Thursday, December 5
Shadow

পড়ন্ত এক বিকেলে আমার ‘মেয়ে দেখা’

লেখক: আজাদ

সে দিনটাও অন্য স্বাভাবিক দিনের চেয়ে ব্যতিক্রম ছিলনা। ব্যতিক্রম কোন কিছুই হয়না, সব কিছুই স্বাভাবিক থাকে, দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতার কারণে স্মৃতিতে বেচে থাকে।

বিবাহের উপযুক্ত পাত্র তাই হন্যে হয়ে কনে খোঁজার কাজ চলমান আছে, এই কাজে কোন ফাঁকিবাজি চলেনা, বিশেষ করে মুরুব্বিদের জন্য তা মহা গুরুত্বপূর্ণ কাজ! ছেলে বড় হয়েছে তাকে বিয়ে না দিয়ে মরে গেলে উপরওয়ালার কাছে কি জবাব দিবে এই চিন্তায় তাহাদের স্বাভাবিক কাজকর্ম মূলত স্থবির।

মেয়ে দেখা সাথে ছেলেকেও দেখানোর মধ্যে একটা ফ্যান্টাসি ফ্যান্টাসি ভাব আছে।বিবাহ যে এত গুরুত্বপূর্ণ তা এতদিন কেন যে বুঝিনি তা ভেবে নিজেকে বেকুব মনে হচ্ছে।

মেয়ে দেখার একটা রুটিন তৈরি হয়ে গেল। কোন দিন কোন জায়গায় মেয়ে দেখা হবে তার একটা তালিকাও প্রস্তুত আছে। সঙ্গীদের একটা খসড়া তালিকাও ঠিক করা আছে। কনে দেখার মহাকান্ডে সঙ্গীদের আনন্দের মাত্রাটা সবসময় বেশিই থাকে অবশ্য এর সঙ্গত কারণও আছে তারা শুধু দেখবে তাদেরকে কেহ দেখবেনা, বেড়াবে, খাওয়া-দাওয়া করবে খরচের কোন বালাই নাই।

          

বরের অবস্থা এর ব্যাতিক্রম তার মাথায় সমস্ত খরচের পাশাপাশি তাকেও মেয়ে পক্ষ খুটিয়ে খুটিয়ে দেখবে। আরো কত বিড়ম্বনা তার কি শেষ আছে!

এক জায়গায় মেয়ে দেখতে গেলাম মেয়ে পক্ষ হবু জামাইয়ের গুনগান শুনে মেইন রাস্তা থেকে তার বাড়িতে যাওয়ার কাঁচা রাস্তাটাকে রাতারাতি মাটি ভরাট করে নতুন করে ফেললো। সাথে খাবার দাবার ও আদর আপ্যায়নের কোন ঘাটতি নেই। চারদিকে ধান ক্ষেত মাঝখানে দ্বীপের মত ছোট্ট একটা উচ্চ ভূমি দূর থেকে দেখলে মনে হয় ধানের সাগরের মাঝখানে একটা দ্বীপ, চারপাশে ফলফলাদির গাছে ঘেরা দুই তিনটা ঘর সমস্ত বাড়ি জুড়েই ধানের ছড়াছড়ি। বাড়িটা ও বাড়ির মানুষগুলোকে আমার যেমন পছন্দ হয়েছে আমার মায়ের পছন্দটা ছিল আরো বেশি।

নানা আমার কৃষক ছিলেন মা জন্মের পর থেকেই ধান দেখে বড় হয়েছেন। মায়ের কাছে বড় লোকের সংজ্ঞায় এমন লোক থাকতেই পারেনা যার বাড়িতে ধানের বড় গোলা নেই। জমির সাথে সম্পর্ক না থাকলে আবার বড় লোক হয় নাকি! মায়ের আগ্রহটা আমাকে খুব আকর্ষণ করেছে। মেয়ের শারীরিক সৌন্দর্য যেমনি হোক আমার মা যেহেতু পছন্দ করেছে আমি তাতে রাজি।

সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল, এদিকে ঘটক তথা আমার মেঝ চাচা তিনি আবার মেয়ের বাবার সাথে একত্রে চাকরি করেন। তিনিতো অস্থির, মেয়ে পছন্দ হল কিনা, বিয়েটা কখন হবে এসব চিন্তায় তাহার প্রেসার বাড়ার উপক্রম। খাওয়া দাওয়া শেষে এই বলে বিদায় নিলাম যে মেয়ে পছন্দের বিষয়টা আমরা পরে জানাবো। মা আমার খুবই উৎফুল্ল আমি নিশ্চিত তিনি মেয়ে দেখে নয় বাড়ির আঙিনায় ধানের স্তুপ দেখেই তাহার এমন উৎফুল্লতা।

মেয়ে আদৌ দেখেছেন কিনা এতে আমার ছোট বোন সন্দেহ পোষণ করলো, আমারও সন্দেহ একটু ছিল। সন্দেহের অবশ্য কারণও ছিল মা বারবার বলার চেষ্টা করছেন মেয়ের বাবা একজন কৃষক তাদের জমি জমা ভাল, কত ধান উঠানে ইত্যাদি ইত্যাদি। দেখতে আসলাম মেয়ে আলোচনার কেন্দ্র বিন্দু হয়ে গেল ধান। আমি তাও রাজি মা বলেছেন মেয়ে পছন্দ হয়েছে এটাই যথেষ্ট। মেয়ের বাড়ি থেকে বের হয়ে কিঞ্চিৎ অগ্রসর হওয়ার পরই সমস্ত সঙ্গীরা যার যার মতামত উতরে দিতে লাগলো। প্রথমে আমার পালা, আমি বর আমার পছন্দটাই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। মেয়ে দেখতে গিয়ে আমার মা যেমন ধান দেখেছে আমি মেয়ের পরিবর্তে মায়ের উচ্ছ্বাস দেখেছি। মূলত আমি ও মা কারোরই মেয়ে দেখা হয়নি। আমার উত্তর মা যা বলে তাই, যাহোক মায়ের দীর্ঘশ্বাস বড় একটা টেনশন থেকে এইমাত্র মুক্তি পেলেন। অন্যান্যরা ভাল মন্দে যা বললো তাতে বিয়ে হওয়া না হওয়ার জন্য বাধা হওয়ার মত বড় কোন ত্রুটি ছিলনা।

