Thursday, April 18
Shadow

হাসান মাহামুদের গল্প : একই ছাদের তলে বিভক্তির মঞ্চায়ন

হাসান মাহমুদের

হাসান মাহমুদের গল্প :  একই ছাদের তলে বিভক্তির মঞ্চায়ন
হাসান মাহামুদ

বিদ্যুৎ নেই অনেক ক্ষণ হয়েছে। আসার যেন নামও নেই। আইপিএসের লাইনে টিউবলাইট জ্বলছে, তাই বিদ্যুতের অভাব খুব একটা বুঝছে না আদ্রিতা। মায়ের পাশে খাটে উপুড় হয়ে শুয়ে শুয়ে হোমওয়ার্ক করছে সে। কিন্তু সময় কাটছে না এলিনের। টেলিভিশন বা সিডি প্লেয়ার চলছে না। তার উপর বিকেল থেকে বিচ্ছিরি রকম এক বিরক্তি ছেয়ে আছে তাকে। সবকিছুতেই কেমন যেন এক সহ্যহীন অস্থিরতা।
এই সময়টা প্রতিদিন একা একাই কাটে এলিন আর আদ্রিতার। কাউন্সিলর হওয়ার পর থেকে রাত ১২টার পর বাসায় ফেরা মাহতাবের নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুপুরে খাওয়ার পর দুতিন ঘন্টা ঘুমায়। এরপর বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত অফিসেই থাকে। ঠিকাদারির কাজ চালিয়ে নেয়ার সুবিধার্থে নেয়া হলেও এখন সব কাজের ঠিকানা পুলপারের অফিসটি। সন্ধ্যা নাগাদ ব্যবসায়িক কাজ শেষ হয় তার। পরের সময়টা নেহাত অপচয়। অবশ্য বাসায় ফেরার টানও নেই তার। এর মধ্যে বিকেলের ঘটনা ঘরবিমুখ মাহতাবকে আরো বেশি টানহীন বানিয়েছে।
হঠাৎ বিদ্যুৎ আসাতে টেলিভিশন নিজে থেকে অন হয়ে জোরে মিউজিকের করে। সম্বিত ফিরে টেলিভিশনের দিকে তাকায় এলিন। ভারতীয় চ্যানেল ‘লাইফ ওকে’তে ‘সাবধান ইন্ডিয়া’ প্রোগ্রামটা শেষ হওয়ার মিউজিক বাজছে। এলিন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত ১০টা ৫৮ বাজে। রিমোর্টটি হাতে নিয়ে টেলিভিশন মিউট করে আদ্রিতার দিকে তাকায়। সে খাতার উপর মাথা রেখেই ঘুমিয়ে গেছে। হাত থেকে রিমোর্টটি রেখে আদ্রিতাকে বালিশে এনে শুইয়ে দিয়ে কপালে, মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় এলিন। মেয়েটা আজ কিছু না খেয়েই ঘুমিয়ে গেছে। ঘুমন্ত অবস্থায় আদ্রিতার কপালে চুমু খায় এলিন। ঘুমের মধ্যেই যেন হেসে ওঠে আদ্রিতা। দেখে, এলিন হেসে ওঠে শুয়ে আদ্রিতাকে বুকে নেয়। আদ্রিতাকে জড়িয়ে শুয়ে মুখে আবার চুমু খায়। এক পর্যায়ে মা-মেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
রাত সাড়ে ১২টার দিকে কলিং বেল বাজে। বেশ কয়েকবার বেল বাজার পর এলিনের ঘুম ভাঙ্গে। কিন্তু কেমন যেন ঘোর ঘোর লাগে এলিনের। শরীর সায় দেয় না উঠে বসতে। হঠাৎ ঘুম ভাঙলেই পছন্ড মাথা ব্যথা করে তার। এখন তা হচ্ছে। তবুও তাকেই দরজাটা খুলে দিতেই হবে। যদিও আজ তিনদিন হলো মাহতাবের মা মানে তার শাশুড়ি এসেছেন। সন্ধ্যার কিছু সময় পর রাতের খাওয়া সেরে ওপাশের রুমে শুয়ে আছেন। জেগে থাকলেও দরজা খুলেন না তিনি। এলিন দরজা খুলে মাহতাবকে খেতে দিলে শোয়া থেকে উঠে টেবিলে এসে ছেলের সঙ্গে কথা বলেন।
