class="post-template-default single single-post postid-10433 single-format-standard wp-custom-logo group-blog vl-boxed aa-prefix-matin-">
Shadow

প্রোফেসর শঙ্কু যুগ যুগ জিও

শঙ্কু৫০ বছর ধরে দেখতে একই রকম আছে লোকটা। সত্যজিৎ রায় ১৯৬১ সালে তৈরি করেছিলেন চরিত্রটি। ছাপা হয়েছিল সন্দেশ পত্রিকায়। টাক মাথার গোলচোখের লোকটির নাম প্রোপেসর শঙ্কু।

চীনা জাদুকর চী-চিং প্রোফেসর শঙ্কুর ল্যাবরেটরিতে ঘুরে যাওয়ার পরই ঘটতে শুরু করল আজব সব ঘটনা। এক সকালে শঙ্কু অবাক হয়ে দেখলেন, তাঁর এসিডের একটি বোতল অর্ধেক খালি। অথচ গত রাতেও গোটা বোতলটাই এসিডে ভরপুর ছিল। এদিকে, গবেষণাগারে দীর্ঘদিন ধরে বসতি গাড়া টিকটিকিটার আকার যেন বেড়ে গেছে হঠাৎ করেই, সেই সঙ্গে বদলেছে চেহারাও। চোখের মণি হলদে হয়ে গেছে ওটার। সারা গায়ে লাল লাল চাকা। তারপর শঙ্কুর চোখের সামনেই টিকটিকিটা লাফ দিয়ে নেমে এসে এসিডের বোতল থেকে এসিড খেতে লাগল। এভাবে দেখতে দেখতে দুটো বোতল খালি করে ফেলল ওটা। আর পরিণত হলো তিন হাত লম্বা চীনা উপকথার এক ড্রাগনে। শঙ্কু তাঁর ভয়ঙ্কর অস্ত্র ইলেক্ট্রিক পিস্তলের শকেও কিছু করতে পারলেন না ড্রাগনটার। উল্টো ওটার নাক থেকে বেরিয়ে আসা বিষাক্ত ধোঁয়ায় নিজেই জ্ঞান হারালেন। তবে জ্ঞান ফেরার পর আবিষ্কার করলেন, পুরো বিষয়টাই আসলে চীনা জাদুকর চী-চিংয়ের কারসাজি। চার বছর আগে ভরা মজলিসে শঙ্কুকে সম্মোহন করতে ব্যর্থ হয়ে এবার বাড়িতে এসে সম্মোহন করে এর প্রতিশোধ নিয়ে গেছেন চী-চিং। এমনই আশ্চর্য আর অদ্ভুত সব কাণ্ড-কীর্তিতে ঠাসা প্রোফেসর শঙ্কুর কাহিনী।
এবার দু-চার কথায় জেনে নেওয়া যাক প্রোফেসর শঙ্কু আসলে কে। স্কটিশ চার্চ কলেজের অধ্যাপক শঙ্কুর পুরো নাম ক্রিলোকেশ্বর শঙ্কু। পদার্থবিজ্ঞানী হলেও বিজ্ঞানের সব শাখায়ই তাঁর বিচরণ। ৬৯টি ভাষা জানেন এই আÍভোলা কিন্তু অসমসাহসী মানুষটি। সুইডিশ একাডেমী অব সায়েন্স সম্মানিত করেছে তাঁকে। ব্রাজিলের রাটানটান ইনস্টিটিউট থেকেও পেয়েছেন ডক্টরেট। দারুণ বুদ্ধি তাঁর। তাই তো পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের শত্র“রা প্যাঁচ কষেও খুব একটা সুবিধা করতে পারে না প্রোফেসর শঙ্কুর সঙ্গে।
