class="post-template-default single single-post postid-10579 single-format-standard wp-custom-logo group-blog vl-boxed aa-prefix-matin-">
Shadow

ভারতে শুরু হয়েছে মিটু আন্দোলন, বাংলাদেশে কবে? : তসলিমা নাসরিন

তসলিমা নাসরিনভারতের মতো দেশে কখনও যে মিটু আন্দোলন শুরু হবে, এ আমি ভাবিনি। এর কারণ অনেক। ভারতের সমাজ এখনও প্রচন্ড পুরুষতান্ত্রিক। এখনও প্রচণ্ড নারী বিদ্বেষী। ভারতের পুরুষ বিশেষ করে যাঁরা নামি, দামি, বিখ্যাত, প্রখ্যাত, জনপ্রিয়, প্রভাবশালী, প্রতাপশালী তাঁরা অখ্যাত মেয়েদের কোনও রকম অভিযোগ সহ্য করার লোক নন। বেয়াদপ মেয়েদের কী করে শায়েস্তা করতে হয়, তাঁরা জানেন। মেয়েরা ভয় পায় বলে ধর্ষণের শিকার হয়েও মুখ লুকিয়ে রাখে। দিল্লির বাসে গণধর্ষণের শিকার নির্ভয়ার আসল নাম লুকিয়ে রাখা হয়েছিল, তাঁর মুখও কোথাও দেখানো হয়নি, এমনকী যখন সারা দুনিয়ার মানুষ তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিল।

ভারতে বিখ্যাত লোকদের বিরুদ্ধে মেয়েরা ধীরে ধীরে মুখ খুলছে। তনুশ্রী দত্ত নামের এক অভিনেত্রী বিখ্যাত অভিনেতা নানা পাটেকার এবং বিবেক অগ্নিহোত্রী নামের এক চিত্রপরিচালকের বিরুদ্ধেও যৌন হেনস্তার অভিযোগ করেছেন। মামলা করতে গিয়ে দেখেছেন, নানা আর বিবেকই তনুশ্রীর বিরুদ্ধে মামলা করে বসে আছেন। হলিউডে মিটু আন্দোলন হয়েছে, মানুষ এ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল বলেই হয়তো তনুশ্রীর অভিযোগকে কিছু প্রচারমাধ্যম গুরুত্ব দিচ্ছে। তা না হলে তনুশ্রী কোথাও তাঁর অভিযোগের কথা বলার জায়গা পেতেন না। ২০০৮ সালে অভিযোগ করেছিলেন, তখন কেউ শুনতে চায়নি ওঁর কথা। আজও কিন্তু তনুশ্রীর পাশে নয়, বেশির ভাগ লোক নানা পাটেকারের পাশেই দাঁড়িয়েছে। অমিতাভ বচ্চন, সালমান খান, আমীর খান সবাই। তনুশ্রীকে সমর্থনের সংখ্যা খুব স্বাভাবিকভাবেই কম। কারণ তনুশ্রী মেয়ে, তনুশ্রী বিখ্যাত নন। মেয়েরা বিখ্যাত হলেও, আমার মনে হয় না, পুরুষের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্তার অভিযোগ করেও আগের মতো নিজের আসন ঠিক রাখতে পারবে। ঐশ্বর্য রাই যখন সালমান খান সম্পর্কে বলেছিলেন, কীভাবে তিনি শিকার হয়েছেন সালমান খানের শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচারের, কেউ কি সালমান খানের বিরুদ্ধে কোনও রকম ব্যবস্থা নিয়েছিল? অবশ্যই না। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কখনও মেয়েদের ওপর হওয়া পুরুষের যৌন আক্রমণকে আক্রমণ হিসেবে দেখে না। দেখে পুরুষের স্বাভাবিক আচরণ হিসেবেই।

কিছু মেয়ে প্রাক্তন সাংবাদিক-সম্পাদক এবং বর্তমান মন্ত্রী এম জে আকবরের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন। ক’জন কমেডিয়ানের মুখোশও খোলা হয়েছে। ধীরে ধীরে মুখোশ খসে পড়ছে বিখ্যাত লোকদের। মন্ত্রীদের মুখোশ খসতে শুরু করলে সর্বনাশ। গদি ত্যাগ করতে হলে ফাঁকা হয়ে যাবে সংসদ। আমরা জানি, যে যত বেশি ক্ষমতাশালী, সে তত বেশি চড়াও হয় দুর্বলের ওপর, যে যত বেশি ধনী তত সে গরিবের সঙ্গে প্রতারণা করে, তত বেশি যৌন হেনস্তা করে মেয়েদের। সরকার থেকে তো বটেই, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকেও এক সময় দুর্নীতিবাজ বেরিয়েছে। ধর্ষকও বেরোবে ওভাবেই।