সব কিছুই ঠিক ঠাক যাচ্ছিল হঠাৎ একটা এটম বোমা ফাটলো, সর্বশেষ আমার ছোট বোন কনের মধ্যে বড় একটা ত্রুটি আবিষ্কার করে বসলো ‘মেয়ে যে থ্রি পিছ পড়েছে তার সেলোয়ারের সাথে কামিজের মিল নেই’ তার মতামত ওকে বিয়ে করলে মানুষ করতেই বহু বছর ব্যয় হবে।মহা মুসিবত তাতো আমি খেয়াল করিনি। সাথে সাথে আমার সাথের নারী সঙ্গীরাও তার সাথে তাল মিলিয়ে ফেললো তাদেরও অভিমত তারাও কিছু একটা বৈসাদৃশতা দেখেছিল কিছু একটা গড়মিল মনেও হচ্ছিল এবং তা বের করার চেষ্টাও করেছিল কিন্ত তারা তখন ঠিক অনুধাবন করতে পারেনি। এতে আরো বড় বিপত্তি দেখা দিল যারা হ্যাঁ-না এর মাঝামাঝি ছিল তারা না এর পক্ষে মতামত দিয়ে দিল। পড়ে রইলাম আমি আর আমার মা, মা তো পারলে আমার ছোট বোনকে খুনই করে ফেলে, কেন সে সামান্য একটা বিষয়কে দেখে বা মায়ের অনুমান ভুল দেখেই এমন ভাঙানি দিচ্ছে। মায়ের চেহারায় রাজ্যের ছাপ! সব কিছুই অনুকূল ছিল শুধু ছোট বোনের এমন আচরণ মা মেনে নিতে না পেরে রাস্তার মধ্যেই তাকে কয়েক ঘা দিতে পারলেই মনে শান্তি পায় এমন ভাব। জনতার নেগেটিভ মন্তব্য এবং আমার না বলা কথার সারমর্ম বুঝে মা আমার নির্বাক।

রক্তবন্দি

চলে যাচ্ছিলাম আমার আরেক বোন অনেক দিন থেকেই একটা মেয়ের কথা বলছিল, নানা কারণে আমাদের তেমন আগ্রহ ছিলনা, এবার তার কৃতিত্ব জাহির করার পালা, ভাল মেয়ের সন্ধান দেয়া চাট্টিখানি কথা নয়, এর জন্য দূরদৃষ্টি থাকা আবশ্যক।

ভাবলাম এসেই যখন পড়েছি আর ঐ মেয়ের বাড়ি যখন একই রাস্তায় তখন একটা ঢু মেরে দেখে যাই যদি, মেয়েকে আন অফিসিয়ালি একটু দেখা যায়, মন্দ কি চেষ্টা করেই দেখি। আমার সাথে থাকা ছেলে সঙ্গীদেরও একই মত। এতে একটু পুরুষত্ব ভাব থাকে। চুরি করে মেয়ে দেখার মজাই আলাদা। এবার নাট্যমঞ্চে ঘটকের উৎসাহ বেরে গেল সে হন হন করে আগ্রভাগে চলমান আমরা তার পিছনে তাকে ফলো করছি। সাথে বড় আপাসহ অন্যান্যরাও আছে।

তখন পড়ন্ত বিকাল তাহার বাসার সামনে পৌঁছামাত্রই দেখি,ওমা! সে কি! মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি সে ঘরের সামনে গোলাপি রঙের থ্রি পিছ পড়ে তার ছোট বোনের সাথে দুষ্টামি করছে! যেমন চেহারা তেমনি ম্যাচিং করে পোষাক পড়া, (ম্যাচিং পোশাক এখন আবশ্যিক বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। অন্য ত্রুটি মার্জনীয় কিন্ত পোশাকের বৈসাদৃশ্যতা অগ্রহণযোগ্য।) খোলা চুল আকর্ষণীয়…! একেবারে প্রথম দেখাতেই হৃদয়ে গেঁথে যাওয়ার মত অবস্থা।

তাহার সে চঞ্চল চাহনি, হেলে দুলে সিঁড়ি বেয়ে উঠা, খোলা চুলের সাথে পড়ন্ত বিকালের সোনালি সে আলো একাকার হয়ে আমাকেও আলোকিত করে তুললো। এরই মধ্যে অনেক সময় কেটে গেছে কিন্ত পড়ন্ত বিকালের সোনালি আভায় তাহার গোলাপি পোশাকে খোলা চুলে হেলে দুলে সিঁড়ি বেয়ে উঠার দৃশ্য যেন একাকার হয়ে সেই মিশ্রিত সেই আলো আমার দেহের পঞ্চ ইন্দ্রিয় ছেঁদ করে হৃদয়ে ভর করেছিল। কত দৃশ্য দেখছি, ভাল-খারাপ, দুঃখ-কষ্টের! কত কিছুই ভুলে গিয়েছি।
বেচে আছে তোমাকে দেখার সেই পড়ন্ত বিকালের স্মৃতি!

লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ: mdabulkalamazad21@yahoo.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!

error: Content is protected !!