প্রতিদিনের মতো আজও মাথা ব্যথা নিয়ে দরজা খুলে এলিন। মাহতাবকে দেখে কোনো কথা না বলে রান্না ঘরের দিকে যায় সে। আলো এড়িয়ে রান্না ঘরের দিকে পা বাড়ায় সে। মাহতাব দরজা আটকাতে আটকাতে বলে, ‘খেয়ে এসেছি, খাব না’। এলিন কোনো কথা না বলে আবার রুমে ফিরে আসে।
প্রতিদিন রাতে মাহতাবকে টেবিলে খেতে দিয়ে এলিন নিজের প্লেট নিয়ে রুমে আসে। কিন্তু মাহতাব যেদিন বাইরে খেয়ে আসে সেদিন আর এলিনের খাওয়া হয় না। আজ অবশ্য দুপুর থেকেই কিছু খায়নি সে। রাতেও খেতে ইচ্ছে করেনি। সকালে রাতের সব তরকারি বুয়া নিয়ে যাবে। কারণ এই বাসায় প্রতিদিন নতুন করে রান্না করতে হয়।
রুমে এসে ড্রয়ার খুলে মাথা ব্যথার ঔষধ হাতে নেয় এলিন। কি যেন মনে করে সবগুলো ট্যাবলেট বাসকেটে ফেলে দেয়। এরপর লাইট অফ করে শুয়ে পড়ে। মাথা ব্যথাটা তার অনেক পুরনো। একটু অনিয়ম হলেই নোটিশ ছাড়া হাজির হয়। অনেক ডাক্তার দেখানো হয়েছে, সিটি স্ক্যানও করা হয়েছে, কিছুই ধরা পড়েনি। তবে ডাক্তার বলেছে, চুলার আগুন ও আলো থেকে দূরে থাকতে, নিয়মিত গ্লাস পড়ে থাকতে, ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটাতে আর শারিরীক চাহিদার প্রতি নজর রাখতে। কিন্তু নিয়মিত গ্লাস পড়ে থাকা ছাড়া আরো কোনোটাই মেনে চলা তার পক্ষে সম্ভব হয় না। কারণ বুয়ার হাতের রান্না খায় না মাহতাব, তাকেই রান্না করতে হয়। আদ্রিতাকে স্কুল এবং প্রাইভেটে আনা-নেয়া দুটো দায়িত্বই এলিনের। তাই রোজ গুনে গুনে ছয়বার বাইরে যেতে হয় তার। এক্ষেত্রে অনেক সময় গ্লাসও ঠিক মতো পড়া হয় না। বিয়ের মাত্র দেড় বছরের মাথায় বিশেষ একটি ঘটনার পর তারা আলাদা রুমে ঘুমায়। তাই গত চারবছরে শারিরীক চাহিদার বিষয়টি অ-উপস্থাপিতই থেকে গেছে তাদের। মাহতাব মাঝে মধ্যে আকারে ইঙ্গিতে কিছু বুঝাতে চাইলেও এলিন বিষয়টি পৃথিবীর সবচেয়ে তুচ্চ কাজ হিসেবে গণ্য করা শুরু করেছে অনেক আগেই।
এলিনের ঘুমের দিকে লক্ষ্য রাখতে ডাক্তার মাহতাবকেই বেশি করে বলেছিল, অথচ মাহতাবই ইচ্ছা-অনিচ্ছার স্বভাবে এলিনের ঘুমের বিঘœ করে প্রতিক্ষণে। প্রথম প্রথম এসব বিষয়ে দুজনে যুক্তিতে গেলেও, ইদানিং সব ব্যাপার যেন অলিখিত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। পরিবর্তনের মানসিকতায় এখন আর কেউ আগ বাড়িয়ে আলোচনায় যায় না তাই। এলিনের কাছে জীবনটা হয়ে গেছে, অচেনা দৌড়বিদদের অজানা জীবনপঞ্জির ওপর অহেতুক সম্ভ্রম নিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টার মতো। আর মাহতাবের ক্ষেত্রে তা হয়েছে, সরকারি অফিসের চতুর্থ শ্রেণির আধকানা কেরানির মতো; যে রুটিনের বাইরে পৃথিবীর আলো-বাতাসের খবরও রাখে না। যদিও এই আধকানা