আজ যে ভারতীয় মেয়েরা ধর্ষণের এবং যৌন হেনস্তার অভিযোগ করছে বিখ্যাত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে, সেই মেয়েদের নানাভাবে হেনস্তা হতে হচ্ছে সমাজে। কারণ বিখ্যাত পুরুষ যৌন হেনস্তা করলেও, তার পাশে জনতার সমর্থন থাকে। মানুষ ভেবেই নেয় মেয়েদের যৌন হেনস্তা করার একটা জম্ম গত অধিকার পুরুষের আছে। মেয়েরা যৌন হেনস্তার মতো এসব অপ্রিয় সত্য কথা উচ্চারণ করুক, কেউ চায় না। আর ঘটনার কয়েক বছর পর উচ্চারণ করলে তো সর্বনাশ। ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে কেন অভিযোগ করেনি? যেন কয়েক বছর পর অভিযোগ করলে, সেটা অভিযোগ হিসেবে টেকে না। যেন অভিযোগের গায়ে মেয়াদোত্তীর্ণ ছাপ মারা থাকে। মেয়েরা একবার ধর্ষণ বা যৌন হেনস্তার শিকার হলে সারা জীবন বুকের ভিতর একটা ক্ষত নিয়ে বেঁচে থাকে। এই ক্ষত সারা জীবনেও আর সারে না। এটি মেয়েদের কুরে কুরে খায়, একটা দুঃস্বপ্নকে সারা জীবন বহন করে বেড়াতে হয়। পঁচিশ বছরে কত কথা মেয়েরা ভুলে যায়, কিন্তু ধর্ষণের কথা কারোরই ভোলা সম্ভব হয় না। এটি প্রকাশ করার সব সময় শক্তি মেয়েদের থাকে না। মিটু আন্দোলন মেয়েদের সামান্য হলেও সেই শক্তিটি জুগিয়েছে। প্রভাবশালী পুরুষের বিরুদ্ধে লড়াই করার শক্তি সাধারণ মেয়েদের মধ্যে নেই। মেয়েদের মানসিকভাবে শক্তিমান করার কোনও শিক্ষাও সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়। স্বনির্ভর মেয়েরা নামেই স্বনির্ভর। অর্থনৈতিক সচ্ছলতা তাদের থাকলেও সামাজিক নিরাপত্তা পেতে এখনও পুরুষের ওপর নির্ভর করতে হয়। মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা একটা মিথ, ঠিক তেমনই নারীর সত্যিকার স্বনির্ভরতাও একটা মিথ।

নারী বিদ্বেষ, নারী নির্যাতন, নারী ধর্ষণ আমাদের সমাজে এতই স্বাভাবিক যে পুরুষের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে সমাজ পুরুষের দিকে নয়, নারীর দিকে ঘৃণা ছোড়ে। পুরুষকে মাথা নিচু করতে হয় না, নারীকে করতে হয়। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, যে পুরুষই আমাকে লাঞ্ছিত করেছে, যে পুরুষই আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে, তাদের কাউকে অপদস্থ করেনি সমাজ, করেছে আমাকে। কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সঙ্গে এককালে আমার সম্পর্ক ছিল প্রেমের এবং বিয়ের। সে কীভাবে আমাকে প্রতারণা করেছে, তা আমি আমার আত্মজীবনীর ২য় খণ্ড ‘উতল হাওয়া’য় বলেছি। বিয়ের পরও তাঁর নিয়মিত গণিকালয় গমন এবং যৌন রোগ বহন করে নিয়ে এসে নিজের স্ত্রীকে সংক্রামিত করার ভয়াবহ সেইসব কাহিনী। সেসব পড়ার পর বাংলাদেশের সমাজ রুদ্রকে এতটুকু ঘৃণা করেনি, করেছে আমাকে। কেন আমি যৌন বিষয় আশয় নিয়ে মুখ খুলেছি, নিশ্চয়ই আমি খারাপ, নিশ্চয়ই আমি ‘পতিতা’। কারণ তাদের কাছে যে মেয়ে মুখ বুজে সব অত্যাচার সহ্য করে, সে মেয়ে ভালো। যে মেয়ে স্বামীর কোনও অপকর্মকে প্রকাশ না করে লুকিয়ে রাখে, সে মেয়ের চরিত্র চমৎকার। আসলে রুদ্রের কীর্তি ফাঁস হওয়ার পর রুদ্রের বদনাম হয়নি বরং তার জনপ্রিয়তা উত্তরোত্তর বেড়েছে। কোনও সভ্য দেশে এটি কল্পনা করা যায় না। আত্মজীবনীর তৃতীয় খণ্ড ‘দ্বিখণ্ডিত’তে লিখেছি, দেশের বড় সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক আমাকে বলতেন তাঁর সঙ্গে কোন কোন কচি মেয়ের কী কী সম্পর্ক। আমাকেও একবার দূরে বেড়াতে নিয়ে গিয়ে এক ঘরে রাত কাটাবার ব্যবস্থা করেছিলেন। যদিও আমি মন্দ কিছুই ঘটতে দিইনি, কিন্তু পুরো ব্যাপারটা আমাকে ভীষণ অস্বস্তি দিয়েছিল। এই সত্য যখন প্রকাশ করেছি, তখন সৈয়দ শামসুল হককে কি ক্ষমা চাইতে হয়েছে? তাঁকে কি মাথা নত করতে হয়েছে? তাঁর সামাজিক প্রতিষ্ঠা কি সামান্যও নড়েছে? না। তিনি বরং মাথা উঁচু করে মিথ্যেচার করেছেন, কোর্টে গিয়ে আমার বিরুদ্ধে ১০০ কোটি টাকার মামলা করেছেন, হাই কোর্টকে দিয়ে আমার বই নিষিদ্ধ করিয়েছেন। সৈয়দ হক নেই, কিন্তু আমার বইটি আজও নিষিদ্ধ। বাক স্বাধীনতার পক্ষে, নারী স্বাধীনতার পক্ষে যাদের থাকার কথা, তারা সবাই সৈয়দ হককে মহান বলেছে, আর অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করেছে আমাকে। কারণ আমি মহান লোকটির কুকর্মের কথা ফাঁস করে দিয়েছি।