প্রোফেসর শঙ্কুর কাহিনী আমরা পাই তাঁর ডায়েরি থেকে। শঙ্কু এখন কোথায়? এই প্রশ্নের উত্তর সঠিকভাবে জানে না কেউই। কেউ বলে, বিপজ্জনক একটি পরীা চালাতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। আবার শোনা যায়, অজ্ঞাত কোনো স্থানে গা-ঢাকা দিয়ে গবেষণার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। শঙ্কুর প্রথম কাহিনীতে আমরা দেখি, শঙ্কুর ডায়েরি পাওয়া যায় তারক চাটুজ্যে নামের এক লোকের কাছ থেকে। সুন্দরবনের মাথারিয়া নামের একটি স্থানে উল্কাপাত হয়েছে শুনে সেখানে ছুটে যান তারক রায়। উদ্দেশ্যÑউল্কাপাতে মারা পড়া বাঘের দু-চারটা ছাল হাতিয়ে নেওয়া। কিন্তু এর বদলে পেলেন গোসাপের ছাল আর গর্তের মধ্যে একটি লাল খাতা। ওল্টাতেপাল্টাতেই বোঝা গেল, ওটা আসলে প্রোফেসর শঙ্কুর ডায়েরি। আর ওটাই ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়রি’ নামে ছাপা হয়। তাহলে এখন নিশ্চয়ই জিজ্ঞেস করবে, ডায়েরি যদি একটাই পাওয়া গেল, তাহলে এত এত কাহিনী আসছে কিভাবে? আরে, শঙ্কুর প্রথম ডায়েরি পাওয়ার পরই যে অনেক খোঁজাখুঁজি করে গিরিডিতে তাঁর বাড়ির হদিস পাওয়া যায়। সেখানে তাঁর কাগজপত্র, গবেষণার সরঞ্জামের সঙ্গে পাওয়া যায় ২১টি ডায়েরি। আর এগুলোর বদৌলতেই আমরা শঙ্কুর এত এত মজার কাহিনী পেয়ে গেছি। অবশ্য গল্পের খাতিরে এই ডায়েরির কাহিনী ফাঁদা, আসলে সব কাহিনী এসেছে সত্যজিৎ রায়ের মাথা থেকে। প্রোফেসর শঙ্কুকে নিয়ে মোট ৪০টি কাহিনী লিখেছেন সত্যজিৎ রায়। এর মধ্যে ৩৮টি সম্পূর্ণ এবং দুইটি অসম্পূর্ণ।
প্রোফেসর শঙ্কুর গবেষণাগার বিহারের গিরিডি শহরে। সার্বণিক সঙ্গী চাকর প্রহাদ আর নিউটন নামের একটি পোষা বিড়াল। প্রতিবেশী অবিনাশ চট্টোপাধ্যায় নামের এক ভদ্রলোক। তিনি আর নকুড় বাবু নামের শঙ্কুর এক ঘনিষ্ঠ মানুষকে কখনো কখনো অভিযানে বেরোতে দেখা যায় তাঁর সঙ্গে। কখনো আবার শঙ্কুর সঙ্গী হিসেবে আমরা পাই তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু সন্ডার্স-ক্রোলদের। শঙ্কুর এই অভিযানগুলো টানটান উত্তেজনা আর নাটকীয়তায় ভরা। কাজেই সত্যজিৎ রায়ের প্রোফেসর শঙ্কুর কাহিনীগুলোকে শুধু কল্পবিজ্ঞান নয়। এর সঙ্গে মিশে আছে ভ্রমণ, রহস্য আর অ্যাডভেঞ্চার। যেমনÑএকবার জাপানি বিজ্ঞানী হামাকুরা আর তানাকার সঙ্গে লাল রঙের অদ্ভুত এক মাছের খোঁজে সাগর অভিযানে বের হলেন প্রোফেসর শঙ্কু। সঙ্গে আছেন অবিনাশ বাবুও। তাঁরা চলেছেন হামাকুরার আবিষ্কৃত সাবমেরিনে করে। কাহিনীর একপর্যায়ে অবাক হয়ে আবিষ্কার করলেন, এই লাল মাছ আসলে ভিন গ্রহের প্রাণী। সমুদ্রে বাস করবে বলেই এখানে আস্তানা গেড়েছিল এরা। কিন্তু এসে দেখল, এখানকার পানি তাদের থাকার ঠিক উপযোগী নয়। তাই তাদের স্পেসশিপ নিয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে যায় আজব ভিন গ্রহবাসীরা। আরেকবার দেখা গেল, লন্ডনের এক নিলাম থেকে শঙ্কুর বন্ধু ক্রোল ত্রয়োদশ শতাব্দীর এক পাণ্ডুলিপি কিনেছেন। ওই পাণ্ডুলিপিতে আছে স্বর্ণ তৈরি করার কৌশল। পাণ্ডুলিপির নিয়ম অনুসরণ করে স্বর্ণ তৈরি করতে গিয়ে শঙ্কু, স্যান্ডার্স আর ক্রোল জড়িয়ে পড়েন দারুণ এক অ্যাডভেঞ্চারে।
