Monday, December 23
Shadow

গণপিটুনি : কারণ যা-ই হোক কেন, শরিয়তে তা সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য

সম্প্রতি তাছলিমা বেগম রেনু নামের এক নিঃসঙ্গ মাকে ‘শিশুচোর’ সন্দেহে গণপিটুনি দেওয়া হয়। ঢাকার একটি স্কুলে ভর্তিসংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে সহিংস জনতার আক্রমণের শিকার হয়ে মারা যান তিনি। গতকাল সারা দেশে শিশুচোর সন্দেহে তিনজন গণপিটুনিতে প্রাণ হারিয়েছেন। (২২ জুলাই, কালের কণ্ঠ) মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ৩৬ জন গণপিটুনিতে মারা গেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে পদ্মা সেতুর জন্য মানুষের মাথা প্রয়োজন- এমন গুজবে জনমনে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। সৃষ্ট আতঙ্কের কারণে গণপিটুনির হার বৃদ্ধি পেয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে।

গণপিটুনির কারণ যা-ই হোক কেন, শরিয়তে তা সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। শরিয়ত মানুষের বিচারের ভার মানুষের হাতে তুলে দেয়নি। কোনো মানুষ অপরাধ করলে তার বিচার রাষ্ট্রীয় বিচারব্যবস্থার মাধ্যমেই হবে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘জাকাত, হদ (শরিয়ত নির্ধারিত শাস্তি), ফাই (যুদ্ধলব্ধ এক প্রকার সম্পদ) ও জুমা সুলতানের (রাষ্ট্রের) দায়িত্ব।’ (আহকামুল কোরআন লিল জাসসাস, পৃষ্ঠা ১৩১)

ইমাম কুরতুবি (রহ.) বলেন, ‘শুধু দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাই কিসাস (প্রাণদণ্ড) বাস্তবায়ন করবে- এ ব্যাপারে আলেমদের মধ্যে কোনো মতভিন্নতা নেই।’ (তাফসিরে কুরতুবি : ২/২৪৫)

শরিয়ত অপরাধের শাস্তি বাস্তবায়নের দায়িত্ব রাষ্ট্রকে দিয়ে শেষ করেনি; এর সঙ্গে সন্দেহাতীতভাবে তা প্রমাণিত হওয়ারও শর্ত দিয়েছে। সুতরাং কোনো ব্যক্তির ব্যাপারে অভিযোগ পেলে তা প্রমাণের পূর্বে সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, রাষ্ট্রও তাকে শাস্তি দেওয়ার অধিকার রাখে না। ইসলামী দণ্ডবিধির একটি মূলনীতি হলো, ‘সন্দেহ হদ বা শাস্তি রহিত করে।’ (কাওয়াইদুল ফিকহ)

এমনকি ব্যভিচারসংক্রান্ত এক হাদিসে রাসুল (সা.) অকাট্যভাবে প্রমাণের পূর্বে অপরাধীর ব্যাপারে কুধারণা পোষণ করতেও নিষেধ করেছেন। সেখানে সন্দেহের বশবর্তী হয়ে মানুষকে প্রহার করা, তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা কিভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে?

গণপিটুনিতে কেউ নিহত হলে তা ইসলামী দণ্ডবিধি মোতাবেক হত্যা হিসেবেই বিবেচিত হবে এবং এর সঙ্গে জড়িত সবাই হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে দণ্ডপ্রাপ্ত হবে—সংখ্যায় তারা যতই হোক না কেন। তবে হ্যাঁ, সবার শাস্তি এক হবে না, আবার সব হত্যার বিধানও এক হবে না। যদি গণপিটুনিতে অংশগ্রহণকারীদের উদ্দেশ্য হত্যা হয় তাহলে সবাই মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হবে, যদি না তারা নিহতের আত্মীয়দের সঙ্গে মৃত্যুপণের বিনিময়ে আপস করতে সক্ষম হয়। ইসলাম মানুষকে মানুষের জীবন, সম্ভ্রম ও সম্পদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে বলেছে। বিদায় হজের ভাষণে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয় তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্পদ, তোমাদের সম্ভ্রম পরস্পরের জন্য হারাম; আজকের দিনের মতো, তোমাদের শহরের (মক্কা) মতো, তোমাদের এই মাসের (জিলহজ) মতো। অতি শীঘ্রই তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের নিকট প্রত্যাবর্তন করবে। সুতরাং আমার পরে তোমরা কুফরির দিকে ফিরে যেয়ো না যে তোমরা পরস্পরের ঘাড়ে আঘাত করবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৭০২)

সুতরাং যদি কোথাও গণপিটুনির মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়, তাহলে মুসলিম হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হলো গুজবে কান না দিয়ে ধৈর্য ধারণ করা এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া, যেন তার উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করা যায়। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘যদি তোমরা তাদের শাস্তি দিতে চাও তবে তাদেরকে সেই পরিমাণ শাস্তি দাও, যে শাস্তি তারা তোমাদেরকে দিয়েছে। আর যদি তোমরা ধৈর্য ধারণ করো, তবে তা ধৈর্যধারণকারীদের জন্য কল্যাণকর হবে।’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ১২৬) ভেবে দেখতে হবে, অপরাধ প্রমাণের পূর্বেই যদি ব্যক্তিকে আঘাত করা হয়, তাকে হত্যা করা হয়, তাহলে উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করা কিভাবে সম্ভব? সেটা কি বাড়াবাড়ি ও অবিচারের শামিল হবে না?

আতাউর রহমান খসরুর লেখা থেকে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!