স্বভাবটা জগত সংসারে শুধুমাত্র এলিনের জন্য। পৃথিবীর সকল প্রাণীর কাছে, এমনকি বাকী পার্থিব সকল ক্ষেত্রে মাহতাবের তুলনা পাওয়া দায়। মায়ের সংসারে সাপ্তাহিক বাজার, ছোট ভাইদের অগণিত চাওয়া, বড় ভাই-ভাবীর অন্যায় আবদার, বাসার সামনের দর্জি-দোকানীর অবহেলায় মশকারির বায়না, বন্ধু মামুনের বৌয়ের ইনিয়ে বিনিয়ে বানানো গল্পের ঝুলির ফাঁকে ফাঁকে উপস্থাপন করা প্রয়োজন, এসবের কিছুই অপূর্ণ রাখে না মাহতাব। অবশ্য এলিনকেও বেশ প্রাচুর্য্যে রেখেছে সে। বাসায় কোনো কিছুর অভাব রাখেনি, নিজেকে দুর্বোধ্য মানুষ বানিয়ে রাখা ছাড়া। যদিও এলিনের সংসারে তার বাবা-মায়ের অবদান কখনোই অস্বীকার করার উপায় নেই। বিশেষ করে তিন ভাইবোনের মধ্যে এলিনই মায়ের সবচেয়ে আদরের। তাই মেয়ের সুখের কোনো রকম ঘাটতি তিনি রাখেননি। একমাত্র এলিন আর মাহতাবের বিষয়টি সমাধান করা ছাড়া।
জীবনের শুরুটা তাদের এমন ছিল না। এলিনের বাবা রাহাত সাহেবের বড় ভাইয়ের মেজ ছেলে মাহতাব। পারিবারিক ভাবে কেউই অত ধনী ছিল না। শিক্ষিত, মাার্জিত রাহাত সাহেব বিয়ের পর বিদেশ পাড়ি দেয়। সেখানে গিয়ে অল্প কয়েক মাসের মধ্যেই ভাগ্য ফেরে তাঁর। এরপর গাড়ি-বাড়ি সব হয়েছে। বড় ভাইয়ের বিএ পাশ ছেলে মাহতাব শুরু থেকেই প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বাসনায় চাচার কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করতো। এক সময় চাচা তাকে ব্যবসা শুরু করার টাকা দেয়। মোটামুটি চালাক প্রকৃতির মাহতাব চাচার টাকায় কয়েক বছরের মধ্যে নিজের একটি অবস্থান তৈরি করতে সমর্থ হয়। তখন এলিনকে বিয়ে প্রস্তাব দেয় মায়ের মাধ্যমে। রাহাত সাহেবও এতে রাজি হয়। এলিনের মায়ের আপত্তি সত্ত্বেও এসএসসি পড়–য়া এলিনের সঙ্গে মাহতাবের বিয়েটা হয়। শুরু থেকে ঠিক থাকলেও বিয়ের অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই মাহতাবের বহুগামিতার বিষয়টি এলিনের চোখে ধরা পড়ে। সহজ-সরল এলিন বিষয়টিকে তেমন আমল দেয়নি শুরুর দিকে। কিন্তু বিয়ের মাত্র দেড় বছরের মাথায় এক সন্ধ্যায় নিজেদের বাসার খোলা ছাদে স্বামীকে তার একমাত্র খালাতো বোনের সঙ্গে আপত্তিকর অবস্থার চূড়ান্ত পর্যায়ে আবিষ্কার করে এলিন। তিনজনের চোখাচোখির পর মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গেছিল এলিন। যদিও কাউকে বিষয়টি জানায়নি সে। শুধু এ ঘটনার পর মাহতাবের সঙ্গে রুম ভাগ করে নিয়েছে। সেই থেকে আজ অবধি চলছে একই ছাদের নিচে চলছে বিভক্ত সংসারের মঞ্চায়ন।
অনেক আগেই এলিন ঠিক করে নিয়েছে, কত মেয়ের তো বিয়ের কয়েক মাসের মধ্যে স্বামী মারা যায়। তারা কি জীবনের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকছে না? সে পারবে না কেন?