এই হল আমাদের পচা পুরুষতান্ত্রিক নারীবিদ্বেষী সমাজ। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একবার আমার বুকে হাত দিয়েছিলেন। আমি স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম তাঁর আচরণ দেখে। ওই কথা সোশ্যাল মিডিয়ায় জানিয়ে দেওয়ার পরও কেউ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে ছিঃ ছিঃ করেনি, করেছে আমাকে। অনেকে বুঝেছে আমি সত্যি বলেছি, কিন্তু তারপরও সুনীলের পক্ষ নিয়েছে। কারণ তারা বিশ্বাস করে, নারীকে যৌন হেনস্তা করার অধিকার পুরুষের আছে। আমার দ্বিখণ্ডিত বইটি নিষিদ্ধ করার জন্য যখন আদা জল খেয়ে লেগেছিলেন সুনীল, বলেছিলেন দুজন মানুষের মধ্যে দরজা বন্ধ থাকা অবস্থায় কী ঘটে, তা কোনওদিন বাইরে জানাতে হয় না। যেহেতু দ্বিখণ্ডিততে আমি তা জানিয়েছি, অপরাধী আমি। আর যে পুরুষেরা অপরাধ করেছে, তারা অপরাধী নয়, কারণ তারা পুরুষ। সুনীল এই মিটু আন্দোলন দেখলে কী বলতেন? পাশ্চাত্যের যে মেয়েরা, বিখ্যাত সব পুরুষেরা দরজা বন্ধ করে কী ঘটনা ঘটিয়েছিল, সেগুলো ফাঁস করে দিচ্ছে, তাদের কি গালাগালি করতেন? না করতেন না। পাশ্চাত্যের মেয়ে বলে তাদের বাহবা দিতেন, আর দেশি মেয়ে একই কাজ করলে তার মুখ বন্ধ করার জন্য, তাকে রাজ্য থেকে তাড়াবার জন্য, তার সর্বনাশ করার জন্য যা করার তাই করাকে যৌক্তিক মনে করতেন!

আমি আমার অভিজ্ঞতার কথা বলেছি। কিন্তু উপমহাদেশের যে কোনও মেয়েরই হবে একই অভিজ্ঞতা। দু’একজন রাম রহিম বা আশারাম বাপুর শাস্তি হয়, নারীর অধিকারকে মর্যাদা দেওয়া হয় বলে নয়, শাস্তি হয়, শাস্তি হলে রাজনৈতিক ফায়দা হয় বলে।

বাংলাদেশে ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে আমি সরকারি এবং জনগণের রোষানলের শিকার হয়েছি। কিছু বিখ্যাত পুরুষের অসততা আর কদর্যতা প্রকাশ করে পুরো দেশের ঘৃণা পেয়েছি। বেড়ালের গলায় ঘণ্টাটা তো বেঁধেছি আমি। তার জন্য শাস্তি তো জুটেছেই আমার, নির্বাসনের শাস্তি, বই নিষিদ্ধ হওয়ার শাস্তি। কেউ না কেউ তো কাঁটায় পা ছিঁড়ে পথটা মসৃণ করে রেখে যায়। সেই পথে এখনকার মেয়েরা হাঁটুক, মিটু আন্দোলন বাংলাদেশেও শুরু হোক। এই আন্দোলন নারী হেনস্তাকারীদের, বিখ্যাত ধর্ষকদের লজ্জা দিক, তাঁদের তো চিহ্নিত করার সময় এসেছে, তাঁদের কিছুটা হলেও শাস্তি পাওয়ারও সময় এসেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!