class="post-template-default single single-post postid-11142 single-format-standard wp-custom-logo group-blog vl-boxed aa-prefix-matin-">
Shadow

কানাডা প্রবাসীর ভালোবাসা যখন কাঠগড়ায়

আফরিন জাহান, ক্যালগেরি, কানাডা

‘আজকাল আর বিদেশ বলে কিছু নেই। ইন্টারনেটের কল্যাণে পৃথিবী এখন সবার কাছে সুপরিচিত। এক জায়গার জীবনাচরণ, পরিবেশ অন্য জায়গার মানুষ চাইলেই জানতে বুঝতে পারে। অনেকটা উপলব্ধিও করতে পারে।’ বেশ কয়েকজনের মুখে এই কথা শুনে শুনে রুনি খুব আশ্বস্ত হয়েছিল, যাক দেশের মানুষ এখন অনেক বেশিই জানে।
তারপরও সবাই একটু সাবধানেই থাকতে বলেছিল। কেননা রুনিরা বাস করে বাংলাদেশের একেবারে বিপরীত গোলার্ধে। যেখানে মাইনাস ৪০ ডিগ্রির তীব্র শীত পড়ে, আর বাংলাদেশে পজিটিভ ৩৭-৩৮ ডিগ্রির গরম। আর এই গরমের দিনেই রুনি গিয়েছিল দেশে। তার ওপর ট্রপিক্যাল ডিসিজ বলে বেশ কিছু রোগ বালাই আছে। যার সঙ্গে এই ঠান্ডা অঞ্চলের মানুষের শরীর পরিচিত নয়। আবার ঢাকায় আছে বিশুদ্ধ পানির অভাব। দেশের মানুষ এই সব কিছুর মধ্যে থাকতে থাকতে তাদের শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠেছে প্রাকৃতিকভাবেই। তেমনি এসব থেকে দূরে থেকে থেকে রুনি ও তার পরিবারের এই সব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা খুবই দুর্বল। ভয় একটু লাগছিল বৈকি! সে জন্যই লোকমুখে শোনা কথাগুলো রুনিকে স্বস্তি দিয়েছিল। সবাই ওদের সহজে বুঝতে পারবে এই ভেবে।
অনেকেই আছেন, যা আছে কপালে তাই হবে, এই ভাবনা নিয়ে সবকিছুই করতে থাকেন। কোনো কিছুতেই কোনো রকম সতর্কতার দরকার মনে করেন না। অনেক সময় ভাগ্যক্রমে তাদের তেমন কিছু হয় না, আবার অনেক সময় বেশ বড়সড় বিপদেই পড়েন তারা। রুনির স্বভাব এর উল্টো। সে আবার একটু পড়াশোনা করে জেনে শুনে, সবকিছুতে একটু নিয়ম মেনে চলতেই পছন্দ করে। কানাডা আসার বহু আগে থেকেই সে এ রকম। সেই ছোটবেলাতেই তার মা অভ্যাস করেছিল, ফুটানো পানি দিয়ে খাবার প্লেট ও হাত ধুয়ে তবেই খাওয়া শুরু করতে। তা ছাড়া কাচা পানি দিয়ে হাত ধুয়ে সেই হাতে খাবার খেলে জীবাণু তো পেটে যাচ্ছেই। দেশ থেকে যারাই অসুখে ভুগে ফিরে আসে, বেশির ভাগই এই পানিবাহিত রোগেই ভোগে। একবার এক পরিবারের বাচ্চা দেশে গিয়ে কয়েক দিনের মধ্যেই প্রচণ্ড পেটের অসুখ নিয়ে শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। আর সেখান থেকেই ফেরত এসেছিল কানাডার হাসপাতালে। তার অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে গিয়েছিল। এসব ঘটনা রুনিকে আরও বেশি সতর্ক করে তোলে।
কিন্তু এসব বাধা দেশের প্রতি ভালোবাসাকে কমিয়ে দেয় না, কমে না নিজের লোকজনকে দেখার তীব্র টান। যেসব মানুষের সঙ্গে জীবনের একটা বড় সময় রুনি পার করে এসেছে। যে দেশের আলো বাতাসে তার বেড়ে ওঠা, সুদীর্ঘ সময় তা থেকে দূরে থাকার কষ্ট, রূপ নেয় প্রবল এক ভালোবাসায়। হৃদয়ের গভীর গহিনে সে ভালোবাসা গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে থাকে, বাড়তে থাকে কাছে পাওয়ার আকুতি। সেই সঙ্গে