রাহাত সাহেবের পুঁজিতে মাহতাব এখন শহরের বড় ব্যবসায়ী। তার জীবনে অর্জনের অন্ত নেই। যেই কাজে হাত দিয়েছে, সেই কাজই যেন আর্শিবাদ হয়ে ধরা দিয়েছে। মহল্লায় রাহাত সাহেবের সম্মান, মাহতাবের কিঞ্চিত জনপ্রিয়তা আর সর্বোপরি ভোটে এলিনের একনিষ্ঠ শ্রমের ফলস্বরূপ সে এখন কাউন্সিলরও হয়েছে। এতো এতো অর্জন সত্ত্বেও বিয়ের এতো বছরেও এলিনের মন জয় করা হয়নি তার। যদিও এ কাজে তার নেহাত কোনো আগ্রহ কখনও ছিল না। ড্রয়িং রুম, বেড রুম কিংবা পুরো বাসায় দুজনের একসঙ্গে ছবিও নেই তাদের। ভোটের পরের সপ্তাহে সারাদেশের মেয়র-কাউন্সিলর প্রতিনিধিদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত অনুষ্ঠানে এলিন-আদ্রিতাও এসেছিল। একটি দৈনিকের এক ফটোগ্রাফারের অতি আগ্রহে মেয়েকে কোলে নিয়ে ছবি তুলেছিল মাহতাব। প্রধানমন্ত্রীর কোলে বসে আদ্রিতার তোলা ছবি এলিনের রুমে বড় করে বাঁধা হয়েছে। সেদিন অনেক বলেও রসিক ফটোগ্রাফার মাহতাব ও এলিনের একটি যুগল ছবি তুলে দিতে পারেনি। মাহতাব সম্মতির আশায় দুয়েকবার এলিনের দিকে আমন্ত্রণপূর্বক চাহনিতে তাকালেও চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিল সে।
কোনো এক দূর্বল ক্ষণের সিদ্ধান্তহীনতার কারণে এলিনের জীবনে প্রেম এসেছিল। এটাকে ঠিক প্রেম বলা যাবে না, অনেকটা মোহ বলা চলে। বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া এক শান্ত স্বভাবের ছেলেকে তার ভাল লাগে। মোবাইলেই সীমাবদ্ধ ছিল তাদের আলাপ। কখনো সাহস নিয়ে এগিয়ে এসে কারো দেখা করা হয়ে উঠেনি। কয়েকটি দিন তার ভালই কাটছিল। দেখা না হলেও তারহীন তরঙ্গের কথোপকথনে যেন কিছুক্ষণের জন্য জীবনটাকে ভুলে থাকা যেত। ছেলেটি তাকে এ জীবন থেকে মুক্তি দিতে চেয়েছিল। কিন্তু সম্বিত ফিরে আসার পর এলিন নিজেই ফিরিয়ে দিয়েছিল ভাল লাগা-মন্দ লাগার সঙ্গী হতে আগ্রহী ছেলেটিকে। তারপর থেকে আবারো রুটিনের জীবনে ফিরে আসে এলিন। হয়ত প্রাত্যহিক রুটিন ভঙ্গ করার অভিপ্রায় কখনো ছিল না বলে জীবনের গন্ডি আর বাড়েনি তার।

প্রচ- মাথা ব্যথার কারণে রাত চারটে নাগাদ ঘুম আসে না এলিনের। প্রচ- শীতের রাতেও শরীর ঘেমে উঠে। অস্থিরতা থেকে এমন হচ্ছে, সে বেশ বুঝতে পারে। দেড়টার দিকে বিছানা ছেড়ে উঠে বারান্দায় এসে বসে সে। ঘুম না আসলে এলিন প্রায়ই লাইট অফ রেখে বারান্দায় গিয়ে ইজি চেয়ারে বসে থাকে। এই অভ্যাসটা তার গত ছয় বছরের। শীতের দিনে ঠান্ডায় হাত পা হীম হয়ে আসলে কোনো রকমে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ে। এরপর সকাল পর্যন্ত একটানা অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকে। আদ্রিতার মর্নিং শিফটে ক্লাস থাকে বলে শুক্রবার ছাড়া সপ্তাহের বাকি কয়টা দিন ভোর ছ’টায় জাগতে হয় তাকে। রাতে ঘুম হোক বা না হোক, কিংবা জেগে ওঠা পর্যন্ত অজ্ঞান থাকুক। জেগে প্রথমে আদ্রিতার নাশতা বানাতে হয়। এরপর মাহতাবের জন্য নাশতা বানিয়ে টেবিলে রেখে আদ্রিতাকে