কখনো আবার বিপজ্জনক সব শত্র“র মুখোমুখি হতে হয় প্রোফেসর শঙ্কুকে। একবার শঙ্কুর এক নকল গজিয়ে গেল। শঙ্কুর পরিচয় দিয়ে বিজ্ঞান সম্মেলনগুলোতে বক্তৃতা করে পৃথিবীবিখ্যাত বিজ্ঞানীদের সম্পর্কে যা-তা বলে বেড়াতে লাগল। সবাই ধরে নিল, কাণ্ডটা শঙ্কুর। কাহিনীর এক পর্যায়ে তরুণ প্রতœতাত্ত্বিক প্রোফেসর ফিংকেলস্টাইনকে খুনের অভিযোগে ফেঁসে যাওয়ার অবস্থা হলো শঙ্কুর। শেষ পর্যন্ত বন্ধু সামারভিলের সহায়তায় এই বিপদ থেকে উদ্ধার পান। জানা গেল, গ্রোপিয়াস নামের অন্য একজন বিজ্ঞানী তার তৈরি করা রোবটকে শঙ্কু সাজিয়ে কাণ্ডটি ঘটিয়েছে।
প্রোফেসর শঙ্কুর অনেক অদ্ভুত আবিষ্কারের সঙ্গেই পরিচয় হয় আমাদের। আর আবিষ্কারগুলোর নামেরও কী বাহার! অ্যানাইহিলিন, মিরাকিউরল, নার্ভিগার, অম্নিস্কোপ, øাফগান, ম্যাঙ্গোরেঞ্জ, ক্যামেরাপিড, লিঙ্গুয়াগ্রাফÑআরো কত কী! এদের মধ্যে কোনোটা ওষুধ, কোনোটা যন্ত্র, আবার কোনোটা ভয়ানক অস্ত্র। লিঙ্গুয়াগ্রাফের কথাই ধরো, কোনো ভাষার কথা রেকর্ড হয়ে তিন মিনিটের মধ্যে তার বাংলা অনুবাদ ছাপা হয়ে বেরিয়ে আসে এতে। এমনকি শঙ্কুর পোষা বিড়াল নিউটনের ‘ম্যাও’য়ের পর্যন্ত বাংলা অনুবাদ বের করে দেয় লিঙ্গুয়াগ্রাফ। আর অম্নিস্কোপ নামের চশমাটা একই সঙ্গে টেলিস্কোপ, মাইক্রোস্কোপ আর এক্স-রের কাজ করে। অ্যানাইহিলিন অস্ত্রটা দিয়ে লেসার রশ্মি ছুড়ে কোনো প্রাণী বা বস্তুকে বেমালুম গায়েব করে দিতে পারবে। তোমাদের যাদের খাওয়া-দাওয়া না করার জন্য মায়ের বকুনি খেতে হয়, তারা প্রোফেসর শঙ্কুর বটিকা ‘ইন্ডিয়া’ পেলে লুফে নিতে। এর একটা বড়ি খেলে সারা দিন আর কিছুই খেতে হয় না।
আচ্ছা, শঙ্কু চরিত্রটি এসেছে কিভাবে? এটা কি সত্যজিৎ রায় এমনি এমনি তৈরি করে ফেললেন, নাকি অন্য কোনো চরিত্র কিংবা বাস্তবের কোনো মানুষের প্রভাব আছে এর পেছনে? সত্যজিৎ রায় এক সাাৎকারে বলেছিলেন, বাবা সুকুমার রায়ের ‘হেসোরাম হুঁশিয়ারের ডায়রি’ গল্পটি প্রেরণা জুগিয়েছে তাঁকে শঙ্কু চরিত্রটি সৃষ্টিতে। আবার কেউ কেউ মনে করেন, সুকুমার রায়ের ‘নিধিরাম পাটকেল’ চরিত্রটির ছায়া আছে এর মধ্যে। তবে যেভাবেই শঙ্কুর জš§ হোক না কেন, টাক মাথার এই ভদ্রলোক আর তাঁর ফাটাফাটি সব কাহিনী কিন্তু ৫০ বছর ধরে আমাদের মাতিয়ে যাচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!