুন্নত ও আদায় হয়ে যাবে।
দুই রাকাত নামাজ পড়ে ইস্তিখারা করা (কোনো কাজ শুরু করার আগে এর ভালো ফলের জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া করা)। সাধারণত কোনো কাজ নিয়ে দোদুল্যমানতায় ভুগলে ইস্তিখারা করতে হয়। পরবর্তী সময়ে যেদিকে মন ধাবিত হয়, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়াই উত্তম।
বাবা কিংবা কোনো গুরুজনের অনুমতিক্রমে আল্লাহর কাছে তাওবা-ইস্তিগফার ও সাহায্য প্রার্থনার মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করা।
ভ্রমণে বের হওয়ার সময় দোয়া পড়া, ‘সুবহানাল্লাজি সাখ্খারা লানা হা-জা ওয়ামা কুন্না লাহু মুকরিনিন, আল্লাহুম্মা ইন্না নাসআলুকা ফি সাফরিনা হা-জাল বিররা ওয়াত তাকওয়া, ওয়ামিনাল আমালি মা তার-দা, আল্লাহুম্মা হাউইন আলাইনা সাফারনা হা-জা, ওয়াতভি আন্না বু’দাহু, আল্লাহুম্মা আংতাস সাহিবু ফিস সাফরি ওয়াল খলিফাতু ফিল আহলি, আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিন ওয়া’সা-ইস সাফরি, ওয়া কা-বাতিল মানজারি, ওয়া ছু-ইল মুনকলাবি ফিল মালি ওয়াল আহলি।’ (বি.দ্র. আরবি ভাষায় দোয়া কোনো আলেম থেকে সরাসরি ঠিক করে নিতে হয়, বাংলায় হুবহু উচ্চারণ লেখা সম্ভব নয়)
অর্থ : ‘পবিত্র মহান সে সত্তা, যিনি একে আমাদের বশীভূত করে দিয়েছেন, যদিও আমরা একে বশীভূত করতে সক্ষম ছিলাম না। আমাদের অবশ্যই আমাদের প্রতিপালকের কাছে ফিরে যেতে হবে। হে আল্লাহ, আমাদের এ ভ্রমণে আমরা তোমার কাছে কল্যাণ, তাকওয়া এবং তোমার সন্তুষ্টি বিধানকারী কাজের তৌফিক চাই। হে আল্লাহ, আমাদের এ সফর আমাদের জন্য সহজ করে দাও এবং এর দূরত্ব কমিয়ে দাও। হে আল্লাহ, তুমিই (আমাদের) সফরসঙ্গী এবং পরিবারের তত্ত্বাবধানকারী। হে আল্লাহ, তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করি সফরের কষ্ট, দুঃখজনক দৃশ্য এবং ফিরে এসে সম্পদ ও পরিবারের ক্ষতিকর পরিবর্তন থেকে।’ (সহিহ মুসলিম : ১৩৪২)
পারতপক্ষে একা একা ভ্রমণ না করা। কমপক্ষে দুজন মিলে ভ্রমণ করা। এতে মানুষের মনোবল বেশি থাকে, কোনো সমস্যায় পড়লে পাশে থাকার মতো অন্তত একজন পরিচিত লোক থাকে।
আরো কিছু সুন্নত
গাড়ি-ঘোড়া বা যেকোনো যানবাহনে আরোহণের সময় ‘বিসমিল্লাহ’ পড়ে আরোহণ করা।
যানবাহনে ঠিকমতো বসার পর তিনবার ‘আল্লাহ আকবার’ পড়ে এ দোয়া পড়া। উচ্চারণ : সুবহানাল্লাজি সাখ্খারা লানা হা-জা ওয়ামা কুন্না লাহু মুকরিনিন, ওয়া ইন্না ইলা রাব্বিনা লামুংকালিবুন।
নৌকা বা জাহাজযোগে ভ্রমণের ক্ষেত্রে এ দোয়া পড়া, ‘বিসমিল্লাহি মাজরেহা ওয়া মুরসা-হা, ইন্না রাব্বি লাগাফুরুর রহিম।’
ভ্রমণাবস্থায় যানবাহন যখন ওপরের দিকে ওঠে তখন ‘আল্লাহু আকবার’ আর যখন নিচের দিকে নামে তখন ‘সুবহানাল্লাহ’ পড়া। যেমন—বাসগুলো যখন ফ্লাইওভারে বা ব্রিজে ওঠে তখন ‘আল্লাহু আকবার’ পড়া যেতে পারে। আর যখন ফ্লাইওভার বা ব্রিজ থেকে নিচে নামে তখন ‘সুবহানাল্লাহ’ পড়া যেতে পারে।
গন্তব্যে পৌঁছার পর তিনবার ‘আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফিহ’ পাঠ করা। ভ্রমণের প্রয়োজন পূরণ হলে দ্রুত বাড়ি ফিরে আসা, অযথা দেরি করা ঠিক নয়। ভ্রমণকালীন সঙ্গে কুকুর না রাখা। ভ্রমণ থেকে ফিরে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করা ও এ দোয়া পাঠ করা, ‘আ-ইবুনা তা-ইবুনা আ-বিদুনা লিরব্বিনা হামিদুন।’
প্রসঙ্গত, ৪৮ মাইল বা ৭৮ কিলোমিটার ও এর অধিক দূরের সফরের নিয়তে বের হয়ে মানুষ নিজের এলাকা ত্যাগ করলেই মুসাফির হয়ে যায়। (আহসানুল ফাতাওয়া ৪/১০৫)
তবে শহরের ক্ষেত্রে শহরের সিটি করপোরেশনের সীমানা নিজ এলাকা হিসেবে নির্ধারিত হবে। ফলে সিটি করপোরেশনের সীমানা পার হলে মুসাফির হয়ে যাবে। (রদ্দুল মুহতার ২/১২৮)
মুসাফিরের জন্য ইসলামী শরিয়তে কিছু শিথিলতা দেওয়া হয়েছে। তাদের চার রাকাতবিশিষ্ট ফরজ নামাজগুলো দুই রাকাত পড়তে হবে। কেউ যদি ইচ্ছাকৃত বা ভুলবশত চার রাকাতের নামাজগুলো চার রাকাতই পড়ে, তবে সে গুনাহগার হবে এবং তাকে নামাজ আবার পড়তে হবে। (বাদায়েউস সানায়ে ১/৯১)
মুসাফির ব্যক্তির জন্য তার যানবাহন চলন্ত অবস্থায় বা তাড়াহুড়া থাকলে ফজরের সুন্নত ছাড়া অন্যান্য সুন্নতে মুয়াক্কাদা না পড়ার সুযোগ রয়েছে। তবে স্বাভাবিক ও স্থির অবস্থায় সুন্নতে মুয়াক্কাদা পড়তে হবে। (ইলাউস সুনান : ৭/১৯১, রদ্দুল মুহতার : ১/৭৪২)
অনেকে সফর অবস্থায় নামাজ পড়তে নেমেও সুন্নতে দাঁড়িয়ে যায়। এতে অন্য যাত্রীরা বিরক্ত হয়। চালকরা গাড়ি থামাতে চায় না। তাই যাত্রীবাহী গাড়িতে সফরের ক্ষেত্রে সংক্ষেপে ফরজ পড়েই গাড়িতে চলে যাওয়া উত্তম। কেউ ব্যক্তিগত গাড়িতে ভ্রমণ করলে ভিন্ন কথা।