জাগায়। আদ্রিতাকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে ফিরতে ফিরতে বুয়া আসে। এলিনের কাছ থেকে শুনে কাজ শুরু করবে এই বায়নায় একটি দিনেও বুয়ার কাজ শুরু হয় না। এর মধ্যে মাহতাব ঘুম থেকে জেগে ওঠে। প্রথম প্রথম বুয়াকে আগের দিন আগামী দিনের কাজ বুঝিয়ে দিত এলিন। কিন্তু পরদিন ঠিকই এলিনের আসার পর কাজে হাত দেয় বুয়া। তাই এখন সকালে বুয়ার কাজ ফেলে বসা থাকাকে কোনো বিষয় মনে করে না এলিন। আর নাশতা কেন, কোনো ব্যাপারেই মাহতাবকে কোনো কথা বলে না সে। স্কুল থেকে ফিরে এসে প্রতিদিনই মাহতাবের নাশতা গরম করতে হয়। কোনো এক বিশেষ কারণে বেশিরভাগ দিনেই মাহতাবের নাশতা করা হয় না। তবুও মাহতাবের ইচ্ছামাফিক, প্রতি সকালে নাশতা বানিয়ে রেখেই বের হতে হয় এলিনকে। এরপর বুয়াকে দিনের কাজ বুঝিয়ে দিতে হয়। কোনো রকম প্রতিবাদ ছাড়াই রোজ একই কাজ করে সে। এরপর মাহতাব হাঁটতে বের হয়। আর নাশতা না করেই একটু ঘুমায় এলিন। হেঁটে মাহতাব যখন বাসায় ফেরে তখন বেশির ভাগ সময়ে এলিন আদ্রিতাকে স্কুল থেকে আনতে বেরিয়ে যায়। ফিরে আসতে আসতে মাহতাব বাইরে চলে যায়। এভাবেই চলতে থাকে দুজন খুব পরিচিত মানুষের সম্পূর্ণ অপরিচিত দাম্পত্য জীবন।
মাথা ব্যথাটা বিচ্ছিরি রকম ভাবে বাড়তে থাকে। শুয়া থেকে উঠে বসে এলিন। ওয়াশরুমে গিয়ে মুখে, মাথায় পানি দেয়। ফ্রিজ থেকে শীতের মধ্যেই ঠান্ডা পানি বের করে খায়। এরপর বারান্দায় গিয়ে চেয়ারে বসে পড়ে।
আজকের রাতটা অনেক বড় মনে হয় এলিনের। কিছুতেই সময় কাটতে চায় না তার। চেয়ারে বসে বসে চিন্তার রাজ্যে হারিয়ে গেছে বেশ কয়েকবার, আর ঘাড় ঘুরিয়ে কিছুক্ষণ পর পর ঘুমন্ত আদ্রিতাকে দেখেছে। চারটার দিকে যখন ভোরের আলো কিছুটা ফুটতে শুরু করে, তখন উঠে বিছানায় আসে এলিন। আদ্রিতা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। এলিন শুয়ে মাতৃ¯েœহে আদ্রিতাকে বুকে টেনে বেশ কয়েকটা চুমু খায়। এরপর চোখ বন্ধ করে।
কাউন্সিলর হিসেবে বিচার-শালিস করতে গিয়ে অবলা মেয়ে-মহিলাকে জড়িয়ে মাহতাবের অনেক আজেবাজে রটেছে এর মাঝে। এলিন কখনো ওসব গায়ে মাখেনি। কিন্তু আজ মাহতাবের বন্ধু মামুন নিজে অভিযোগ করে গেছে, ‘ব্যবসায়িক কাজে বাসার বাইরে থাকায় গত দুদিনে মাহতাব তার বাসায় গিয়েছিল।’ বন্ধুর বাসায় কেউ যেতেই পারে- এই ভেবে এলিন গায়ে মাখেনি বিষয়টি। কিন্তু বিকেলে স্বপন জানিয়েছে, বিষয়টি নিয়ে পুলপারে বড় আকারের শালিসে মামুনের স্ত্রীর সঙ্গে মাহতাবের লুকানো নোংরা সর্ম্পক জানাজানি হয়েছে। এমনকি মাহতাব-এলিনের রুম বিচ্ছেদের বিষয়টিও সেখানে আলোচনা হয়েছে মামুনের বৌ সবার সামনে উপস্থাপন করার পর। শালিসে এলিন সর্ম্পকেও আলোচনা হয় বলেও জানায় স্বপন। কথাগুলো শুনার পর এলিনের কোনো অভিব্যক্তি ছিল না। কিন্তু সন্ধ্যার পর মাহতাবকে ফোন করে সে জেনেছে, ‘তাদের রুম বিচ্ছেদের কথাটা মামুনের বৌকে মাহতাবই বলেছে, সহানুভূতি পাওয়ার উদ্দেশ্যে।’ এরপর কেমন যেন ঝিম হয়ে যায় এলিনের মাথা।