মুছে যায় কাছে থাকা সময়কার মান অভিমান রাগের ইতিহাস। তাইতো রুনির যত গল্প তার সন্তানদের সঙ্গে সবই তার দেশ, তার আত্মীয় পরিজন, তার ফেলে আসা অতীতের যত আনন্দ ভালোবাসার গল্প। রুনির কাছ থেকে গল্প শুনে শুনে তার সন্তানেরাও ভালোবেসে ফেলে গল্পের সেই সব আত্মীয় বন্ধুদের, সেই সঙ্গে বাংলাদেশকে। তারাও অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে দেশে যাওয়ার। যদিও দিন রাতের পার্থক্যের কারণে ভিডিও কলে খুব বেশি দেখা হয় না সেই সব মানুষদের। আর দূরত্বের কারণে যে জড়তা, তাতে কথা বলাও খুব আগায় না। তবুও মায়ের কাছে শোনা আনন্দের সেই দিনগুলোকে ওরাও পেতে চায়।
কিন্তু হায়, একি! সবকিছু যেন অনেক বেশি কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ৩৬ ঘণ্টার দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তি আর তীব্র গরমের অস্বস্তিতে সামলে ওঠাই কঠিন। তার মধ্যেই রুনির ভালোবাসাকে দাঁড়াতে হয়েছিল কাঠগড়ায়! ‘এত বেশি ফুটানো পানি, ফিল্টারের পানি কোথায় পাওয়া যাবে! এ দেশের মানুষ কী কাচা পানি ব্যবহার করছে না! উন্নত দেশে থেকে ঢং বেড়ে গেছে! এত বেশি সতর্ক হতে গেলেই ঝামেলা বাড়বে, তার চেয়ে সবাই যেভাবে চলছে সেভাবে থাকলেই কিছু হবে না!’ রুনিদের উদ্দেশ্যেই ছিল এসব কটাক্ষ। এরপর মেয়ে বলেই কিনা! রুনির সন্তানদের নিয়েও কথা। রুনি নাকি কিছুই শেখায়নি তাদের! ওরা যে সম্পূর্ণ ভিন্নরকম একটা জায়গা থেকে গেছে, নতুন পরিবেশের জড়তাটুকুও ওদের অপরাধ! রুনির নেওয়া উপহারগুলোও নাকি ছিল সব পয়সা নষ্ট! রুনিদের উন্নত দেশে আরাম আয়াসে থাকার খেসারত হিসেবে, যেসব কষ্ট দেশের মানুষ নিজেরাও করে না সেসবেরও পরীক্ষার আয়োজন হয়েছিল।
প্রচণ্ড হতাশায় রুনি জেনেছিল, ইন্টারনেটের এ যুগেও ওদেরকে অনেকেই বোঝে না! কতটা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে তাদের বসবাস করতে হয় এ তীব্র শীতের দেশে! কতটুকু আন্তরিকতায় রুনিরা তাদের কষ্টার্জিত সীমিত সম্পদের ভাগ পাঠায় দেশের মানুষগুলোর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশে! কত আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে একটু কাছে যাওয়ার! প্রাকৃতিক নিয়মে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শারীরবৃত্ত বদলে গেছে কিন্তু মনটা যে পড়ে আছে সেই বাংলাদেশে, এই অপরাধেই কী রুনিকে দাঁড়াতে হয়েছিল কাঠগড়ায়?
তবুও রুনির রাগ হয় না। কষ্ট হয়, তীব্র কষ্ট! ভেতরে জমে থাকা ভালোবাসা সেই কষ্টকেও চোখের জলে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এর মাঝেই কেউ কেউ আবার বোঝে, ভালোবেসে কাছে টেনে নিয়েছিল তাদের। সে ভালোবাসায় রুনির প্রবাস জীবনের টিকে থাকার প্রেরণা। তাই রুনির ভালোবাসা কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েও বলতে চায়—‘বিশ্বাস কর, আমি তোমাদের ভালোবাসি, তোমাদের ভালো মন্দ সবকিছু মিলিয়েই ভালোবাসি। বিনিময়ে শুধু তোমাদের ভালোবাসাটুকুই চাই।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!