সকালে সবার আগে ঘুম থেকে জাগে না এলিন। জাগানো হয়নি বলে আদ্রিতাও না। সকাল ৮টায় বুয়া এসে কয়েকবার কলিং বেল বাজায়। মাহতাব উঠে এলিনের রুমের ভিড়ানো দরজা ধাক্কা দিয়ে দেখে, এলিন ও আদ্রিতা দুজনেই ঘুমাচ্ছে। দরজা টেনে রেখে মেইন দরজা খুলে মাহতাব।
বেশ কিছুক্ষন পর আদ্রিতা জেগে ওঠে আম্মুকে ডাকে। শুনে বুয়া তড়িগড়ি করে মাহতাবের রুম থেকে বের হয়ে রান্না ঘরে চলে আসে। কিছুক্ষণ পর মাহতাব ড্রাইনিং রুম থেকে এলিনকে ডাকে। কোনো সাড়া না পেয়ে রুমের ভেতর আসে। দরজায় দাঁড়িয়েই সে লক্ষ্য করে, এলিন নিথর ভাবে শুয়ে আছে। মাহতাবের কেমন যেন সন্দেহ হয়। আদ্রিতা বালিশের পাশে অবাক চোখে মাহতাবের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে জন্মের পর এই প্রথম সম্ভবত বাবাকে মায়ের খাটে বসতে দেখছে বলে হয়তো। যদিও বাবা হিসেবে মাহতাব কখনোই মেয়েকে আদরের কমতি রাখেনি।
মাহতাব খাটে বসে কাঁপা হাত দিয়ে ‘এই শুনছো’ বলতে বলতে এলিনের হাঁটুতে ধাক্কা দেয়। এলিনের কোনো সাড়া নেই। এবার আদ্রিতা অনুভূতিহীন চোখে মায়ের দিকে তাকায়। মাহতাব কিছুটা বিছলিত হয়ে এলিনের কাঁধে হাত রেখে যেন চমকে উঠে। চঞ্চল হাতে এলিনের ঘাড়, গলার নিচ, হাত স্পর্শ করে। এলিনের শরীর হীম হয়ে আছে। দ্রুত চঞ্চল হয়ে উঠা মাহতাব, তথধিক দ্রুত নিথর হয়ে যায়। কিছু বুঝে উঠার আগেই চোখ পড়ে টেবিলের ওপর, ৪/৫টি ট্যাবলেটের খালি পাতা পড়ে আছে। কিছুক্ষণের জন্য কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে যায় মাহতাব। এরই মধ্যে মাকে জাগাতে ডাকতে ডাকতে কান্না শুরু করে আদ্রিতা। আদ্রিতার কান্না শুনে মাহতাবের মা রুমে আসে। পেছন পেছন বুয়াও আসে।
পরক্ষনে মাহতাব আদ্রিতাকে কোলে নিয়ে মাকে ডেকে রুম থেকে বেরিয়ে আসে। নিজের রুমে এসে এলিনের ছোট বোন রিতুকে ফোন করে।
১০টা নাগাদ রিতু আসে। দরজা খুলে দেয় বুয়া। রিতু আপুকে ডাকতে ডাকতে এলিনের রুমে আসে। মাহতাব ও তার মা একে অপরের চোখের দিকে বসে আছে। ও পাশের রুম থেকে রিতুর কান্নার শব্দ শুনে উঠে আসে তারা। মাহতাব যখন রুমে ঢুকে তখন নিথর শরীরে পড়ে থাকা এলিনের মাথার কাছে একটি চিরকুট তুলে নেয় রিতু। নিঃশব্দে পড়ে সেটি মাহতাবের দিকে এগিয়ে দেয়। মাহতাব অপরাধী হাতে চিরকুটটি হাতে নিয়ে দেখে তাতে লেখা-
পৃথিবীটা সবার জন্য তৈরি হয়নি, অনেক আগেই তা জেনেছিলাম, কিন্তু পুরোপুরি উপলদ্ধি করতে ছয় বছর লেগে গেল। তাই আর বোঝা বা বাঁধা হয়ে থাকতে ইচ্ছে করলো না।

আমার প্রথম এবং শেষ অনুরোধ, নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে এই মৃত্যু নিয়ে থানা-পুলিশ করো না, প্লিজ। আর নতুন কোনো উদাহরণ হতে চাই না আমি…..হাসান মাহমুদের গল্প হাসান মাহমুদের গল্প হাসান মাহমুদের গল্প হাসান মাহমুদের গল্প

হাসান মাহমুদের গল্প

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!

error: Content is protected !!